হেঁশেলে আগুন ধরিয়ে ছাড়ল মোদি সরকার। এতদিন পাঁচ রাজ্যের ভোটে মানুষকে ধাপ্পা দেবে বলে চুপচাপ ছিল। আবার তারা স্বমহিমায়। সত্যি কি দাম না বাড়িয়ে উপায় ছিল না? মিথ্যের জাল টেনে ছিঁড়ে দিলেন অর্থনীতিবিদ
ড. দেবনারায়ণ সরকার
“বিশ্বাস ক’রো না সেই সব সাপেদের
জমকালো চামড়ায় যারা নিজেদের ঢেকে রাখে”
– সুকান্ত ভট্টাচার্য (‘মজুরদের ঝড়’; ‘ছাড়পত্র’)
আরও পড়ুন-উচ্চমাধ্যমিকে প্রস্তুতির রণকৌশল
হ্যাঁ ঠিক তাই। পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে জমকালো চামড়ায় কেন্দ্রের মোদি সরকার পেট্রোল, ডিজেলের দাম কার্যত ১৩৭ দিন স্থির রেখে, পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনের চারটিতে জয়ের পর আবার স্বমহিমায় আসীন হয়েছেন। এবং মঙ্গলবার থেকে এগুলির দাম আবার বাড়ানো হল। জমকালো চামড়া থেকে ফের বেরিয়ে এল কালসাপ।
মঙ্গলবার কলকাতায় ইন্ডিয়ান অয়েলের পাম্পে পেট্রোলের দাম লিটারে ৮৪ পয়সা বেড়ে হল ১০৫.৫১ টাকা। ডিজেলে লিটার প্রতি ৮৩ পয়সা বেড়ে দাম হল ৮৯.৭৯ টাকা। রান্নার গ্যাসের ক্ষেত্রে কলকাতায় ১৪.২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডার একধাক্কায় ৫০ টাকা বেড়ে হল ৯৭৬ টাকা। সরকারের এই দাম বৃদ্ধি (পড়ুন ভোটে জেতার পর সরকারের তরফে গিফট) দেশের মানুষের শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি ধরাচ্ছে, একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। কারণ, তেলের এই দাম বৃদ্ধি খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দামকেও আকাশছোঁয়া করবে। আর, তা নিয়ে গৃহস্থজীবন যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।
আরও পড়ুন-শান্তিপুর পুরসভা চালু করল দুয়ারে চিকিৎসা
নমুরা হোল্ডিংস ইকন-এর তথ্যানুযায়ী প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ১০ মার্কিন ডলার করে বাড়লে, ভারতের খুচরো বাজারে দ্রব্যের দাম ০.৬- ০.৭ শতাংশ বাড়ে। এক্ষেত্রে বর্তমানে খুচরো মূল্যবৃদ্ধি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সহনীয় সীমার ৬ শতাংশের ওপরে। এমনকী পাইকারি মূল্যবৃদ্ধিও অস্বাভাবিক, যা গত ফেব্রুয়ারিতে ১৩ শতাংশের ওপরে ছিল। মহলের আক্ষেপ একটাই। বছরদুয়েক ধরে নাগাড়ে অতিমারির ধাক্কা সয়ে আসা রুজিরোজগার নিয়ে বিপন্ন মানুষের জন্য যে আরও অনেক দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে, তা বলাই বাহুল্য।
পাশাপাশি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আগেই অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল পিছু ১৩০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছিল। রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল ক্রয়ের আশ্বাসও পেয়েছিল ভারত। তথাপি এই দাম বৃদ্ধি যার প্রভাব আমজনতার ওপর বড় আঘাত, সেকথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
সত্যি কি এই মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল?
