আমরা বজ্রবিদ্যুৎ বলতে যা বুঝি সেটা বিনা মেঘে হয় না। বস্তুত এটি একটি ঘরের বিদ্যুতের শর্ট সার্কিটের স্ফুলিঙ্গের মতো। ঘরের প্রবাহী বিদ্যুৎ ২২০ ভোল্ট, কিন্তু মেঘের বজ্রবিদ্যুৎ কয়েক লক্ষ ভোল্টের হতে পারে। ২২০ ভোল্টের ঘরের বিদ্যুতের ব্যবহারে ত্রুটি থেকে মানুষের নানা ক্ষয়ক্ষতির কথা আমরা শুনে থাকি। যে কারণে উন্নত দেশে মানুষের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমানোর জন্য ঘরের বিদ্যুৎ ১১০ ভোল্টের করা হয়। কাজেই লক্ষ লক্ষ ভোল্টের মেঘের স্থির বিদ্যুতের বজ্রপাতের জন্য ক্ষতির পরিমাণ বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এই আধুনিক যুগেও বজ্রবিদ্যুতের ব্যবহার এখনও সম্ভব হয়নি। তাহলে এই দুর্যোগ মানুষের অনেক সুযোগ করে দিত। একটু সাবধানতা অবলম্বন করলেই এই দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। তবে যে কোনও সুরক্ষার একটি সীমাবদ্ধতা আছে, যেখানে এই দুর্যোগের উৎপাদক কালবৈশাখী ও দোসর টর্নেডো ও সাইক্লোন।
আরও পড়ুন-বিরোধীদের মতোই ভোটের আগে জেগে ওঠে কেন্দ্রীয় এজেন্সি : শতাব্দী
বজ্রবিদ্যুৎ থেকে নিরাপদ জায়গা
যে কোনও পাকা ঘরের মধ্যে, ট্রেনের মধ্যে, জাহাজের ওপর, হাওড়া ব্রিজ, গড়ের মাঠে শহিদ মিনারের ১৩০ ফুটের মধ্যে, কলকাতার সর্বোচ্চ বাড়ি দি ৪২-এর ৮৫০ ফুটের মধ্যে, ইডেন গার্ডেন-এর চার বাতিস্তম্ভের মধ্যে, নিউ টাউন ইন্ডিয়া গেটের নিচে, কুতুবমিনার-এর ৩৫০ ফুটের মধ্যে, আইফেল টাওয়ারের ১০০০ ফুটের মধ্যে, বুর্জ খলিফার ২৫০০ ফুটের মধ্যে ইত্যাদি ইত্যাদি। স্থানগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঘরের মধ্যে, ধাতুর কাঠামোর মধ্যে উঁচু বিল্ডিং-এর কাছাকাছি থাকলে বজ্রপাতের ভয় অনেক কম।
বজ্রবিদ্যুৎ থেকে বিপজ্জনক জায়গা
ফাঁকা মাঠ, গাছের তলায়, উন্মুক্ত কৃষিজমি, বাড়ির ছাদ, নদীতে নৌকার ওপর, এরোপ্লেনের মধ্যে বজ্র-বিদ্যুতের জন্য বিপজ্জনক জায়গা।
আরও পড়ুন-দু-তরফের অভিযোগের তদন্ত শুরু করল ভূপতিনগর পুলিশ
এর কী কারণ
আমরা সবাই ব্যাটারি দেখেছি। এও দেখেছি ব্যাটারির এক প্রান্তে যোগ (+) চিহ্ন ও ওপর প্রান্তে বিয়োগ (-) চিহ্ন থাকে। মানে ব্যাটারির দুই প্রান্তের ধর্ম আলাদা, একটি প্রান্তে + (পজিটিভ) চার্জ ও অন্য প্রান্তে -(নেগেটিভ) চার্জ। এখন ব্যাটারির দুই প্রান্তে তামার তার লাগিয়ে যদি ছোট টর্চ লাইট বালব (ব্যাটারি, বাল্ব ও তার ঠিক থাকতে হবে) জ্বালানো হয়, তখন বলা হবে ব্যাটারির এক প্রান্ত থেকে ইলেকট্রিক চার্জ অন্য প্রান্তে বাল্বের ফিলামেন্টের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় ঘর্ষণের ফলে ফিলামেন্ট বা বাল্ব জ্বলছে। ঠিক তেমনি আমাদের বিরাট পৃথিবীও একটি + চার্জের ভ্যান্ডার হিসাবে কল্পনা করা যেতে পারে। আর আকাশের মেঘে সাধারণত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে + (পজিটিভ) চার্জ ও – (নেগেটিভ) চার্জ থাকে। (১) এবার যদি কোনও কারণে মেঘের + চার্জগুলো পৃথিবীর কাছে আসে তখন কোনও বজ্রবিদ্যুৎ হবে না, কারণ তখন পৃথিবী ও মেঘের চার্জ সমান + (পজিটিভ)। (২) যদি মেঘের + চার্জ ও – (নেগেটিভ) চার্জ কাছাকাছি আসে তখন আকাশেই বিদ্যুৎ চমক বা স্পার্ক হবে। এই স্পার্কের আওয়াজকে বজ্র (শব্দ) বলে। তখন মাটির ওপর কোনও বিপদ নাও হতে পারে, তবে এরোপ্লেনের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। (৩) যদি মেঘের – (নেগেটিভ) চার্জ পৃথিবীর + পজিটিভ চার্জের কাছে চলে আসে তখন এই দুই বিপরীত ধর্মী ইলেকট্রিক চার্জ বিশাল স্পার্ক করবে এবং কাছাকাছি বস্তু বা প্রাণীকে তড়িদাহত করবে। বস্তুত এই ঘটনাকে বজ্রপাত বলা হয়।
