স্মরণে-শ্রদ্ধায় সন্দীপ দত্ত

লিটল ম্যাগাজিনের নীরব সাধক ছিলেন সন্দীপ দত্ত। আজীবন ছিলেন নির্মোহ, নিরহংকারী। প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মানুষটি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৮-এর ২৩ জুন, প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন 'কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র'র। তাঁকে স্মরণ করলেন কয়েকজন বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, সম্পাদক, গবেষক। শুনলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

১৯৫১ সালে কলকাতার টেমার লেনে জন্ম সন্দীপ দত্তর। সাহিত্যে অনুরাগ ছাত্রজীবন থেকেই। কলেজে পড়ার সময় সম্পাদনা করেন ‘পত্রপুট’ পত্রিকা। পরে সম্পাদনা করেন আরও দুটি পত্রিকা— ‘হার্দ্য’ এবং ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’। জানা যায়, একদিন জাতীয় গ্রন্থাগারের মেঝেতে অবহেলায় অজস্র লিটল ম্যাগাজিন পড়ে থাকতে দেখে কষ্ট পেয়েছিলেন। জেনেছিলেন, ওগুলো রয়েছে বাতিলের খাতায়। সেই মুহূর্তে তিনি লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৮-এর ২৩ জুন নিজের টেমার লেনের দুটি ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’। এখন সেখানে প্রায় ৮০ হাজার লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষিত। আশ্রয় হয়ে উঠেছে বহু লেখক, গবেষকের। একটা সময় কবিতা লিখতেন। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কোলাজ’। পরে বেরিয়েছে আরও তিনটি কাব্যগ্রন্থ। তবে লাইব্রেরির জন্য নিজের মৌলিক লেখায় খুব বেশি সময় দিতে পারেননি। ১৫ মার্চ চলে গেলেন না-ফেরার দেশে।

আরও পড়ুন-ফিরছেন রোহিত, আজ জিতলেই সিরিজ ভারতের

উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্যের ভগীরথ
চিরঞ্জীব শূর
সদ্যপ্রয়াত সন্দীপ দত্ত একটি ব্যতিক্রমী পাঠাগারের সংগঠকমাত্র নন, বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিক উন্নয়নের নিঃশব্দ রূপকার— সেইসূত্রে উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্যের ভগীরথ বললে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এই বাংলায় যেসব সারস্বত সংগঠন গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র অন্যতম। ৪৪ বছর ধরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা এই পাঠাগারে এখন কমবেশি ৮০ হাজার লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষিত আছে। লিটল ম্যাগাজিন যে চলমান বাংলা সাহিত্যের সৃজন-মনন ধারার ধারক-বাহক তা সন্দীপ দত্তই প্রতিষ্ঠা করেছেন। লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখাপত্র যে গবেষণায় মূল্য সংযোজন করতে পারে, সেই আবিষ্কারও তিনিই করেছেন। আমরা বলি, সন্দীপ দত্ত লিটল ম্যাগাজিনকে অমরত্ব দিয়েছেন। কিন্তু আজ তাঁর প্রয়াণের সূত্রে একটিই প্রশ্ন, সংশ্লিষ্ট পরিমণ্ডলে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে— এই সংরক্ষণ, এই মিথস্ক্রিয়া, এই গবেষণা চালু থাকবে তো?

আরও পড়ুন-বিপ্লবী জীবনের অজানা কথা

লিটল ম্যাগাজিন প্রদর্শনী দেখে মুগ্ধ হই
তৃপ্তি সান্ত্রা
নয়ের দশকের মাঝামাঝি। সন্দীপ দত্ত, লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে সার্ভে করতে বেরিয়ে আমার শহর মালদায় এসেছেন। আমার উপর ভার ছিল দেখা করে কয়েকটি পত্রিকা দেওয়ার। হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে সেই কাজ সারি। খুব ছোট থেকে কলকাতা গেছি। বাংলা আকাদেমি চত্বরে, ওঁর লিটল ম্যাগাজিন প্রদর্শনী দেখে মুগ্ধ হই। মালদা লাইব্রেরির এক অনুষ্ঠানে একবার এলেন। দারুণ বললেন। ২০২১-এ উত্তরবঙ্গ সাহিত্য আকাদেমির প্রথম অধিবেশন শিলিগুড়িতে। উদ্বোধক সন্দীপদা। অনেকের সঙ্গে আমিও আছি। মেলা শেষে খুব আড্ডা দিলাম। ২০২০-এর ২৪ জুন জানতে পারি, লিটল ম্যাগাজিনের ছোটগল্প পুরস্কার প্রাপক হিসেবে আমার নাম ঘোষিত হয়েছে। ২০২১-এর ৪ ডিসেম্বর মহাবোধি সোসাইটি হলে আয়োজিত হয় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। আমি উত্তরবঙ্গের মানুষ, লিটল ম্যাগাজিনের লেখক, বড় আনন্দিত হয়েছি সন্দীপদার দেওয়া সম্মাননায়।

