হিমি মিত্র রায়: শোন্, অত ঢপবাজি করিস না অভি, আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করবি না বলে দিলাম। এসব সুইসাইড টুইসাইডের মতো ফালতু কথা তো একদমই না, এসব করে আসল ব্যাপারটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিস সেটা আমি জানি রে।
-ফালতু কথা?
-নয়তো কী? তোকে আমি কবে থেকে বলছি হিল রোডের পাইনাপল ফ্যাক্টরিতে কেমিস্ট চাইছে, ওঁরা অ্যাড দিয়েছে তিনদিন হয়ে গেল। তোর প্রস্তাবটা লুফে নেওয়া উচিত ছিল। সেটা না করে ইউ আর ওয়েটিং ফর আ মিরাকল! আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি অভি।
ন্যাপকিন স্ট্যান্ড থেকে একটা ন্যাপকিন নিয়ে মুঠোর মধ্যে চিপতে থাকল রাইমা।
আরও পড়ুন-ক্যালেন্ডারের ইতিহাস-ভূগোল
-তুই আমার বেটার হাফ হতে যাচ্ছিস আগামীতে। তাই তো?
রাইমা উত্তর দেয় না, জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু। কাঁচের বাইরে দিয়ে এক নতুন দম্পতি উল্টোদিকের ল’জারে শপে ঢুকল। ডিসপ্লে করা হরেক কিসিমের অন্তর্বাসের মধ্যে একটা সি গ্রিন কালারের ব্রা-র দিকে দেখিয়ে ছেলেটি মেয়েটিকে ইশারা করছে, মেয়েটি লজ্জা লজ্জা করে তাকাচ্ছে।
-যদি না শুনিস তবে থাক।
-বল না, শুনছি তো।
-সবই তো জানিস, একটা বড় অপারেশন হয়েছে মার। আমি না থাকলে কী সমস্যা হবে ভাবতে পারিস! সারাটা দিন মা বাড়িতে একা একা থাকবে।
-সব বুঝলাম। বরাবর তো আমিই বুঝে এসেছি অভি! ইউ কান্ট ডিনাই!
একটা বড় শ্বাস টেনে নিল অভিজ্ঞান। তারপর বলল, আর ক’টা মাস দাতে দাঁত চেপে অপেক্ষা কর না প্লিজ, ক্লার্কশিপের চাকরিটা আমি পেয়েই ছাড়ব।
আরও পড়ুন-একটি দিবাস্বপ্ন
-আমি তোর জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করতে রাজি আছি। কিন্তু তুই তো জানিস আমার বাড়িতে কী সিচুয়েশন! মা সারাক্ষণ খোঁটা দিয়ে কথা বলে। বাবা মাঝে মাঝে চুপ হয়ে যায়। রিটায়ার করার পর কোনও বাবা কি তার মেয়েকে বাড়িতে বসিয়ে রাখতে চায়? তুই কি শিওরিটি দিতে পারিস যে এই পরীক্ষাটায় তুই পাশ করবি?