আরও পড়ুন-জলপাইগুড়িতে শুরু ভোটগ্রহণ, আজ কোচবিহারে
বজ্রবিদ্যুৎ নিবারণের উপায়
আগে যে সমস্ত জায়গা নিরাপদ বলা হয়েছে সেগুলি প্রতক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে উচ্চতম জায়গা আর ভিতের মধ্যে ধাতুর যোগাযোগ রয়েছে বা বাইরে থেকে মোটা তামার পাত লাগানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বজ্রপাত নিবারণের জন্য। অর্থাৎ মেঘের – (নেগেটিভ) চার্জ থেকে পৃথিবীর + (পজিটিভ) চার্জ পর্যন্ত মোটা তামার পাতের যোগাযোগ স্থাপন করলে, মেঘের – (নেগেটিভ) চার্জ তামার পাতের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীতে প্রবেশ করবে। একে আর্থিং করা বলে। ভালভাবে আর্থিং করলে কোনও বজ্রপাত হবে না।
আরও পড়ুন-সাংসদদের টেনে-হিঁচড়ে বাসে তুলল বিজেপির পুলিশ
কৃষিক্ষেত্রে উপায়
কালবৈশাখীর সময় মেঘের – (নেগেটিভ) চার্জ মাটির কাছাকাছি চলে আসে। ওই সময় – (নেগেটিভ) চার্জগুলির আশপাশে কোনও আর্থিং না থাকায় কৃষকের শরীর এর মধ্যে দিয়ে পৃথিবীতে প্রবেশ করবে এবং কৃষক মারা যাবেন। আকাশে ঘন কালো মেঘ থাকলে বাড়ির বাইরে বের হওয়া চরম বিপদের। এ-কথা সবসময় সবাইকে মনে রাখতে হবে। যদি কৃষিক্ষেত্রে একটি অন্তত ২০ ফুট উঁচু পুরাতন লোহার জলের পাইপ (দেড় ইঞ্চি) মাটির তলায় ৫ ফুট আর মাটির ওপর ১৫ ফুট করে উলম্ব ভাবে পুঁতে রাখা যায় তবে এটি আর্থিং-এর কাজ করবে। এতে পাইপ থেকে ১৫ ফুটের মধ্যে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভবনা থাকবে না। ঘন কালো মেঘ দেখলে এই পাইপের ১৫ ফুটের মধ্যে চলে আসতে হবে, তবে কখনও পাইপকে ছোঁয়া যাবে না। পাইপের উচ্চতা যত বেশি হবে তত সুরক্ষা বাড়বে। সব সময় মনে রাখতে হবে বিদ্যুৎ বিষধর সাপের থেকেও ভয়ানক। এ-ব্যাপারে লেখকের সঙ্গে পত্রিকা মারফত যোগাযোগ করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন-আজ ফের বোসের কাছে
কেন বাড়ছে বজ্র-বিদ্যুৎ
গত ১০০ বছর ধরে গাছ কেটে নগর ও শিল্প-উন্নয়ন করতে গিয়ে বিশ্ব-উষ্ণায়নকে আমন্ত্রণ। এল নিনো আবার শুরু হয়েছে গত ৮ জুন ২০২৩ থেকে। গত ১৭ নভেম্বর ২০২৩-এ বিশ্ব-উষ্ণায়নের সীমারেখা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে শিল্প-পূর্ববর্তী সময় থেকে। এই কারণে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে চট্টগ্রামের চাকমা উপত্যকা, উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা ও পশ্চিমে ছোটনাগপুর উপত্যকা নিয়ে গঠিত বিশাল কড়াইয়ের মতো অঞ্চলটিতে যে দুই প্রকার কালবৈশাখী হয় তাদের গতিশক্তি ও তাপশক্তির ব্যাপক পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। ফলস্বরূপ টর্নেডোর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি।
প্রতিকার
গাছ লাগানো ও গাছের অভয়ারণ্য তৈরি, ব্যাপক সৌরশক্তির ব্যবহার। পাহাড় থেকে দূরে সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলে ছোট ছোট আদর্শ নগর তৈরি। যেখানে প্রশস্ত রাস্তা সমেত উন্মুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকবে। অর্থনৈতিক কারণে সমুদ্র ও দ্বীপের ব্যাপক ব্যবহার।