গঙ্গার হাতযশের নামডাক আছে, গঙ্গার দস্তুরমতো অহংকারও আছে। রীতিমতো অহংকার আছে। এতটুকু এদিক-ওদিক হলেই খরখর করে পাঁচকথা শুনিয়ে দেবে, তেমনই রাগ হলে প্রসূতিকে ফেলে চলে যাবে। নয়তো ইচ্ছে করে অবস্থা খারাপ করে দেবে।
আরও পড়ুন-দ্য আর্চিস
তাই তো তোয়াজ করতেই হয়।
তাই গদগদ গলায় বলতে হয় ,‘‘ক-কুড়ি পান খাবি খা না!’’
‘‘খাব, পাঁচ কুড়ি পান খাব। আগে তোমার নাতিকে পৃথিবীর মাটি দেখাই। কই গো বড়বউমা, একখুরি গরম জল দাও দিকি! হ্যাঁগা, তুমি কাঁদছ কেন! … নাতি হলে ঘড়া বার করতে হবে, বুঝলে গিন্নি, ওর কমে ছাড়ব না!’
এই ছিল একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সমাজের প্রসবকালীন চালচিত্র। ধাইমা বা ধাত্রীমা এসে গরম জল, ন্যাকড়া কানির পোঁটলা, চ্যাচারি, গরম দুধ আর রাজ্যের শেকড়বাকড়, বনজ পাতা মজুত রেখে নিজের-নিজের হাতযশের কেরামতি দেখাতেন গঙ্গামণি, হরিদাসীরা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায়।
এর বাইরে আর আঁতুড়ঘরের বাইরে বুক ঢিপঢিপ নিয়ে উৎকণ্ঠায় কাতর হতেন আত্মজনেরা। কোনও পুরুষ ডাক্তারের সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই। স্যাঁতসেঁতে আধো অন্ধকার আঁতুড়ঘর।
চরক সংহিতা থেকে প্রসব-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠানের ইতিবৃত্ত জানা যায়। তৎকালে কিছু উদ্ভিদ উপকরণ, মশলা, ঘি, ধাতু এবং মন্ত্রপূত কবচের ব্যবহার, আগুন জ্বালানো ও খাদ্য সম্পর্কিত বাচবিচার ইত্যাদি ছিল প্রসব পদ্ধতির এক অবিচ্ছিন্ন দৃশ্যপট।
আরও পড়ুন-মা হওয়া নয় মুখের কথা
সুপ্রাচীন সামাজিক নিয়ম নীতি—
অথর্ব বেদ থেকে জানা যায়, বৈদিক যুগের ভেষজের সঙ্গে ছিল ধর্ম, জাদুবিদ্যা ও সম্মোহনের সংমিশ্রণ।
বৈদিক যুগে উদ্ভিদ উপাদানসমূহের সঙ্গে মন্ত্রেরও সমন্বয় করা হত।
খ্রিস্টপূর্ব ছশো সালের কাছাকাছি সময় সমন্বয় আয়ুর্বেদীয় যুগের প্রারম্ভ। আয়ুর্বেদিক মতে, মানবদেহের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন তিনটি প্রধান মৌলিক উপাদান। বায়ু, পিত্ত ও শ্লেষ্মার সুষম সংমিশ্রণ।
গর্ভাবস্থায় ও প্রসবোত্তর অবস্থাকে দেহের অস্বাভাবিক অবস্থা বলা যায়, যে-কারণে ভারসাম্য ব্যাহত হতে পারে সুষম খাদ্য গ্রহণে তা এড়ানো সম্ভব।
গর্ভাবস্থায় এবং শিশুর জন্মের সঙ্গে জড়িত পালন করা অনুষ্ঠানগুলি হল মানব ইতিহাসের অংশবিশেষ। অনাগত শিশুর প্রতি আশীর্বাদ অনুষ্ঠানটির দ্বারা ইতিহাসের অনেক পিছনে ফিরে যাওয়া যায়। গর্ভবতী নারী যখন গর্ভাবস্থার সাত মাস পূর্ণ করেন, মায়ের জঠরে সন্তানের অবস্থানও যখন নিরাপদ হয়ে ওঠে তখনই সাধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এখন যেভাবে সেগুলো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে সেই সকল রীতি-রেওয়াজ সুদূর প্রাচীনে বহাল থাকলেও তার ধরনগুলি ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। প্রাচীন ভারতবর্ষে গর্ভবতী মাকে ফল এবং এবং অন্যান্য আহার্য সামগ্রী দেওয়া হত। যা কিনা গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধির সহায়ক। সেগুলোই উপহারস্বরূপ দেওয়া হত। যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলায় সাধ এবং হিন্দিতে গোধ ভরাই হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ।
আরও পড়ুন-আরব সাগরে জাহাজ হাই.জ্যাক, উদ্ধারে ভারতীয় নৌবাহিনী
