দেব সেনাপতি কার্তিকের ইতিবৃত্ত

মা-দুর্গার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাঙালিরা সমবেতভাবে যতটা হইচই করে, ‘কার্তিকের পুজো’ নিয়ে সেরকম কোনও হইচই সর্বত্র হয় না। বর্তমানে ‘কার্তিক ঠাকুর'ও আমাদের ‘লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’। রাঢ় বাংলার বিভিন্ন গ্রামে এমনকী অজয়, দামোদর নদের মধ্যভূমি এলাকায় কার্তিকের পুজো নিয়ে আজও মানুষের উৎসাহের শেষ নেই। গঙ্গাপারের জেলাগুলোতেও কার্তিকের পুজো হয়। এই পুজোকে কেন্দ্র করে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, দুই বর্ধমানের বেশকিছু গ্রামে মেলাও বসে। লিখছেন রাধামাধব মণ্ডল

Must read

ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বলেন, একদা ‘মঙ্গলকোটের প্রত্নক্ষেত্র’ থেকে যে ‘কার্তিক মূর্তির অস্তিত্ব’ পাওয়া গিয়েছিল সেটা আদতে ‘গুপ্তযুগের নির্দশন’। তারও বহু আগে থেকেই বঙ্গদেশে চালু ছিল ‘দেবসেনাপতির আরাধনা’। ‘দেবসেনাপতি কার্তিকের উৎস’ এবং ‘বঙ্গদেশে কার্তিকের আরাধনা’ — দুটোই ‘লোকসংস্কৃতির ইতিহাসের’ বেশ জটিল তথ্যের সন্ধান দেয়।

আরও পড়ুন-গুজরাত ভোটে এবার দুঃস্বপ্ন তাড়া করছে জঞ্জাল পার্টিকে

কার্তিকের জন্মকথা
হর-পার্বতীর আদরের ছোট পুত্র কার্তিক। কোনও পুরাণে কার্তিককে বড় এবং গণেশকে ছোট পুত্র বলা হয়েছে। ‘তারকাসুরের অত্যাচার’ থেকে বাঁচার জন্য দেবতারা একজন শৌর্য-বীর্যসম্পন্ন দেব-সেনাপতির খোঁজ করেন। সকলে মিলে ‘মহাদেবের শরণাপন্ন’ হলে তপস্যা ভঙ্গ করে একটা পুত্র তিনি দেবতাদের উপহার দেন। এতে ‘শিব’ সম্মত হয়ে পুত্রলাভের নিমিত্ত পার্বতীর কাছে যান। সে সময় ‘মহাদেবের তেজ’ গিয়ে পড়ল পৃথিবীতে। ‘বসুন্ধরা’ সেই তেজ সহ্য করতে না পেরে তা ‘অগ্নিতে’ নিক্ষেপ করলেন। ‘অগ্নি’ সেই মহাতেজ ‘শরবনে’ নিক্ষেপ করেন। সেই শরবনেই সুন্দর সন্তানের জন্ম হয়। ‘ছয়জন কৃত্তিকা’ অর্থাৎ ‘অগ্নির ছয় পত্নী’ সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁরা শিশুসন্তানটিকে বাড়ি নিয়ে যান এবং স্নেহভরে তাঁর নাম রাখেন ‘কার্তিক’। তাঁকে নিয়ে রয়েছে আরও নানা পুরাণ গাথা।

আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে দারোগার উপস্থিতিতেই থানা থেকে চুরি!

কার্তিকের বাহন
ময়ূর ভারতের জাতীয় পাখিও। অসাধারণ কর্মতৎপর এই পাখি খুবই সুন্দর। সৈনিক পুরুষের নানা গুণ ময়ূরকে বাহন করতে সাহায্য করেছে। ময়ূর খুব সামান্যই নিদ্রা যায়। সর্বদা সতর্ক থাকে। সে আলস্যহীন। ময়ূরের স্বজনপ্রীতি লক্ষণীয়। সৈনিক পুরুষ ময়ূরের মতো অনলস, কর্মকুশল আর লোকপ্রিয় হবেন। আর এই ধারণা থেকেই ময়ূর বাহন কার্তিকের।
কার্তিক বৈদিক দেবতা নন
কার্তিকেয় বা কার্তিক হিন্দু ‘যুদ্ধদেবতা’। তিনি ‘শিব ও দুর্গার সন্তান’। কার্তিক ‘বৈদিক দেবতা’ নন; তিনি ‘পৌরাণিক দেবতা’। প্রাচীন ভারতে সর্বত্র কার্তিক পুজো প্রচলিত ছিল। ‘পুরাণ অনুসারে’ ‘হলুদবর্ণের কার্তিকের ছটি মাথা’। তাই তাঁর অপর নাম ‘ষড়ানন’। ‘যুদ্ধের দেবতা’ বলে নাকি তাঁর ‘ছটি মাথা’। চারিদিক থেকে তাঁর লক্ষ্য অবিচল। পাঁচটি ইন্দ্রিয় অর্থাৎ চোখ, কান, নাক, জিভ আর ত্বক ছাড়াও একাগ্র মন দিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন। তাঁর হাতে থাকে ‘বর্শা-তীর-ধনুক’। আবার কারও মতে ‘মানব জীবনের ষড়রিপু’— ‘কাম’ বা কামনা, ‘ক্রোধ’ বা রাগ, ‘লোভ’ বা লালসা, ‘মদ’ বা অহং, ‘মোহ’ বা আবেগ, ‘মাৎসর্য্য’ বা ঈর্ষা’কে সংবরণ করে দেব সেনাপতি কার্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে সদা সজাগ থাকেন। এই ‘ষড়রিপু’ মানুষের জীবনের অগ্রগতির বাধা তাই জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করতে গেলেও কার্তিকের মতো সজাগ, সচেতন থাকতে হবে।

