প্রশংসা ও অভিযোগ, দুটি প্রক্রিয়া কার্যত বিপ্রতীপ। কিন্তু অভিঘাত প্রায় অভিন্ন। যদিও অভিঘাতের অভিমুখ সদা আলাদা। একটির অভিঘাত ইতিবাচক, অন্যটির নেতিবাচক।
আর এ-জন্যই দুটিই যদি একই বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত হয়, তা হলে গোলকধাঁধায় পড়তে হয়। বুঝে ওঠা দায় হয়, কোনটা আসল।
আসল-নকলের এই খেলা খেলতে প্রবল পরিমাণে অভ্যস্ত কেন্দ্রের বর্তমান গেরুয়া সরকার। তাই, তাদের তথ্য-উপাত্তভিত্তিক প্রশংসা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় অনৃত বচনের নিন্দায় নির্বাসিত হয়।
আরও পড়ুন-ডি’কক-ডুসেন ঝড় হার নিউজিল্যান্ডের
সাম্প্রতিক কালে এমনটাই দেখা গেল বাংলার রেশন নিয়ে।
গত অগাস্ট মাসে পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষ মোদি-সরকারের খাদ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের সঙ্গে একটি বৈঠকে মিলিত হন। সেই বৈঠকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজ্যের রেশন ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেন। কেবল মৌখিক প্রশংসাতেই থেমে থাকেননি কেন্দ্রের মন্ত্রিমশাই। তিনি রাজ্য সরকারকে রীতিমতো চিঠি দিয়ে জানান, বণ্টন ব্যবস্থাকে স্বয়ংক্রিয় করার যে উদ্যোগ রাজ্য সরকার নিয়েছে তা দৃষ্টান্তমূলক। মূলত দুটি বিষয় ওই চিঠিতে প্রশংসিত হয়েছিল। (১) রেশন বণ্টনের প্রক্রিয়াকে আরও মসৃণ করা। এবং (২) রেশন বণ্টন সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য প্রতি মাসে নিয়ম করে দিল্লিকে জানানো। বাংলার রেশন সংক্রান্ত পোর্টাল ‘অন্নবিতরণ’ দুটি ক্ষেত্রেই দারুণ কাজ করেছে বলে জানিয়েছিল কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক।
অথচ কাঁথির খোকাবাবু গদ্দার অধিকারী থেকে শুরু করে ভারতের জোকার পার্টির বঙ্গ শাখার কর্ণধার অবলাকান্ত মজুমদার, সবাই বাংলার রেশন ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অব্যবস্থা দেখতে পান এবং তার সমালোচনায় মুখর হন।
আরও পড়ুন-মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করার মতো প্রতিভা
জগাই-মাধাই-গদাই রামধনু জোটের আর এক নেতা, মুর্শিদাবাদের কুর্সি সামলাতে সামলাতে যিনি প্রায় ওষ্ঠাগত প্রাণ, ধীর স্থির হতে ভুলে গেছেন যিনি, তিনিও, জানি না চশমার পাওয়ার বিভ্রাটের কারণেই কি না, কিছুতেই খুঁজে পান না, বঙ্গে রেশন দুর্নীতির আদি পর্বটাকে।
২০০৭। রাজ্যে তখন বাম জমানা। আলিমুদ্দিন-শাসিত বঙ্গে হার্মাদদের সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, রেশন গ্রাহকদের গমের বদলে আটা দেওয়া হবে। রাজ্যের খাদ্য দফতর চালাত তখন ফরোয়ার্ড ব্লক। সিপিএম-এর এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রের কাছ থেকে তখন এই সংক্রান্ত বিশেষ অনুমতি নিয়ে আসা হয়। যাদের রাইস মিলে এর আগে ধান ভানিয়ে চাল উৎপাদন করে রেশনের জন্য সরবরাহ করা হত তাদের অনেকেই এই নয়া সিদ্ধান্তে দারুণ খুশি হয়ে আটাকল চালু করে এবং গম থেকে আটা উৎপাদন করে রেশন দোকানে সরবরাহের বরাতও পেয়ে যায়। তখন শুরু হয় রেশন দুর্নীতি। এফসিআই গুদাম থেকে সরবরাহ করা গম যেত আটাকলগুলিতে। আর সেই গমের একটা অংশ পাচার করে দেওয়া হত খোলা বাজারে।
আরও পড়ুন-শুভেন্দুর সভায় নিষেধাজ্ঞা হাইকোর্টের
আর কী আশ্চর্য! এই ঐতিহাসিক সত্য পুরোপুরি চেপে যাচ্ছেন অবলাকান্ত এবং লোডশেডিং অধিকারীর জুটি। বিষয়টি অনালোচিত থাকছে মুর্শিদাবাদি নবাবের বক্তব্যে। আর, রেশন দুর্নীতি নিয়ে রাস্তায় স্লোগান দিয়ে বেড়াচ্ছে সেই বামেরা, যারা এই রেশন দুর্নীতির আদি পান্ডা। সত্যি অবাক করা কাণ্ড বটে!
কেন্দ্রের এই প্রশংসিত বিষয়ে অভিযোগ তোলার বদমায়েশি যে এবারই প্রথম রেশন-কাণ্ডকে ঘিরে ঘটল, তা কিন্তু নয়। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। যেমন ঘটেছিল মিড-ডে মিল-কাণ্ডে।
জয়েন্ট রিভিউ কমিশন এবং পিএম পোষণ বিভাগ। দুটোই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সংস্থা। জয়েন্ট রিভিউ কমিশন দাবি করেছিল, রাজ্যে মিড-ডে মিল প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি, ভয়ানক চুরি হয়েছে। কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা নয়ছয় করা হয়েছে ওই খাতে— এমনটাই অভিযোগ ছিল তাদের। সেই সঙ্গে খাবারের মান নিয়েও প্রশ্ন তোলে তারা।
আরও পড়ুন-ইজরায়েলি হানায় নিহত পরিবারের ১৯ জন সদস্য, ১৫ দিনে মৃত্যু ৩৪৫০ শিশুর
সেসব অভিযোগের ভিত্তিতে পিএম পোষণ বিভাগ পুরে উল্টো কথা বলল। রাজ্যের মিড-ডে মিল প্রকল্পের ভূয়সী প্রশংসা করে তারা। শুধু তাই নয়, ২০২৩-’২৪ শিক্ষাবর্ষে মিড-ডে মিলের জন্য দু হাজার কোটি টাকার অনুমোদনও দেয় তারা। এর প্রেক্ষিতে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার— ‘জয়েন্ট রিভিউ কমিশন রাজ্যের মিড-ডে মিল নিয়ে যে রিপোর্ট দিয়েছিল সেটা পুরোপুরি রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য। রিভিউ কমিশনের রিপোর্ট ছিল পুরো ভিত্তিহীন।’
এসব যখন বাস্তব, তখন ভুয়ো দুর্নীতির ভূরি ভূরি খবর পরিবেশন করে মিডিয়া ট্রায়াল চলছে চারিদিকে। লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল কংগ্রেসকে ধমকানো চমকানোর চেষ্টা চলছে প্রবলভাবে। উদ্দেশ্য একটাই। জনমানসে বিভ্রান্তি ছড়ানো।
এ-কাজে বোধহয় এবারও সফল হবে না ওরা। বিষাদ বাজারেই ঠাঁই হবে ওদের। দেওয়াল লিখন স্পষ্ট।