একটা সময় পর্যন্ত প্রায় সব মহিলারই বাড়িতেই প্রসব করানোর রীতি, বাড়ির দক্ষ বয়স্ক মহিলা অথবা দাই নামক ঐতিহ্যগত প্রসব তত্ত্বাবধায়িকা এতে সহায়তা করতেন। ফেলে রাখা সবচেয়ে নিকৃষ্ট ঘর ব্যবহার করা হত। তাকেই আঁতুড়ঘর বলা হত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেকালে মেঝেতে ঘরের বিছানা করে সেখানে কোনওরকম অপদেবতা যেন এসে বিঘ্ন না ঘটায় তার জন্য পুরনো ছুরি, পুরনো জুতো এবং ঝাঁটা রাখা থাকত। সরষের দানাও ঘরের দোরগোড়ায় ছড়িয়ে রাখা হত। দাই ডাকা হলে গর্ভবতী মহিলা অথবা পরিবারের কোনও মহিলা নিরাপদ প্রসবের জন্য তার ওপর নির্ভরতার নিদর্শনস্বরূপ দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে পা ধুয়ে দিত।
খুবই অস্বাস্থ্যকর ও অবৈজ্ঞানিক এই রীতি ছিল। বহুকাল পর্যন্ত এমন ভাবেই প্রসব করানো হত। প্রসূতি-মৃত্যু ঘটত অনেক। কারণ নারীশিক্ষা ছিল তখন একেবারেই অধরা। ডাক্তার, পুরুষ কবিরাজ বা হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের স্পর্শ করে দেখার অধিকার ছিল না। বাড়ির কোনও বয়স্কা মহিলা একগলা ঘোমটা টেনে বন্ধ দরজার ওপার থেকে হয়তো রোগ সম্পর্কিত বা সমস্যা সম্পর্কিত প্রসবকালীন যন্ত্রণা বা অসুবিধার কথা জানাতেন। এবং সেটা মুখে শুনেই ওষুধ দেওয়ার নিয়ম ছিল। যদিও সেটা খুব কমক্ষেত্রে। প্রসবকালীন জটিলতা বা মৃত্যু আসন্ন হলে সেই সবক্ষেত্রে হয়তো রোগীর আত্মীয়স্বজন ওই কবিরাজ, ডাক্তারের শরণাপন্ন হত। তারও আগে অলৌকিক উপায় অবলম্বন করা হত।
আরও পড়ুন-স্টুয়ার্টদের থামিয়ে জয় চায় ইস্টবেঙ্গল
সামাজিক পরিবর্তন—
ধীরে ধীরে সমাজের পরিবর্তন ঘটতে লাগল, নারীশিক্ষার চল হল। শুধু তাই নয়, মহিলা ডাক্তারও মিলল। প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে প্রচুর সমস্যা এর জন্য পোহাতে হয়েছে।
তবু সমস্যা যেমন থাকে তার সমাধানও আসে। বিবর্তনের নিয়ম অনুযায়ী দাইমা বা ধাত্রীমা এই বিষয়টা লোপ পেল।
ডাক্তার দেখালে যে মহিলাদের আব্রু লঙ্ঘিত হয় না এই ভাবনা ক্রমশ জন্ম নিল সমাজে।
সাধভক্ষণ—
নিয়মনীতির পাশাপাশি হবু মাকে মাতৃত্বের আনন্দ দেওয়া এবং অনাগত ছোট্ট শিশুটিকে স্বাগত জানানোর জন্যই আয়োজন করা হয় এই সাধ নামক অনুষ্ঠানের। অনেক সময় একজন গর্ভবতী মা অকারণ বিষাদে ও দুশ্চিন্তায় ভোগে। কেউ কেউ গর্ভাবস্থার পুরো সময়টাই সুষম খাবার গ্রহণ করতে অসমর্থ হন। এতটাই শারীরিক অবস্থার অবনতি থাকে তাঁদের। এইসব ভেবেই সাধের অনুষ্ঠানে নানারকম উপহার ও পছন্দের খাবার দিয়ে হবু মাকে সাজিয়ে দেওয়া হয়।
এতে যা একজন গর্ভবতী মায়ের শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে খুবই হিতকর।
আরও পড়ুন-ধর্ষণে দোষী ইউপির বিজেপি বিধায়কের ২৫ বছরের জেল
সাধ একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও কমবেশি এর প্রচলন রয়েছে। বাঙালি ঐতিহ্য অনুসারে সাধভক্ষণ বা সাধখাওয়া শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে গর্ভবতী নারীর আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী খাবারের উৎসব বা অনুষ্ঠান। এ-অনুষ্ঠানে নানারকম খাবারের পাশাপাশি হাসি-মজার নানারকম রীতি পালিত হয়ে থাকে।
পরিবার-পরিজনের উপস্থিতিতে দুটো ঝুড়ি রেখে হবু মাকে তুলতে বলা হয়। আগে থেকেই একটা ঝুড়ির নিচে প্রদীপ আর অন্য ঝুড়ির নিচে নোড়া রাখা হয়। মনে করা হয়, যদি আসন্নপ্রসবা নারীটি নোড়ার ঝুড়িটি তোলেন তাহলে পুত্রসন্তান লাভ হবে এবং প্রদীপের ঝুড়িটি তুললে কন্যাসন্তান!