-তুই যদি বলিস, ‘আমি আছি তোমার সঙ্গে’, তাহলে কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। তুই আমার স্ট্রেন্থ রাই, উইকনেস হোস না প্লিজ।
-রাইমার হাতটাকে চেপে ধরে অভি।
উল্টোদিকের ল’জারে শপে কাপলটি ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরোচ্ছে। মেয়েটির ওর মতোই বয়স হবে ২৬/২৭। মুখে আলোর মতো খুশি। দু’হাতে ভর্তি সাদা লাল চুড়ি, আজকাল বাঙালিদেরও এই স্টাইলটা খুব পছন্দ, অনেকেই নতুন বিয়ের পর পর এরকম চুড়ি পরে। ওরও এমন কত ইচ্ছে করে যে! কিন্তু এখন বাবার চোখে চোখ রাখতে পারে না রাইমা। মনের মধ্যে একটা নাগরদোলা সারাক্ষণ ঘুরে চলছে গোল গোল।
আরও পড়ুন-বিশ্ব উদ্বাস্তু দিবসের ভাবনা
উপর থেকে নিচের দৃশ্যগুলো সব কেমন ঝাপসা হতে শুরু করে। অল্প অল্প দেখা যায় গোলাপি চুড়িদার পরা মেয়েটার ওপর দিকে চেয়ে থাকা মুখ, খেলনার দোকানের বাচ্চার পেছন পেছন ছুটন্ত মা-বাবা, পিৎজা, মোমো, চকোলেট পেস্ট্রি, সব গন্ধগুলো কেমন গুলিয়ে যায়! সব মিলেমিশে একটা অদ্ভুত গন্ধে ঝিমঝিম করে মাথা। অভিজ্ঞানের কথাগুলো ওই গন্ধটার মধ্যে ঢুকে যায় কেমন যেন।
হঠাৎ করে বাবার গন্ধ পায় রাইমা। অফিস যাওয়ার সময় বাবার গায়ে এক অদ্ভুত গন্ধ পেত ও, নারকেল তেল আর অডি কোলনের। অপূর্ব সে গন্ধ, খুব পিওর। রাইমা জড়িয়ে ধরত বাবাকে, কিছুতেই অফিস যেতে দেবে না। বাবা তখন ভুলিয়ে ভালিয়ে রাতে গল্প শোনানোর কথা বলে রাজি করত ওকে। এ গন্ধটা ছাপিয়ে যায় বাকি সব গন্ধগুলোকে। অভিজ্ঞান ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে যায় কেমন যেন, রাইমা তাকিয়ে থাকে, শুধু তাকিয়েই থাকে।
অভি পারতো এই চাকরিটাতে রাজি হয়ে যেতে, সবসময় ‘মায়ের প্রবলেম মায়ের প্রবলেম’ করে চলছে। এবার আর ভাল লাগছে না। নিচ তলায় তো ভাড়া আছে, ভাড়াটে গুজরাটি ফ্যামিলিটার সঙ্গে ওদের ভাল সম্পর্ক। গঠিয়া গুজিয়া দিতে ওই ন্যাকা মেয়েটা বারবার উপরে যায়। ফোন করলে মাঝেমাঝেই ওর গলা পায় রাইমা। ওরাই না হয় মাকে দেখে রাখত!
আরও পড়ুন-আইসক্রিমের রূপকথা
জানলার ধারে বিছানার উপরে উপুড় হয়ে মোবাইল স্ক্রিনে আঙুল দিয়ে নিজের অজান্তেই ছবি সরাচ্ছে। একটা ছবিতে এসে আটকে যায় ও। সেবার গ্রিন ভিউ রেস্টুরেন্টে অভির সঙ্গে গিয়েছিল রাইমা, শর্ত ছিল টিউশনির টাকায় কিনে দেওয়া শাড়ি পরে আসতে হবে রাইমাকে। আর অভিকে ওর দেওয়া পাঞ্জাবি পরে আসতে হবে। পকেটমানি থেকে জমিয়ে জমিয়ে হলুদ রঙের পাঞ্জাবিটা কিনেছিল ও। পরম যত্নে পাঞ্জাবির বাঁদিকের পিঠের কাছে দুটো কথা লিখে দিয়েছিল , ‘ভালবাসি তোমাকে’। অভি ঠোট ছুঁইয়ে বলেছিল, ‘সারাক্ষণ এটাই পরে থাকব, মনে হবে তুই জড়িয়ে আছিস!’
মুখ বেঁকিয়ে রাইমা বলেছিল, ভালবাসিস? তবে তো আমাকে বিয়ে করতি!
অভি কিছু বলেনি উত্তরে। তবে সেই যে পাঞ্জাবিটা পরা শুরু করল, আর ছাড়ে না।
ও কথা শোনাতে ছাড়ে না অভিকে, চান্স পেলেই এটা-সেটা শুনিয়ে দেয় সবসময়। অবশ্য রাইমার কি শুধু একারই দায়? অভির কোন রেসপন্সিবিলিটি নেই? এসব ভাবতে ভাবতেই হুশ করে দরজা খুলে হুড়মুড় করে কে একটা ঢুকে পড়ল।
আরও পড়ুন-আগামীর পড়ুয়াদের অতীত, না-চেনাতে এবার বইয়ে বদল
-আরে তুমি কখন এলে মান্তুদি?