আরও পড়ুন-১০০ দিনের কাজ হারানো শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর, ৪২ দফতরে কাজ পেলেন ৩০ লক্ষ মানুষ

দেশে বিদেশে কার্তিক
কার্তিক হলেন ‘আকুমার ব্রহ্মচারী’। কোনও কোনও পুরাণ মতে ‘কার্তিকের পত্নী’ হলেন ইন্দ্রের কন্যা ‘লক্ষ্মীরূপিণী ষষ্ঠী’। ‘দক্ষিণ ভারতে’ কার্তিকের পুজো অধিক জনপ্রিয়। ‘তামিল’ আর ‘মালয়ালম ভাষায়’ কার্তিক ‘মুরুগান’ বা ‘মায়ূরী কন্দসামী’ নামে এবং ‘কন্নড় আর তেলুগু ভাষায়’ তিনি ‘সুব্রহ্মণ্যম’ নামে পরিচিত। তামিল বিশ্বাস অনুযায়ী ‘মুরুগান’ তামিলদেশের (তামিলনাড়ু) রক্ষাকর্তা। তামিলনাড়ুর ৬টি কার্তিক মন্দির খুব পবিত্র। ‘স্বামীমালাই’, ‘পালানী’, ‘থিরুচেন্দুর’, ‘থিরুপ্পারামকুমারাম’, ‘থিরুথানি’,ও ‘পাঝামুদিরচোলাই মুরগান মন্দির’ ‘দক্ষিণ ভারত ছাড়া ‘সিঙ্গাপুর’, ‘শ্রীলঙ্কা’, ‘মালয়েশিয়া’ আর ‘মরিশাস’— যেখানে তামিল জাতিগোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে সেখানেই ‘মুরুগানের পুজো’ চালু রয়েছে। ‘শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাংশে’ রয়েছে কার্তিকের ‘কথারাগম’ মন্দির। শিশু বড় না হওয়া অব্দি তাঁদের বিপদ থেকে রক্ষা করেন কার্তিক৷ তাঁর কৃপা পেলে ‘পুত্রলাভ’, ‘ধনলাভ’ হয়৷ সেজন্য বিয়ে হয়েছে কিন্তু এখনও সন্তান আসেনি এমন দম্পতির বাড়ির সামনে কার্তিক ঠাকুরের মূর্তি ফেলা হয় আজও।

আরও পড়ুন-দিলীপ ঘোষের গ্রেফতার চাই

কাটোয়ার কার্তিক
পূর্ব বর্ধমানের ‘কাটোয়া’র গঙ্গাতীরে বর্তমান ‘হরিসভাপাড়ার’ আগের নাম ছিল ‘চুনুরিপাড়া’। ইতিহাসসূত্রে জানা যায়, সেই পাড়াতেই একসময় গড়ে উঠেছিল ‘বারবনিতাদের পল্লি’। তাঁদের আশ্রয়দাতা ছিলেন সে সময়কার ‘জমিদার’, ‘বাবু’ আর জলপথের ‘বণিক’রা। ‘চুনুরিপাড়ার বারবনিতারা’ ‘মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার আশায়’ সে যুগে শুরু করছিলেন ‘ন্যাংটো কার্তিকের পুজো’। ‘সন্তানের আশায়’ বঙ্গদেশে এখনও ‘শিশুকার্তিকের পুজো’ করার রীতি চালু রয়েছে ঘরে ঘরে। কাটোয়ার কার্তিক পুজোকে কেন্দ্র করেই জমিদার, বণিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। কালক্রমে সেই ‘কার্তিক লড়াই’।
হালিশহরের কার্তিক
হালিশহরের ‘জ্যাংড়া কার্তিক’ আর ‘ধুমো কার্তিক’ পুজোও খুব বিখ্যাত। এভাবেই ‘যুদ্ধ আর সন্তান উৎপাদন’— দুইয়ের অনুষঙ্গেই কার্তিককে স্মরণ করে বাঙালি।

