অর্থমন্ত্রী, একটু শুনুন আদানিদের কাহিনি

গত ১৬ অক্টোবর, মাননীয় অর্থমন্ত্রী শ্রীমতী নির্মলা সীতারামনকে একটি পত্র লিখেছেন সাংসদ জহর সরকার। আজ ‘জাগোবাংলায়’ সেই বক্তব্যের সারাৎসার...

Must read

গত ১২ অক্টোবর, ২০২৩-এ ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্সিয়াল টাইমস’-এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। শিরোনাম, ‘আদানির কয়লা আমদানি রহস্য যেটার মূল্য চুপচাপ দ্বিগুণ হয়ে গেল’। এই শিরোনামের নিচে কিছু কথা লেখা ছিল উপশিরোনাম হিসেবে। সেটাও সমানভাবে স্পষ্ট। সেখানে লেখা : কাস্টমস-এর নথিপত্র থেকে বোঝা যায়। ‘সাগরপাড়ের ফড়েদের ব্যবহার করে ভারতীয় বাণিজ্যসংস্থাগুলির একীভূত সংস্থা জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে।’ ‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’-এর প্রতিবেদনে আরও প্রকাশ : ‘নথিপত্র দেখাচ্ছে বিগত দু বছরেরও বেশি সময় ধরে আদানি তাইওয়ান, দুবাই আর সিঙ্গাপুরে সাগরতটের মধ্যস্থকারবারিদের ব্যবহার করে ৫ বিনিয়ন (৫০০ কোটি) ডলার মূল্যের কয়লা আমদানি করেছে যেটার মূল্য বাজার মূল্যের দ্বিগুণ।’ আদানিদের (Adani Group) এরকম বড় বড় কারচুপি এবং মধ্যস্থ কারবারিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি ইতিপূর্বে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টেও উল্লিখিত হয়েছিল। ফিনান্সিয়াল টাইমস ওই রিপোর্টের সমর্থনে তথ্যাদি প্রকাশ করেছে, জানিয়েছে, ভারতের সর্ববৃহৎ তৈল আমদানিকারক যারা সেই আদানিদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে একটি অভিযোগ বর্তমান। তারা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করেছে। এজন্য লক্ষ ভারতীয় গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের বিদ্যুতের জন্য অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহন করতে হচ্ছে।

১৪ পাতা জুড়ে তথ্য ও নথি সহযোগে বিস্তারিত প্রতিবেদন। ছত্রে ছত্রে আর্থিক তছরুপের বিবরণ। কীভাবে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থা অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণে অনুমোদন দিয়েছে, তার বর্ণনা। কীভাবে বিলিয়ন বিলিয়ন (স্মর্তব্য ১ বিলিয়ন = ১০০ কোটি) ডলার আদানিদের (Adani Group) পকেট ভরতে নষ্ট করা হয়েছে, তার আখ্যান। ফিনান্সিয়াল টাইমস-এর প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য, দ্য ওয়ার (The Wire)-সহ বিভিন্ন নিরপেক্ষ পোর্টালেও প্রকাশিত হয়েছে। অভিযোগের মাত্রা এতটাই গুরুতর যে তা সরকারের প্রতিক্রিয়া দাবি করে।

বিগত প্রায় দুবছর ধরে কয়লা আমদানির ক্ষেত্রে আদানির ভূমিকার কথা আমি নিজে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বলার চেষ্টা করেছি, অতিরিক্ত দাম বাড়ানো-সহ নানাবিধ কারণে কয়লা ও বিদ্যুৎক্ষেত্রের মতো দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুল্কবিভাগ, ডিরেক্টর অব রেভেনিউ ইনটেলিজেন্স এবং ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট)-এর নাকের ডগায় এসব অপকর্ম চলছে। ফিনান্সিয়াল টাইমস-এর প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের বিধিভঙ্গ হয়েছে এসব লেনদেনে। গত ন-বছরে ইডি ৩,৩০০ ব্যক্তি ও সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে মূলত অ-বিজেপি দলগুলিকে ফাঁসানোর লক্ষ্যে, তবে মাত্র ০.৫ শতাংশ মামলায় দোষপ্রমাণে বা দোষী সাব্যস্তকরণে সফল হয়েছে। কিন্তু কী আশ্চর্যের বিষয়, আদানি এবং সঙ্গীসাথীদের বিরুদ্ধে কোনও তদন্তেই আগ্রহ দেখায়নি তারা।

সংসদে গত বছর ৯ জুলাই আমি নিজে আদানিদের বিষয়ে একটা প্রশ্ন তুলেছিলাম। উত্তরে বিদ্যুৎ মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সরকার ঠিক করেছে কোল ইন্ডিয়া লিমিটেডের মাধ্যমে কয়লা আমদানি করবে। আমদানিকৃত কয়লা কীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলিকে সরবরাহ করা হবে, কোল ইন্ডিয়া কীভাবে তাদের বরাত দেবে, সে-সংক্রান্ত নিয়মাবলি তৈরি করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে বলে তখন বিদ্যুৎ মন্ত্রী জানিয়েছিলেন। এরপর কী যে হল তা আর জানা যায় না। আমরা আজও অবগত নই, এসব অভিযোগ সামনে আসার পরেও কীভাবে নানা বিদেশে পঞ্জীকৃত সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে সরকারি ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখছে, কীভাবে তারা কয়লা আমদানির ক্ষেত্রে প্রভুত্ব অক্ষুণ্ণ রাখছে, ইত্যাদি।