– তুই তো একমনে মোবাইল দেখে চলছিস।
-জাস্ট এমনি, তুমি হঠাৎ খবর না দিয়ে কখন চলে এলে?
-‘এই তো সকালেই। তোর কাঞ্চনদার তো উঠল বাই তো কটক যাই। হঠাৎ ঠিক করে বসল গ্যাংটক যাবে, তড়িঘড়ি দুদিনের মধ্যে সব করল একাই। আমাকে ভীষণ ভালবাসে রে।’
-ভাবুক হয়ে পড়ে মান্তুদি।
অবাক হয়ে যায় রাইমা। এই মান্তুদি একসময় চঞ্চলদার প্রেমে পাগল ছিল। কতবার বাড়ি থেকে পালানোর ছক কষেছে! একবার হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল কাকিমার কাছে, তারপর কী মার! চঞ্চলদাকে রাইমা দেখত ছাদে উঠে অদ্ভুতভাবে পায়চারি করতে আর মান্তুদিদের ব্যালকনির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে। এই দুটি কোনাকুনি বাড়ির ব্যালকনিতে আর ছাদেই ওরা প্রেম করত। তারপর একদিন এই ন্যাড়া ছাদ থেকে পড়েই চঞ্চলদা মারা গেল। পড়ে গিয়ে মৃত্যু না আত্মহত্যা এখন অবধি জানা গেল না। তখন অবশ্য মান্তুদির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে!
আরও পড়ুন-মনের মধ্যে নরম আনন্দের সঞ্চার করে কবিতা
রাইমার মনে হয় চঞ্চলদা আত্মহত্যাই করেছিল। আর সেই মান্তুদি এখন বরের সঙ্গে গদগদ হয়ে গ্যাংটক ঘুরতে যাচ্ছে। ভালবাসা কি কর্পূরের মতো! রাইমারও কি তাই হবে? বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে ওর, খুব রাগ হয অভির ওপর। অনেক সহ্য করেছে। এই যে এত বছর ধরে আটকে রেখেছে!
মান্তুদি ফোনে বরের সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলেছে যে দরজার কোনায় গিয়ে ফিসফিস করে উত্তর দিচ্ছে, হাসছে আর পায়ের আঙুলের নখ দিয়ে অন্য আঙুলে ঘষছে। রাইমার দিকে নজর নেই। দু’ হাঁটুর উপর থুতনি রেখে বসে থাকে রাইমা।
ফোনটা কানে নিয়ে ধুপধাপ করে বেরিয়ে গেল মান্তুদি। অভিকে ফোন লাগায় রাইমা, আরেকটু কথা শোনানো যাক ওকে। মান্তুদিকে দেখে হঠাৎ রাগ উঠে গেল। এভাবে চলতে পারে না। আবার নিচের ঘরে যেতে হবে লাঞ্চ করতে। সারাদিন একলা এই ঘরটার মধ্যেই নিজেকে বন্দি করে রাখে রাইমা। বাড়িতে থাকলে সারাদিন মায়ের গোমড়া মুখটা বারবার মুখের সামনে চলে আসে, ভাল লাগে না একটুও।
দু’বার ফোন বেজে গেল, অভি ফোনটা তুলল না। কী এমন মহান কাজ কে জানে। ফোনটা ধরে তো বলবে যে ব্যস্ত আছি! এবার একটা ডিসিশন নিতেই হবে, অনেক হয়েছে, বাবার জন্য মন খারাপ হয় খুব।
আরও পড়ুন-উর্দি ছেড়ে কোচিং শিক্ষক পুলিশ
টুংটাং বাসনপত্রের আওয়াজ, বোতল থেকে গ্লাসে জল ঢালার শব্দ শুনতে শুনতে সিঁড়ি দিয়ে নামে ও। মা আজকাল খেতেও ডাকে না। নিজে থেকেই টাইম মতো খেতে চলে আসতে হয়। আগে বড্ড সুন্দর করে ডাকত, সে দিনগুলোর কথা মনে পড়লে গলার কাছটা কেমন একটা দপ করে ওঠে।