আরও পড়ুন-দিলীপ ঘোষের গ্রেফতার চাই

বাঁকুড়ার কার্তিক পুজো
‘কালী-কার্তিকের দেশ’ বলে পরিচিত বাঁকুড়ার সোনামুখী। এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে কয়েকশো কার্তিক পুজো হয়। বেশ কয়েকটি রেজিস্টার্ড কার্তিক পুজো কমিটি সোনামুখী পুরসভা থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত। তিনদিন ধরে এই পুজোকে ঘিরে ব্যাপক উন্মাদনা থাকে। পুজোর পাশাপাশি কার্তিক ভাসানকে কেন্দ্র করে শহর কার্নিভালের চেহারা নেয়। বিভিন্ন নামের বিভিন্ন কার্তিক রয়েছে।
কলকাতার ও হুগলির কার্তিক পুজো
কলকাতাতেও কার্তিকের মন্দির রয়েছে। দক্ষিণ ও উত্তর কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় কার্তিক পুজো হয়। কলেজ স্ট্রিট এলাকাতেও কার্তিক পুজো হয়। ‘হুগলি জেলার চুঁচুড়া-বাঁশবেড়িয়া’, অঞ্চলে হিন্দুদের ঘরে ঘরে কার্তিকের পুজো হয়।

আরও পড়ুন-ঝাড়গ্রাম যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী

বৌদ্ধধর্মে কার্তিক পুজো
‘বাংলার লোকসংস্কৃতি’ এবং ‘লৌকিক দেবদেবী’দের উপরে যেমন বৌদ্ধধর্মের প্রভাব লক্ষণীয়, ঠিক তেমনই উল্টোটাও হয়েছে। বাংলাদেশ তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন পুজো-অর্চনা লোকসংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত। ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার, পুজো-পার্বণ, লোকাচারসমূহ সাধারণত ‘পুরনো আস্তর’ নামে খ্যাত।
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগ থেকে বড়ুয়া বৌদ্ধদের আর্যধর্ম, সভ্যতা সংস্কৃতি, ভাষা ও লিপি প্রচারিত হয়। বাঙালি বড়ুয়া আর পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের মতে, প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন কুসংস্কার, লোকবিশ্বাস, ‘লোক সংস্কৃতি ও আচার অনুষ্ঠানসমূহের’ প্রথম গোড়াপত্তন হয়।
‘‘আশ্বিনে রান্না, কার্তিকে খায়
যে বর মাগে সে বর পায়।’’
‘যে বর মাগে’ অর্থাৎ প্রার্থনা করে তা পূরণের আশায় মানুষ এই ‘কার্তিক পুজো’ বা ‘কার্তিকের পান্তা ভাত রান্না’ করে। এই পুজো বাঙালি বৌদ্ধ সমাজে বহুলভাবে সমাদৃত। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বড়ুয়া বৌদ্ধরা এই কার্তিক পুজো বা ‘কার্তিকের ভাত রান্না’ করে।

আরও পড়ুন-প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক বই প্রকাশ

জমিদারদের কার্তিক পুজো
একটি প্রাচীন কার্তিক পুজো হয় ‘পশ্চিম বর্ধমান জেলার গৌরবাজারের পাল পরিবারে’। ১৬৬ বছর ধরে সেই পুজো হয়ে আসছে বলে অনুমান। সেই পুজোর বিশেষত্ব হল তিনটি কার্তিক— বড় কার্তিক, মেজো কার্তিক, ছোট কার্তিক। একই ঠাকুরের তিনটি মূর্তি কেন? জানা গেছে আনুমানিক ১৮৫৩ সাল নাগাদ জমিদার জয়নারায়ণ পাল, শ্যাম পাল, লক্ষ্মীনারায়ণ পাল ছিলেন নিঃসন্তান। অনেক উপায় অবলম্বন করেও সুরাহা হয়নি। এক রাতে স্বপ্ন আদেশে জয়নারায়ণ পাল দেখেন যে নিঃস্বার্থভাবে তাই কার্তিক পুজো করতে হবে। তবেই তাঁদের শূন্য কোল আলোকিত হবে। সেই তিন ভাই এক অভিনব মন্দির তৈরি করে তিনটি কার্তিক পুজো শুরু করেন। আনুমানিক ১৮৫৭ সালে লক্ষ্মীনারায়ণ পালের এক পুত্রসন্তান লাভ হয়, নাম ধ্বজাধারী পাল। এবং অপর দুই ভাইয়ের একটি করে কন্যাসন্তান হয়। বীরভূম ও নদিয়াতে জমিদারদেরও কার্তিক পুজো রয়েছে।

Latest article