অন্য এক পৃথিবীর সন্ধানে

এই প্রথমবারের মতো অন্তরীক্ষ থেকে ভেসে এল আলোকবার্তা; প্রচলিত রেডার কমিউনিকেশনের বাইরে অপটিক্যাল কমিউনিকেশনের প্রয়োগ মহাকাশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী। এ-বিষয়ে আলোকপাত করছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

এ-যেন একপ্রকার দৈববাণী!
ওই শূন্য থেকে পৃথিবীর বুকে—
তবে অলীক নয়; একেবারে বাস্তব। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১৪০ মিলিয়ন বা ১৪ কোটি কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত সাইকি মহাকাশযান থেকে ভেসে এল লেজার সংকেত; সঙ্গে সঙ্গে শুভ মহরত হল মহাশূন্যে যোগাযোগের এক অনন্য এবং উচ্চগুণসম্পন্ন মাধ্যমের। গভীরভাবে উন্মুক্ত হল “ডিপ স্পেস এলিমেন্টস্” উন্মোচনের দ্বার।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীকে কদর্য আক্রমণ, বোসকে তুলোধোনা তৃণমূলের

অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি
সমগ্র পৃথিবীর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা সাধারণত অন্তরীক্ষে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য রেডিও ডিটেকশন অ্যান্ড রেঞ্জিং বা রেডার কমিউনিকেশন সিস্টেম ব্যবহার করেন। এই পদ্ধতিতে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়। তবে জ্যোতির্বিদদের ধারণা এই যোগাযোগ যদি লাইট অ্যাম্পলিফিকেশন বাই স্টিমুলেটেড এমিশন অব রেডিয়েশন বা লেজার পদ্ধতির সাহায্যে করা যায় তাহলে মহাশূন্য হতে অনেক দ্রুত এবং বেশি ডেটা বা তথ্য সহজেই সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। কেননা এই পদ্ধতিতে ফোটন বা আলোককণা ব্যবহৃত হয়, ফলে সংকেত আলোর গতিবেগ পায় এবং অত্যন্ত দ্রুত তা যথাস্থানে পৌঁছে দেয়। এই কথা ভেবে নাসার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সাইকি মহাকাশযানে একটি অপটিক্যাল কমিউনিকেশন ট্রান্সিভার সিস্টেম জুড়ে অন্তরীক্ষের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন এবং গত ৮ এপ্রিল প্রথম সেই আলোকবার্তা পৃথিবীর বুকে এসে পৌঁছেছে।

আরও পড়ুন-বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি বাংলায় ৬০ কিমি বেগে বইল ঝড়

অ্যাস্টারয়েড সাইকি
আমাদের সৌরজগতে মঙ্গল এবং বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথের মধ্যবর্তী অঞ্চলে যে অ্যাস্টারয়েড বেল্ট বা গ্রহাণু এবং ধূমকেতুদের বিচরণের জায়গা আছে, সেখানে উপস্থিত সবচেয়ে বৃহত্তম এবং দানবাকৃতির যে অ্যাস্টারয়েডটি রয়েছে তার নাম ‘সাইকি’। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘১৬ সাইকি’, কেননা এটি নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরীয় ‘স্মল বডি অরবিটাল এলিমেন্টস্’-এর ১৬তম মাইনর প্লানেট। প্রাচীন গ্রিক আত্মার দেবী সাইকির নামে পরিচিত ইংরেজি এম অক্ষরের মতো দেখতে এই গ্রহাণুটিকে সর্বপ্রথম ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ আবিষ্কার করেন ইটালিয়ান নভোবিজ্ঞানী অ্যান্নিবেল ডে গ্যাসপারিস। সাধারণত গ্রহ বা গ্রহাণু বরফ এবং পাথরের তৈরি হলেও সাইকি ধাতব পদার্থ সংবলিত। অ্যাস্টারয়েড বেল্টের প্রায় ১ শতাংশ ভর বিশিষ্ট এই গ্রহাণুটি স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীদের নজর কেড়েছে।
এই গ্রহাণুটি ধাতু দ্বারা তৈরি এবং এর বুকে বেশ কিছু জায়গায় ভরক্ষয় এবং গর্তও দেখতে পাওয়া যায়। তবে এই অ্যাস্টারয়েডটির জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে নানা জল্পনা রয়েছে বৈজ্ঞানিক মহলে। ২২০ কিলোমিটার বা ১৪০ মাইল ব্যাস বিশিষ্ট এই গ্রহাণুটি নাকি কোনও একটি ৫০০ কিলোমিটারের অধিক ব্যাস বিশিষ্ট মহাজাগতিক বস্তু ধাতব কোর বা অন্তস্তলের উন্মুক্ত একটি অংশ। আবার অনেকে মনে করেন সাইকি আসলে লৌহ-পাথুরে ধূমকেতু মেসোসিডারাইটস্-এর ধাতু এবং সিলিকেটের জমাটবদ্ধ অবস্থা। এছাড়াও মনে করা হয় যে, সাইকি হল ‘১ সেরেস’ এবং ‘৪ ভিস্তা’র মতো বিচ্ছিন্ন মহাকাশীয় বস্তু, যার কোনও এক সময় লৌহ অগ্ন্যুৎপাত বা ফেরো ভলক্যানিজম্ হয়েছিল। সাধারণত দেখা যায় আমাদের গ্রহ পৃথিবীর ক্রাস্ট এবং ম্যান্টল অঞ্চল পুরু হওয়ায় কোর অঞ্চল সম্পর্কে কোনও সঠিক তথ্য জানা যায়নি; বিজ্ঞানীদের ধারণা ধাতব গ্রহাণু সাইকিকে ভালভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেই এই রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব। সাধারণ পাথর ও বরফের পৃথিবীর বাইরেও কি কোনও ধাতব পৃথিবী সম্ভব, সেই কৌতূহলই বিজ্ঞানীদের বিচলিত করে তুলেছে।