আরও পড়ুন-অনির্দিষ্টকালের জন্য পরীক্ষা স্থগিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
গত সাত বছরে মোদি সরকার এই তেল থেকে ২৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো আয় করেছে। রাজ্যকে দিয়েছে সামান্য কিছু অংশ। দেখা যাচ্ছে, মোদি সরকার মোট করের সেস ও সারচার্জের হার মনমোহন সিং সরকারের চেয়ে দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। যার এক কানাকড়িও রাজ্য পায়নি।
২০২০-২১ সালে মোট কেন্দ্রীয় করের ১৯.৯ শতাংশ ছিল সেস ও সারচার্জ অথচ ২০১১-১২ তে তা ছিল প্রায় অর্ধেক, ১০.৪ শতাংশ। তেলের ক্ষেত্রে মোট শুল্কের নগণ্য অংশ রাজ্য পাচ্ছে। ২০২১-এর ৩ নভেম্বর কেন্দ্র লিটার প্রতি পেট্রোলে শুল্ক ৫ টাকা এবং ডিজেলে ১০ টাকা কমায়। এর আগে কেন্দ্র প্রতি লিটার পেট্রোলে ৩২.৯০ টাকা আদায় করত এবং ডিজেলে ৩১.৮০ টাকা আদায় করত। এর থেকে পেট্রোলে লিটার পিছু রাজ্যকে দিত ৫৭ পয়সা এবং ডিজেলে লিটার পিছু ৭৪ পয়সা। শতকরার হিসাবে পেট্রোলের ১.৭৩ শতাংশ রাজ্য পেত এবং ডিজেলে পেত মাত্র ২ শতাংশের মতো। গত ১২৭ দিনে কেন্দ্র পেট্রোল থেকে আদায় করছে লিটার প্রতি ২৭.৯০ টাকা এবং ডিজেল থেকে লিটারে ২১.৮০ টাকা। সারচার্জের ক্ষেত্রে এখন কেন্দ্রীয় শুল্ক পেট্রোলের ক্ষেত্রে প্রতি লিটারে ২৭.৩৩ টাকা এবং রাজ্যের মাত্র ৫৭ পয়সা। ডিজেলের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের অংশ প্রতি লিটারে ২১.০৬ টাকা এবং রাজ্যের মাত্র ৭৪ পয়সা। এরপরেও কেন্দ্র আবার দাম বাড়াল। অথচ দাম না বাড়িয়েও বর্তমান সরকার পেট্রোল-ডিজেলে ভরতুকি দিতে পারত।
আরও পড়ুন-ভারতের তুরুপের তাস নেট রানরেট
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইউপিএ আমলে ২০১৪ তে প্রতি লিটার পেট্রোলে কর ছিল ৯.৪৮ টাকা যার মধ্যে রাজ্য পেত ৩.০৩ টাকা। প্রতি লিটার ডিজেলে কর ছিল ৩.৫৭ টাকা যার মধ্যে রাজ্য পেত ১.১৪ টাকা। অর্থাৎ এই সময় কেন্দ্রীয় করের প্রায় ৩২ শতাংশ পেত রাজ্য।
এখন বলা হচ্ছে, রাজ্য কেন পেট্রোল- ডিজেলে কর কমানোর পথে হাঁটছে না?
মোদি সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছিল, তখন তেলের উপর রাজ্যগুলির ভ্যাটের হার বর্তমান সময় পর্যন্ত মোটামুটি অপরিবর্তিত রয়েছে। অর্থাৎ মনমোহন জমানায় যে হার ছিল তা পাল্টায়নি। এমতাবস্থায়, কেন এই ট্যাক্স রাজ্য দেবে? এই কর কমাতে পারে একমাত্র কেন্দ্র। কারণ কেন্দ্র যে টাকা আয় করছে, তার থেকে রাজ্যগুলিকে দিচ্ছে মোটে ২ শতাংশের মতো।
আরও পড়ুন-খোলা মনে খেলব এবার, আইপিএলের আগে বিরাট-ঘোষণা
এবার আসা যাক রান্নার গ্যাসের কথায়। এক্ষেত্রেও কেন্দ্রের স্বৈরাচারী মনোভাব স্পষ্ট। অক্টোবরের পর এই এখন কলকাতায় ১৪.২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডার এক ধাক্কায় ৫০ টাকা বেড়ে ৯২৬ টাকা থেকে ৯৭৬ টাকা হল। নির্বাচন বড় বালাই, তাই এই মধ্যবর্তী বিরতি।
২০১৪ তে এই ১৪.২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ছিল ৪১০ টাকা। এখন বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে। তাই বাড়াতে হল। কিন্তু বাস্তব তো তা নয়। ইউপিএ আমলে ২০১৩-১৪ তে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রের সরকার তেল ও গ্যাসে ভরতুকি দিয়েছে ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে শুধু ডিজেলে ভরতুকি দিয়েছে ৮২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আর এই মোদি সরকার তেলে তো ভরতুকি দিচ্ছেই না, গ্যাসেও ভরতুকি তুলে দিচ্ছে। ২০১৯-২০ তে মোদি সরকার গ্যাসে ভরতুকি দিয়েছে ২২,৭২৬ কোটি টাকা। আর ২০২০-২১-এ ভরতুকি কমিয়ে দাঁড় করিয়েছে ৩৬৫৮ কোটি টাকায়। এবার তো এলপিজি গ্যাসের ভরতুকি প্রায় তুলেই দিল বলা যায়।
শেক্সপিয়র কিং লিয়ার নাটকে লিখেছিলেন, ‘Robes and furred gowns hide all’ (যারা বলপূর্বক বঞ্চিত করে ও যারা পশমের চামড়া পরে, তারা সবকিছু লুকায়)। মোদি সরকার জনগণকে জোর করে তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে আর কুযুক্তির চামড়ার ভাঁওতা দিয়ে সত্যিটাকে লুকোচ্ছে। জনগণ এর জবাব দেবেন ২০২৪-এ।