হেড নেক ক্যানসার সচেতনতা

আজকের আলোচ্য শুধু রোগ নয়, সচেতনতা বৃদ্ধিও। কারণ হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারে জীবনহানি হওয়ার কারণ সচেতনতার অভাব। উপসর্গ বুঝে ঠিক সময়ে এলে রোগী হতে পারেন ৯০% সুস্থ। কীভাবে, জানালেন মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইএনটি হেড অ্যান্ড নেক সার্জারি বিভাগের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট ডাঃ গৌতম বিশ্বাস। লিখেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

সচেতনতার অভাব
মুর্শিদাবাদের যে আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো সেই অনুযায়ী দেখা যায় রোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে বলব হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা একবারেই নেই। এটা সর্বত্রই। ক্যানসার একটি বড় বিষয় যাতে জীবনহানির আশঙ্কা থেকেই যায়। তা সত্ত্বেও মানুষ এখনও অজ্ঞানতার অন্ধকারে। হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারের কমন আমাদের জানা তিনটে ধরন হয়— শ্বাসযন্ত্রের ক্যানসার,খাদ্যনালির ক্যানসার এবং ওরাল ক্যাভিটির ক্যানসার। এছাড়াও আরও রয়েছে। দেখা যাচ্ছে ওখানে হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারে আক্রান্তরা যখন আসছে তখন তাদের তৃতীয় বা চতুর্থ স্টেজ। প্রথম, দ্বিতীয় স্টেজে আসছে না। এতে জীবনহানির আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে। কারণ ল্যারিঞ্জিয়াস ক্যানসার বা থাইরয়েড ক্যানসার ছাড়া বাদবাকি হেড, নেক রিজিওনের ক্যানসারগুলো থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা একটু কঠিন, এগুলো খুব দ্রুত ছড়ায়। তার মধ্যে এরা যদি তৃতীয় এবং চতুর্থ স্টেজ হয়ে যাওয়ার পর আসে তাহলে কী করে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলা সম্ভব!

আরও পড়ুন-রাজধানীতে ফের রেফ্রিজারেটর থেকে উদ্ধার তরুণীর দেহ

দেরি কেন
ধরা যাক মুখে একটা ঘা হয়েছে, সেটা নিয়েই হয়তো লোকাল হাতুড়ে ডাক্তারকে দেখাচ্ছে বা কোনও বিকল্প চিকিৎসায় চলে যাচ্ছে। যেমন- হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ ইত্যাদি। অল্টারনেটিভ মেডিসিন ভাল কিন্তু সব সময় সব রোগে বিশেষ করে ক্যানসারের মতো রোগে বিকল্প চিকিৎসা সবসময় কাজ করছে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাস্তবটাকে অস্বীকার করে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা বা সার্জারিতে ঢুকতে চাইছে না। ফলস্বরূপ পরিণতি ঘটছে ভয়ঙ্কর।
যখন রোগী নিজে বুঝতে পারছে আর উপায় নেই তখন আসছে কিন্তু কিছু করার থাকছে না। তাই হেড, নেক ক্যানসারের সবচেয়ে জরুরি হল সচেতনতা বৃদ্ধি। এই রোগীই আর্লি স্টেজে এলে তাকে হয়তো সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা যেত। যেমন শ্বাসযন্ত্রের যে ক্যানসার প্রথম স্টেজে রোগী এলে সার্জারি করতে হয় না, শুধু রেডিওথেরাপিতেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা খরচসাপেক্ষ, সার্জারিতে ভীতি এবং সচেতনতার অভাবে শুধু দেরিতে আসার কারণে দেখা যাচ্ছে এই ধরনের ক্যানসার ছড়িয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন-তথ্যচিত্রর পরই বিবিসি-র দিল্লি ও মুম্বইয়ের দফতরে আয়কর হানা

ওখানকার চিকিৎসা পরিকাঠামো
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মোটামুটি পরিকাঠামো রয়েছে ক্যানসার চিকিৎসার। কিন্তু এই হাসপাতালে রেডিওথেরাপি বিভাগ এতদিন ছিল না। রোগীকে কলকাতায় পাঠানো হত। তাই চিকিৎসা কিছুটা সময়সাপেক্ষ হয়ে যেত। কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যে এখানে একটা নতুন রিজিওনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট খুলতে চলেছে। রেডিওথেরাপি বিভাগও শুরু হবে। ফলে তখন চিকিৎসা আরও সহজ হবে।
কীভাবে বুঝবেন
মুখের ঘা মানেই ক্যানসার নয়। কিন্তু মুখের ভিতরে কোনও ঘা হলেই সবার আগে অন্তত কোনও জেনারেল ফিজিশিয়ানের কাছে যেতে হবে।
অথবা অন্য কোনও চিকিৎসা করছে কিন্তু ঘা সারছে না, রয়ে যাচ্ছে। তাহলে দেরি করা যাবে না।
গলায় কোনও গ্ল্যান্ড বা লিম্ফনোড ফুলে গেছে অথচ ব্যথা নেই, এটা একটা বড় লক্ষণ। কারণ আমাদের গলায় গ্ল্যান্ড ফোলার কিছু কারণ থাকে যেমন ব্যাকটিরিয়াল ইনফেকশন, ভাইরাল ইনফেকশন। এই দুটো ক্ষেত্রেই ব্যথা হবে। কিন্তু গ্ল্যান্ড ফুলে রয়েছে, ধরলে খুব শক্ত মনে হচ্ছে এবং ব্যথাহীন, তাহলেই বিপদসংকেত।