আরও পড়ুন-আক্রান্তদের পাশে শান্তনু

সাইকি অভিযান
সাইকি মহাকাশ অভিযান নাসার ‘সায়েন্স মিশন ডিরেক্টরেটে’র ১৪তম অভিযান। এই উদ্দেশ্যে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির নেতৃত্বে, নাসার জেট প্রোপালশন্ ল্যাবরেটরির পরিচালনায়, ব্যবস্থাপনায় এবং নজরদারির উপর ভর করে ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে ২০২৩-এর ১৩ অক্টোবর সাইকি মহাকাশযান অন্তরীক্ষের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ম্যাক্সার টেকনোলজির তৈরি সৌর-তড়িৎ পরিচালন পরিকাঠামোর মহাকাশযানটি সঙ্গে করে নিয়ে যায় ছবি তোলার জন্য মাল্টিস্প্রেক্টাম ইমেজার, গামা রশ্মি ও নিউট্রন স্পেক্ট্রোমিটার, ম্যাগনেটোমিটার, এক্স-ব্যান্ড গ্রাভিটি সায়েন্স ইনভেস্টিগেশন সিস্টেম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাসার ডিপ স্পেস অপটিক্যাল কমিউনিকেশন সিস্টেম।
এটিই প্রথম যে কোনও মহাকাশযান পৃথিবীর বুকে লেজার সংকেত পাঠাল। এই প্রাযুক্তিক প্রক্রিয়ায় সাইকি মহাকাশযানে একটি অপটিক্যাল ট্রান্সিভার রয়েছে এবং পৃথিবীর বুকে জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির অন্তর্গত রাইটউডে টেবিল মাউন্টেন ফেসিলিটিতে রয়েছে রিসিভার অ্যান্টেনা। এখান থেকেই ট্রান্সিভারে সিগন্যাল পাঠালে একটি সূত্র তৈরি হয় এবং সেই সূত্র ধরেই স্পেশক্রাফ্ট মহাশূন্যের তথ্যসমৃদ্ধ ডাউনলিঙ্ক লেজার মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। এ-বছর ৮ এপ্রিলের আগে ২০২৩-এর ১১ ডিসেম্বর এই মহাকাশযানটি মাত্র ৩.১ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে একটি ১৫ সেকেন্ডের ভিডিও ডাউনলিঙ্ক পাঠিয়েছিল ঠিক তখনই বিজ্ঞানীরা এর সাফল্য কামনা করেছিলেন।

আরও পড়ুন-সিআইএসসিই- তেও এগিয়ে মেয়েরা, উত্তীর্ণদের শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর

মহৎ উদ্দেশ্য
সাইকি কি কেবলই একটি কোর অঞ্চল, নাকি অগলিত একটি পদার্থ; সাইকির পৃষ্ঠতলের বয়স কত, পৃথিবীর উচ্চচাপের কোর অঞ্চলে যে আলোক বস্তু দেখা যায় সেই একই পদার্থ কি সাইকির মধ্যেও উপস্থিত; সাইকির ভূসংস্থানের প্রকৃতিই বা কেমন। এসব জানতেই নাসার এই প্রচেষ্টা। মহাকাশযানটি আগামী ২০২৯-এর অগাস্ট মাসে দীর্ঘ ৬ বছরে প্রায় ৩৬০ কোটি কিলোমিটার যাত্রার পর নির্দিষ্ট অ্যাস্টারয়েডটির কাছে পৌঁছাবে এবং ২৬ মাস ধরে খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করবে।
মহাকাশ বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই অপটিক্যাল কমিউনিকেশনের প্রয়োগ দৃষ্টান্তমূলকভাবে উপযোগী। এই সিস্টেম প্রচলিত রেডার সিস্টেমের চেয়ে ১০-১০০ গুণ বেশি দ্রুত এবং ফলপ্রসূ। বর্তমানে এই সিস্টেম ডেটা ২৫ এমবিপিএস গতিতে পাঠিয়েছে, যা বিজ্ঞানীদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। এই প্রজেক্টের ফ্লাইট অপারেশন লিডার বিজ্ঞানী কেন এন্ড্রুজ জানান, তাঁরা খুব কম সময়ের পরিসরে এই কাজ সাফল্যের সঙ্গে করছেন, যা তাঁদের উচ্চাশাকে অনেকাংশেই বাড়িয়ে দিয়েছে।
কোনও গ্রহ সৃষ্টির অজানা উপাদান এবং পৃথিবীর মতো গ্রহের অন্তস্তল ‘কোর’ অঞ্চলের রহস্য উন্মোচন করতে এই জাতীয় উচ্চগুণসম্পন্ন ডেটা অত্যন্ত কার্যকরী। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এইরূপ যোগাযোগের মাধ্যমে প্রাপ্ত ডেটাই আমাদের জানতে সাহায্য করবে পৃথিবীর বাইরে ধাতু দিয়ে গড়া কোনও নতুন বিশ্ব আছে কিনা। তবে প্রাথমিক ভাবে নাসার এই ডিপ স্পেস অপটিক্যাল কমিউনিকেশন সিস্টেম ভবিষ্যতে মহাশূন্যের উচ্চ রেট সমন্বিত ডেটা, ছবি, ভিডিও এবং নানান জটিল বৈজ্ঞানিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং ডেটা দিয়ে মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় নাসার ‘মুন টু মার্স আর্কিটেকচার’ তৈরি করতে সাহায্য করবে।

Latest article