আরও পড়ুন- চতুর্থী থেকেই শহর সামলাতে রাস্তায় পুলিশ

সপ্তাহখানেক পর ১৮ জুলাই, ২০২২-তে বিদ্যুৎ মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সাম্প্রতিকতম আমদানি নীতি মোতাবেক কয়লাকে খোলা সাধারণ অনুমতি (ওপেন জেনারেল লাইসেন্স বা ওজিএল)-র আওতায় রাখা হয়েছে। ফলে গ্রাহকরা তাঁদের পছন্দমতো উৎস থেকে কয়লা আমদানি করতে পারবে, চুক্তি অনুযায়ী তাদের মূল্য দিতেও সক্ষম হবে তারা। এবছর ২৮ মার্চ, আদানি ও আমদানিকৃত কয়লার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সম্পর্কে আমার তোলা একটি প্রশ্নের উত্তরে বিদ্যুৎমন্ত্রী যা উত্তর দেন তাতে বোঝা যায় ওজিএল-এর উদ্দেশ্য একটাই, কয়লা আমদানির ক্ষেত্রে হাত ধুয়ে ফেলার বন্দোবস্ত করা। দামে কারচুপি হচ্ছে, আমদানি আর বিদ্যুতের অর্থনীতি কণ্টকিত, বৈদেশিক মুদ্রা ইচ্ছাকৃতভাবে খোয়ানোর বন্দোবস্ত হয়েছে। তাও হাত ধুয়ে ফেলার ব্যবস্থা! যাই-ই হোক না কেন, বিজেপি-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের সুরক্ষিত রাখার আয়োজন যাতে এতটুকু বিঘ্নিত না হয়, সেটার দিকে সরকারের তাবৎ নজর কেন্দ্রীভূত। বিস্ময়কর বিষয় হল, অর্থমন্ত্রকের এজেন্সিগুলোর গ্রাহকদের স্বার্থরক্ষা, বৈদেশিক মুদ্রার সংরক্ষণ, এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। বিদ্যুৎ মন্ত্রক বারবার বলছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আমদানিকৃত কয়লায় ১০ শতাংশ মেশাতে পারবে। দেশে উৎপাদিত কয়লার চেয়ে এই কয়লার দাম পাঁচ থেকে দশ গুণ বেশি। তাতে বিদ্যুৎ সংকট কতটা এড়ানো গিয়েছে সেটা সংশয়াতীত বিষয় নয়, তবে নিংসন্দেহে বলা যায়, এর ফলে আদানি (Adani Group) ধনীতর হয়েছে আর গ্রাহকদের বিদ্যুৎখাতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফিনান্সিয়াল টাইমস-এর প্রতিবেদন সাফ দেখিয়ে দিয়েছে, ভারতে বিদ্যুতের দাম ইউনিট-পিছু বৃদ্ধি পেয়েছে আদানির ইচ্ছাকৃতভাবে দাম বাড়ানোর কারণে, অথচ ১ ডিসেম্বর, ২০২২-এ তাঁর দেওয়া উত্তরে বিদ্যুৎ দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী একটি শব্দও বলেননি। তিনি উলটে জ্ঞান শুনিয়েছেন, তাপন মূল্যের পার্থক্যজনিত কারণে দেশে যে কয়লা পাওয়া যায় তার দামের সঙ্গে আমদানি করা কয়লার দামের তুলনা চলে না। আমদানি করা দাম আর উৎপত্তিস্থল, সমুদ্রপথে আনার জন্য খরচ, বিমা খরচ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, সুতরাং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চাহিদা-জোগানের ছবিটা ঠিক কীরকম তার ওপর আমদানিকৃত কয়লার দাম নির্ভর করে। এসব জ্ঞান দেওয়ার সুযোগ ছাড়েননি মোদিজির মন্ত্রিসভার ওই রাষ্ট্রমন্ত্রী।

আমি আদানি (Adani Group) এবং অন্যান কয়লা আমদানিকারক সংস্থার বিষয়ে বিস্তরিত জানতে চায়েছিলাম। উত্তরে কেন্দ্রীয় কয়লামন্ত্রী ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২-এ ৫৮৬টি কয়লা সরবরাহকারী সংস্থার একটা বিরাট তালিকা পাঠিয়ে দেন। সংস্থাগুলি বিদেশে পঞ্জীকৃত। ভাবটা এমন, দেখে নাও খুঁজে বের কর এবার।
এ-বছর ১২ জুলাই আমি কয়লামন্ত্রীর কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি। তাতে বলা হয়েছে, কয়লা মন্ত্রক কোম্পানিভিত্তিক আমদানি তথ্যের কোনও তালিকা তৈরি করে না। কয়লা আমদানি নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার পোর্টালে কয়লা আমদানিকারকদের পঞ্জীকরণ বাধ্যতামূলক। পোর্টালে আমদানিকারকদের নামের সঙ্গে আমদানির যে পরিমাণের উল্লেখ আছে সেটা প্রকৃত আমদানি করা কলয়ার পরিমাণ নাও হতে পারে, কারণ সেটা দেখাচ্ছে তারা কতটা কয়লা আমদানি করতে ইচ্ছুক, তার পরিমাণ, বোঝাই যাচ্ছে আদানিদের আড়াল করতেই এত আয়োজন। শুধু কয়লা আমদানির ব্যাপারেই নয়, রাশিয়া থেকে কতটা অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে তারা আর তারপর তার ভিত্তিতে কী বিপুল পরিমাণ রফতানি করেছে, সেটাও ঢাকা পড়েছে এর ফলে।
ফিনান্সিয়াল টাইমস-এর প্রতিবেদন ফাঁস করে দিয়েছে, আদানি আর তার সহযোগীরা ৪২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে অর্ধেক কয়লা আমদানি করেছে। আর কয়লা ও বিদ্যুৎ মন্ত্রকের মন্ত্রীরা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা অব্যাহত রাখছেন, সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

Latest article