আরও পড়ুন-তমলুক সাংগঠনিক জেলার একাধিক পদাধিকারীর নাম ঘোষণা করল তৃণমূল, দেখে নিন তালিকা

যাঁরা দীর্ঘদিন ধূমপান করছেন, মদ্যপান করেন বা চিউইং টোব্যাকো জাতীয় জিনিস যা মুখে পুরে রেখে দেন, নেশা করেন, জর্দা, তামাক, দোক্তা ইত্যাদি খান রোজ, তাঁদের ক্ষেত্রে মুখে ঘা, হঠাৎ স্বরভঙ্গ মানে একেবারে ভয়েস ক্র্যাক করে গেছে। তাহলে দেরি না করে বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে।
ল্যারিংসের ক্যানসারের প্রথম উপসর্গ হল গলা বসে যাওয়া। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স, যাঁরা ধূমপান করেন এবং স্থায়ীভাবে গলা বসে গেছে, ফ্যাসফেসে হয়ে গেছে। তাঁকে অবশ্যই ইএনটি বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে।
খুব সিভিয়র হলে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করবে। রোগী খেতে পারবে না। গ্ল্যান্ড ফুলতে থাকবে। কিছু খেলেই রক্ত পড়তে থাকবে।
চিকিৎসা কী
যিনি হয়তো নিশ্বাসই নিতে পারছেন না তখন রোগীকে ইনিশিয়াল স্টেজেই ট্র্যাকিওস্টমি অপারেশন করে শ্বাসযন্ত্রটা তৈরি করতে হয়। ট্র্যাকিয়ার মধ্যে ফুটো করে একটা অল্টারনেটিভ শ্বাসযন্ত্র তৈরি করতে হয়। বাইরে থেকে একটা টিউব পরিয়ে দেওয়া হয় সেখান থেকে রোগী শ্বাস নেয়।
ক্যানসারের চিকিৎসা মূলত তিনরকম রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি এবং সার্জারি। এবার নির্ভর করবে কোন অংশে হচ্ছে। যেমন আমাদের যে শ্বাসযন্ত্রের ক্যানসারে আর্লি অর্থাৎ প্রথম, দ্বিতীয় স্টেজে ধরা পড়লে তখন রেডিওথেরাপি দিলেই রোগীর ৯০% রিকভারি হয়ে যায়। সার্জারি করতে হয় না।
বাদবাকি হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারের আরও যেসব ধরন রয়েছে যেমন জিভ, মুখের ভিতরে, গালে, খাদ্যনালির উপরে, টনসিলে ইত্যাদি জায়গায় ক্যানসার হলে সার্জারিই হল প্রথম চিকিৎসা।

আরও পড়ুন-বাংলাদেশ-আদানি চুক্তি: প্রশ্ন তুলে চিঠি জহরের

দেরিতে ধরা পড়লে যেটা হয়, ধরা যাক জিভে টিউমার হয়েছে, সেটা অনেক বেড়ে যায়। তখন চারপাশ থেকে অনেকটা বাদ দিতে হয়। কিন্তু দ্রুত ডায়াগনোসিস হলে টিউমারের লেন্থ যদি ছোট হয়, সার্জারিতে অনেকটা বাদ দিতে হয় না। গালের ভিতরে হলেও বিষয়টা একই।
সার্জারির ফলে বাদ যাওয়া অংশে যে গ্যাপ তৈরি হয় সেটা ফিল আপ করতে নানান ফ্ল্যাপ টেকনিক রয়েছে।
বুক, পিঠের থেকে মাংস নিয়ে বসিয়েও রিকনস্ট্রাকশন করা হয়। দাঁতের পাটির নিচের অংশ বাদ গেলে ওখানে পায়ের থেকে হাড় কেটে বসানো হয়। এই সার্জারিগুলো খুব কঠিন, সময়সাপেক্ষ, খরচসাপেক্ষ। তাই যত দ্রুত ডায়াগনোসিস হবে তত খরচ এবং সময় দুই কমবে। জীবনহানিও কম হবে।
কারণ তৃতীয়, চতুর্থ স্টেজে সার্জারি অনেক বেশি ক্রিটিকাল এবং খুব সময়সাপেক্ষ হয়। একটি সার্জারিতে সময় লাগে দশ থেকে বারো ঘণ্টা। যত বেশি সময়, অ্যানাস্থেশিয়াও তত বেশি, যেটা রোগীর জন্য খুব ভাল না। সঙ্গে রোগীরও নেওয়ার ক্ষমতা, শারীরিক ধকলও আছে।
পরবর্তী সচেতনতা

আরও পড়ুন-রেকর্ড অর্থে আরসিবিতে স্মৃতি, মুম্বইয়ে হরমনপ্রীত

বেশি বেড়ে গেলে পুরো ক্যানসার বাদ দেওয়া সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে কিছুটা বাদ দিয়ে এবং বাকিটা রেডিওথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়। রোগী রেডিওথেরাপি নিতে না পারলে সেক্ষেত্রে কেমোথেরাপি দিতে হয়।
তাই তিন-চারমাস অন্তর ফলো আপ করতে হবে। যেখানে টিউমার বা ঘা হয়েছিল সেখানে আবার কোনও ক্ষত তৈরি হচ্ছে কি না বা কোনও ঘা হচ্ছে কি না লক্ষ রাখতে হবে। কোথাও কোনও গ্ল্যান্ড ফুলছে কি না তাও দেখতে হবে।

Latest article