একেক পরিবারের গোল পিঠে এবং লম্বা পিঠে দিয়েও এই রীতি সারা হয়। তবে এর পুরোটাই নিছকই মজা।
নানা ভাষা, নানা পরিধান নিয়ে সুবিশাল দেশ এই ভারতবর্ষ। তবে বিবিধের মাঝে মিলনের কিছু রীতি আজও রয়ে গেছে।
এই সাধের অনুষ্ঠানই নানা আঙ্গিকে পালিত হয় ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে।
আরও পড়ুন-অভিষেক মামলায় বিস্ফোরক বিচারপতি
—নানা রাজ্যের সাধের আচার অনুষ্ঠান—
মহারাষ্ট্র
এখানে এটি ‘দোহাল জেভান’ নামে পরিচিত। মানে হল খাদ্য আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি। নামটা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, গর্ভবতী মহিলার খাদ্যসংক্রান্ত বিষয় থেকেই এই রীতি এসেছে। ভাত এবং মিষ্টি, চাপাটির মতো পুষ্টিকর খাদ্যগুলো এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। গর্ভবতী মাকে নানারকম খাবার দেওয়া হয়।
কেরল
কেরলে এই অনুষ্ঠানটির নাম ‘সীমান্ধান’। অন্তঃসত্ত্বা হবু মাকে আবশ্যিকভাবে পবিত্র ডুব দেওয়াতে অংশ নেওয়ানো হয়। আগত শিশুর বুদ্ধিমত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার লক্ষ্যেই এই অনুষ্ঠান পালিত হয়।
আগত শিশুটির উদ্দেশ্যে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে এই অনুষ্ঠানটিতে নানারকম পুরোহিত সমাবেশে মন্ত্র উচ্চারণ করা হয় এবং প্রার্থনা করা হয় হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক মহলে কোণঠাসা, এবার ইরানে বিনা ভিসায় প্রবেশাধিকার ভারত-সহ ৩৩ দেশের
তামিলনাড়ু
‘ভালাই কাপ্পু’ হিসেবে পরিচিত এই অনুষ্ঠান। হবু মাকে লাল এবং সবুজ চুড়ি পরিয়ে এবং একটি কালো শাড়ি দিয়ে সাজিয়ে অপবিত্র কোনও কিছু থেকে রক্ষা করা হয়। চার থেকে পাঁচটা মন্দির পরিদর্শনের সঙ্গে আগত শিশুটির এবং মায়ের শারীরিক সুস্থতা কামনা করা হয়।
পাঞ্জাব
‘গোধ ভরাই’ অনুষ্ঠানটি সাধারণত পাঞ্জাবে সাধের অনুষ্ঠান নামে পরিচিত। গর্ভাবস্থার সপ্তম মাসে আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে পালন করা হয় এটি। শাশুড়ি মায়ের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। যেখানে তিনি প্রার্থনা করার পর এক আঁচল-ভর্তি ফল এবং নারকেল তাঁর কন্যাসমান বউমার কোলে রাখেন এবং বউমার পছন্দের বিভিন্ন খাবার খাইয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করে নতুন শাড়ি বা তাঁর পছন্দের জিনিসপত্র উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। পাঞ্জাবে গোধ ভরাই একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। সমস্ত মহিলার উপস্থিতিতে নাচ-গানের মাধ্যমে প্রসূতিকে আনন্দ দেওয়ার ব্যবস্থা
করা হয়।
পশ্চিমবাংলা
বাংলার ‘সাধ’ নামে পরিচিত এই অনুষ্ঠানটিতে নানান সুস্বাদু খাবারের উপর জোর দেওয়া হয়। অঞ্চলভেদে একবার পাঁচ মাসে পঞ্চামৃত, সাত মাসে এবং ন’ মাসে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। গর্ভবতী নারীটির যা যা পছন্দের খাবার সব বাড়িতে তৈরি করা হয়। মহিলা আত্মীয়-পরিজনদের উপস্থিতিতে নানান হাসি মজা নিয়ে এই অনুষ্ঠান হয়।