কথা কও আমার ভাষায়, কথা কও আমার রুধিরে

চলে গেল আরও একটা ২১শে ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষা দিবস পালন মানে তো প্রাতিস্বিক অস্মিতা লালনের পরিসরটিকে আরও একটু আলোময় আরও একটু জল আর বাতাস দিয়ে সুন্দর করে তোলা। সব ভাষাভাষীর ক্ষেত্রেই এই কথাটা প্রযোজ্য। সেকথাটা মনে করিয়ে দিচ্ছেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপিকা অরুন্ধতী দাস।

Must read

গতকাল ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। দিনটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের (International Mothers Language Day) স্বীকৃতি পেয়ে গেছে প্রায় তেইশ বছর হল। দিনটা এলেই আম-বাঙালির মনে পড়ে যায় ‘আ মরি বাংলা ভাষা’-র অস্তিত্ব রক্ষার্থে কত দফা দাবি তুলতে হবে। নিজেকে ভাষাসৈনিক, কমপক্ষে ভাষাভাবুক হিসেবেও প্রমাণ করার তাগিদ জেগে ওঠে। কিন্তু ভাষা নিয়ে আবেগ তো আর বাঙালিরই একচেটিয়া নয়! গোটা বিশ্ব জুড়েই ছড়িয়ে আছে ভাষার জন্য লড়াইয়ের ইতিহাস।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন চিরস্মরণীয় তো বটেই, অনেকেই দুই বাংলার ভাষা প্রতিযোগিতার দ্বন্দ্ব টেনে ১৯৬১ সালে বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনের কথা টেনে আনেন। কিন্তু ভাষাসচেতনতা শুধু এপার-ওপার দড়ি টানাটানির মধ্যে নেই, ভাষা তো বৃহত্তর ঐক্যের সূত্র। সেই প্রসঙ্গ ধরে বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে চোখ রাখা যায় অন্য দিগন্তে।

১৯৩৭ সালে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’-এর উদ্যোগে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির বিদ্যালয়গুলিতেও নেমে এসেছিল বাধ্যতামূলক হিন্দি শিক্ষার পরোয়ানা। এই ভাষা আগ্রাসনের বিরোধিতার জল গড়ায় বহুদূর। সহস্রাধিক মানুষ গ্রেফতার হন, প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে, শেষপর্যন্ত প্রজাবিদ্রোহের আঁচ সামলাতে ইংরেজ সরকারের হস্তক্ষেপে ১৯৪০ সালে এই নিয়ম প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

ভাষা নিয়ে দুর্বিপাকের চরম নজির দেখা গিয়েছিল সুদূর তাইওয়ানেও। কোনও একটি ভাষা অঞ্চলের ওপরে বিজাতীয় ভাষার শাসকের প্রভুত্ব ভাষাকে কতদূর কোণঠাসা করতে পারে, তাইওয়ানের ঘটনা ছিল তার উত্তুঙ্গ নিদর্শন। তাইওয়ানের পুরোনো অধিবাসীরা ছিলেন মূলত হাক্কাস এবং ফুকিয়েন। এঁরা কথা বলেন হাক্কা, ফুকিয়েনিজ এবং অস্ট্রো-এশিয়ান ভাষায়। কিন্তু শাসকের ভাষা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বিভ্রান্তির পরিসর বাড়তে থাকে। ১৯৩৭ সালে জাপানের আওতায় থাকাকালীন তাইওয়ানের জাতীয় ভাষা হিসেবে খাতায়কলমে উঠে আসে জাপানি ভাষা। অশান্তির মেঘ ঘনাচ্ছিল তখন থেকেই। এর পর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় ও তৎসংক্রান্ত বাঁটোয়ারার ফলাফল হিসেবে তাইওয়ানকে অঙ্গীভূত করে নেয় চিন। মুহূর্তেই আবার জাতীয় ভাষা বদলে তার জায়গা নিয়ে নেয় মান্দারিন। মান্দারিন বনাম জাপানি ভাষার যুদ্ধের ভেতরে শ্বাসরুদ্ধ লড়াই চলতে থাকে তাইওয়ানের নিজস্ব লোকজ ভাষাগুলোর। একসময়ে তাইওয়ানের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে পড়ে মাতৃভাষার জন্মগত অধিকারের প্রশ্ন। ১৯৮০ সালে অধীনতার নিশামুক্তি ঘটিয়ে শাসনতান্ত্রিক স্বাধিকারের সঙ্গে সঙ্গে তাইওয়ান আদায় করে নেয় আঞ্চলিক ভাষাগুলির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও।