আরও পড়ুন-গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় নিশ্চিত

বাংলা সাহিত্যকে সামগ্রিকত্ব দানে বিশ্বাসী ছিলেন
মণিশঙ্কর
প্রচলিত প্রতিষ্ঠান যেখানে কতিপয় পোষ্যকেই স্রষ্টারূপে প্রতিষ্ঠা দিয়ে আদতে নিজেদের বেনিয়া লক্ষ্যকে পূরণ করে চলে, সেখানে সন্দীপ দত্ত উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম ঘেঁটে বেড়াতেন যোগ্যকে যথাযথ মর্যাদাদানের জন্যে। আমি নিজে তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আটাশ বছরের লেখালেখির জীবনে আমাকে নিয়ে, আমার লেখা নিয়ে মাতামাতি করেনি কোনও প্রতিষ্ঠান। থাকি দুর্গাপুরের মতো ছোট শহরে। বেড়ে উঠেছি বাঁকুড়ার একটি গণ্ডগ্রামে। মহানগরের সঙ্গে আত্মিক যোগ তো দূরের কথা, নিয়মিত যাতায়াতই হয়ে ওঠে না পেটের দায়ে। সেই আমার লেখা উপন্যাস পড়ে সন্দীপদা যে শুধু উচ্ছ্বসিত প্রশংসাই করেছিলেন তাই নয়, ২০২২ সালের ‘লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রে’র বাৎসরিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানের উদ্বোধনের জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানান, যে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, সভাপতিত্ব করেন পবিত্র সরকার। এমন একটি মঞ্চে আমাকে উদ্বোধকের মর্যাদাদান, একমাত্র সন্দীপদার পক্ষেই সম্ভব। এই যে অন্বেষা, যোগ্য অথচ অনালোকিতকে খুঁজে তাঁর দীপ্তিতে আলোকিত করার নিঃস্বার্থ প্রয়াস, এই বিরল গুণটিই সন্দীপ দত্তকে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে।

আরও পড়ুন-কুন্তলকে সম্মান, কেন দায় নেবে না মিডিয়া?

সম্পাদকদের পরমবন্ধু
আফিফ ফুয়াদ
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রবর্তিত প্রথম লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার তুলে দেবেন প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি অন্নদাশঙ্কর রায়। প্রথম প্রাপক আমার সম্পাদিত দিবারাত্রির কাব্য পত্রিকা। বাংলা আকাদেমি সভাঘরে ঢুকছি, দেখলাম পেছন থেকে কেউ একজন একটা গোলাপ বাড়িয়ে দিচ্ছেন আমার দিকে। মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম সন্দীপ দত্ত। বছর চল্লিশ আগে পরিচয়। এরপর প্রতিবছর কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাদিবসের অনুষ্ঠানে থেকেছি। ২০০৩ সালে চলে গেলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। প্রকাশ পেল দিবারাত্রির কাব্যর সুভাষ মুখোপাধ্যায় সংখ্যা। সেই সংখ্যার জন্য লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ২০০৫ সালে লিটল ম্যাগাজির পুরস্কার দিয়েছিল দিবারাত্রির কাব্য পত্রিকাকে। এই পত্রিকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথির আসন অলংকৃত করেছেন সন্দীপদা। সন্দীপ দত্ত ছিলেন লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। তাঁর প্রয়াণে যে ক্ষতি হল তা অপূরণীয়।

আরও পড়ুন-আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে শুরু হচ্ছে নতুন শিক্ষানীতি

অন্তরালচারী এক কর্মযোগী
ড. সুদীপ্ত মাজি
এক নিরুপম নক্ষত্রের নিঃশব্দ পতন আমাদের নিঃস্ব করে দিয়ে গেল। কী আশ্চর্য দায়বোধ থেকে অজস্র গবেষকের অসংখ্য গবেষণাকর্মকে যে তিনি ঋদ্ধ করেছেন, দেশে ও বিদেশে, সে ইতিহাস নিশ্চয়ই লেখা হবে একদিন। এমন স্বপ্নচারী সৈনিক আমি আমার জীবনে বড় অল্পই দেখেছি। নিজস্ব কর্মকৃতিত্বে সন্দীপ দত্ত নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এক নির্বিকল্প প্রতিষ্ঠান। আদর্শবোধে সর্বদা অবিচল থেকে অনেকের অনেক সারস্বত-স্বপ্নের নান্দীপাঠ রচনা করে দিয়েছিলেন। যখন মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হইনি, তখন প্রথম আলাপ। সেই থেকে এক অবিচ্ছিন্ন স্নেহসুধায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন। আমার ব্যক্তিগত সৃজনশীল লেখালিখি ও প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার কাজে তাঁর সহযোগিতা এক অপরিশোধ্য ঋণপাশে বেঁধে রেখেছে আমাকে। ২০১৮ সালে সেই গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক-সম্মাননা পাওয়া আমার জীবনের অন্যতম বড় প্রাপ্তি। সুদূর গ্রাম থেকে দৌড়ে আসা তরুণ লাজুক গবেষক থেকে বিদেশি অভিজ্ঞ গবেষণাকর্মে নিযুক্ত ব্যক্তি— যিনিই তাঁর সাহায্য পেতে দৌড়ে এসেছেন, তন্নিষ্ঠ অনুসন্ধানে নিজের হাতে তুলে দিয়েছেন অমূল্য রতনসম্ভার। সন্দীপদা ছিলেন এমনই অন্তরালচারী এক কর্মযোগী, লিটল ম্যাগাজিন ও তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা গবেষণাকর্মের আয়োজনে তুলনারহিত এক ব্যক্তিত্ব।

Latest article