কী গ্যারান্টি আছে যে অভির চাকরিটা হবেই! কেন নিজের জীবনটা এভাবে নষ্ট করতে যাচ্ছে রাইমা! মা বাবা তো ভালটাই চাইবে, কতবার এই কথা মা বুঝিয়েছে। বাবা যদিও মুখ ফুটে একটা কথা বলেনি কিন্তু বাবার চোখ সব কথা বলে দেয় ।
চেয়ারটা টেনে বসল ও। টিভি চলে যাচ্ছে নিজের মতো, ভলিউম কমানো। বাবা ও ঘরে পেপার পড়ছে। মা একটা হাঁক দিল বাবাকে, ‘বসে পড়ো’। রাইমা চুপ করে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে। মা এসে মুখের সামনে ‘ঠক’ করে ভাতের হাঁড়িটা রাখল। ওর দিকে তাকাল না ঘুরে। হাঁড়ি থেকে একটা গরম ধোঁয়া ওর মুখে এসে লাগল, মুখ সরিয়ে নিল রাইমা। মা হাতা দিয়ে বাবার থালায় ভাতবাড়া শুরু করল ভাত। মা এখন রান্না করে না, আরতি মাসি যা করার করে দেয়। বলে ‘মন ভাল নেই, রান্না করতে ভাল লাগে না। সব ঠিক হলে আবার পরে রান্না করব।’
আরও পড়ুন-ব্যাটিং ব্যর্থতায় হার, রঞ্জি বিদায় বাংলার
ওর জন্যই এইসব আচরণ সেটাও ভাল করে জানে রাইমা। বাবা বেসিনে হাত ধুয়ে এসে চেয়ার টেনে ওর উলটো দিকে বসল। মা বাবার পাশে এসে বাবাকে ডাল বেগুন ভাজা দিল। যেন মূকাভিনয় করে চলছে কয়েকটি প্রাণী। বাবা রিমোট দিয়ে ভলিউম বাড়াল। শহরের লোকাল নিউজ দেখাচ্ছে, লাইভ। রাইমা ভাত ভাঙল, ডাল থেকে কাঁচা লঙ্কাটা তুলে সাইডে রাখল। টিভিতে একটা অ্যাক্সিডেন্টের খবর দেখাচ্ছে। এইমাত্র পোস্ট অফিসের সামনে একটি ট্রাকের সঙ্গে বাইক অ্যাক্সিডেন্টে বাইক চালকের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে। সামনে থেকে দেখাচ্ছে ছিটকে পড়ে থাকা মৃতদেহ। পাশে পড়ে রয়েছে কিছু ওষুধের প্যাকেট।
উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বাইক চালকের পরনে হলুদ পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির পেছনে বাদিকে পিঠের কাছে আবার একটা কোনও লেখাও দেখা যাচ্ছে।
মুখে লঙ্কার ঝাল লাগল রাইমার। কী মনে হল মোবাইল হাতে নিয়ে আবার অভিকে ফোন করল। এবার ফোনটার কোনও কানেকশন পাওয়া গেল না। ব্যাপারটা কী হল! এরকম তো কখনও হয় না অভির ফোনে!
আরও পড়ুন-চালু ‘এক ডাকে অভিষেক’, সরাসরি জানান অভিযোগ-সমস্যা
তক্ষুনি রান্নাঘর থেকে মার আওয়াজ ভেসে এল উঁচু স্বরে, ‘কাল ছোড়দিরা আসবে! ভানুদা আমার হাতের রান্না খাবে বলেছে। অনেকদিন রান্না করি না। কাল আমি রান্না করব। বাজার থেকে ভাল ইলিশমাছ আর পাঁঠার মাংস আনবে। অনেকদিন আনন্দ করিনি, কাল অনেক আনন্দ হবে।’