প্রায় একই রকম পরিস্থিতির আগুনে বহুদিন ধরে গা সেঁকে চলেছে বেলজিয়াম। ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের দাবিতে পাকিয়ে-ওঠা বিবাদ মেটাতে যুগান্তকারী একটি সাধারণ নির্বাচনও সেখানে হয়ে গেছে ২০১০ সালে। তুলনামূলক ছোটো আয়তনের এই দেশটিতে ফরাসি বনাম ওলন্দাজ ভাষার লড়াই বহুদিনের। নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদের নিম্নকক্ষে ২৭টি আসন জিতে নেওয়ার পর তাই ‘দ্য নিউ ফ্লেমিশ অ্যালায়েন্স পার্টি’ স্পষ্টতই ওলন্দাজভাষী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। নিজস্ব সংবাদমাধ্যম, শক্তিশালী অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড এবং অবশ্যই নিজস্ব রাজনৈতিক দল থাকার সুবাদে, ফরাসিপক্ষের নাগরিকদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের বন্দোবস্ত করে দিয়ে পত্রপাঠ স্বাতন্ত্র্যের পক্ষপাতী তাঁরা। অন্যদিকে, ফরাসি বুলির অনুপন্থী সোশালিস্ট দল ভাষাকে শুধু নিজেদের স্বাধীনতার পরিচায়ক হিসেবে নয়, বরং অন্যের ওপরে নিয়ন্ত্রণ জারি করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেই বেশি উদ্গ্রীব। সেজন্যই, একদিকে তাঁরা অখণ্ড বেলজিয়ামের দাবি তুলছেন, আবার অন্যদিকে, তাঁদের স্বপ্নের অবিভক্ত বেলজিয়ামের ভাষা হিসেবে রাখতে চাইছেন ফরাসিকেই।

ভাষাকে অস্ত্র করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার তাগিদে সংখ্যালঘুর ভাষার ওপরে আগ্রাসন জারি করেছিল কুইবেকের সরকার পক্ষও। কানাডার দশটি প্রদেশের মধ্যে একমাত্র কুইবেকেই ফরাসি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা লক্ষণীয় রকম বেশি। কিন্তু সেখানে রয়ে গেছেন ইংরেজিভাষী বেশ কিছু সাধারণ নাগরিকও।

স্বাভাবিকভাবেই, ফরাসি এবং ইংরেজি, দুটি ভাষাই সরকারি দফতরের কর্মনির্বাহযোগ্য হিসেবে এতদিন স্বীকৃত ছিল কুইবেকে। কিন্তু হঠাৎই সংখ্যাগরিষ্ঠদের ইগো মালিশ করার তাগিদে কুইবেকের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন সরকার এই সংখ্যালঘু ইংরেজদের নাগরিকত্ব বা অধিকার, কোনোটাকেই বিন্দুমাত্র স্বীকৃতি না দিয়ে সংসদে পেশ করেছেন ফরাসিকে একমাত্র কার্যনির্বাহী ভাষা হিসেবে বেছে নেওয়ার প্রস্তাব।

আসলে ভাষা তো শুধুই বাগ্যন্ত্রের যান্ত্রিক প্রয়াসমাত্র নয়, ভাষা আদতে মানুষের আত্মপরিচয়েরই বৃহত্তর প্রক্ষেপ। সেজন্যই আমেরিকার আদিনিবাসীদের ক্ষেত্রেও ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ঘৃণ্য চাবুক নির্লজ্জভাবে যতবার আছড়ে পড়েছে ভূমিজ সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলিকে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার নখদাঁত বের-করা ফন্দিতে; তার অভিঘাতে দেশীয় ভাষার ও সংস্কৃতির পক্ষে দাঁড়িয়ে রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধও গড়ে উঠেছে বারবার।

‘ভাষাশহিদ’তাই শুধু কয়েকটি নামমাত্র নয়, পৃথিবীর প্রতিটি কথাবলা মানুষের বুকের ভেতরেই বাস করে এইসব রফিক, সালাম, শফিউল আর বরকতরা; বলে যায় “কথা কও আমার ভাষায়/ কথা কও আমার রুধিরে।”

Latest article