বিশ্ব কি শিশুর বাসযোগ্য?

আগামিকাল শিশুদিবস। আয়োজিত হবে রকমারি অনুষ্ঠান, পিকনিক। ছোটদের ভরিয়ে দেওয়া হবে আদরে, উপহারে। এই আশ্চর্য আনন্দের আঁচ কি পৌঁছবে সব ছোটদের মনের অন্দরে? সমস্যা-জর্জরিত বিশ্বে আদৌ ভাল আছে শিশুরা? উত্তর খোঁজার চেষ্টায় অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

দেশের কাজ, পড়াশোনা, লেখালিখি। তার মধ্যেও ছোটদের নিয়মিত সময় দিতেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তিনি। গুরুদায়িত্ব গ্রহণের পরেও বদলায়নি রুটিন। ছোটদের কাছে ছিলেন ‘চাচা নেহরু’।
১৪ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন। পণ্ডিত নেহরুর প্রয়াণের পর শিশুদের প্রতি তাঁর ভালবাসার দিকটি মনে রেখে তাঁর জন্মদিনটি আমাদের দেশে শিশুদিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই থেকেই ১৪ নভেম্বর দিনটি পালিত হয়ে আসছে শিশুদিবস হিসাবে।
এই বিশেষ দিনে ছোটদের নিয়ে আয়োজিত হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান, পিকনিক। জনসাধারণকে সচেতন করা হয় শিশুর অধিকার নিয়ে। শিশুরা যাতে উপযুক্ত শিক্ষা, সঠিক পুষ্টি পায় সেই বিষয়গুলি নিয়েও আলোচনা করা হয়। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ, এই ভাবনাকে সামনে রেখেই মূলত পালিত হয় দিনটি।

আরও পড়ুন-প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক বই প্রকাশ

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি’। প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি সেটা সম্ভব হয়েছে? বর্তমান সমস্যা-জর্জরিত সময়ে সুরক্ষিত আছে শিশুর অধিকার? এই বিশ্ব, এই দেশ কি আজ সত্যিই শিশুর বাসযোগ্য? কী বলেন বিশিষ্টরা? জেনে নেওয়া যাক।

খিদে-পেটে শৈশব উপভোগ করা যায় না

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
বিশিষ্ট সাহিত্যিক

কবি সুকান্ত বলেছিলেন কবিতার কথা। বাস্তব পরিস্থিতি অন্য কথা বলে। কোনও কোনও দেশ হয়তো পেরেছে দেশকে শিশুর বাসযোগ্য করে তুলতে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করি না। বিশেষত গরিব শিশুদের কথাই এই ক্ষেত্রে আমি বলছি। তাদের দুরবস্থার কথা তো ভাবাই যায় না। শিশুমৃত্যুর হারেও আমাদের দেশ খুব একটা ভাল জায়গায় নেই। এখানে শিশুদের জন্য আলাদা করে কিছু ভাবনা-চিন্তাও করা হয় না। আসলে এত পরিমাণ শিশু গরিবের ঘরে জন্মায় যে তাদের জন্য কিছু করাই যায় না। তাহলে কী করে আমাদের দেশ শিশুদের বাসযোগ্য হবে, বুঝতে পারি না।
বড়দের পাশাপাশি আমি ছোটদের জন্যও লিখি। তবে আমার লেখা সব শ্রেণির শিশুর কাছে পৌঁছয় না। যারা আমার লেখা পড়ে তারা মূলত অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়ে। ইন্টেলিজেন্ট। অনেক কিছু জানে। এরাই আমাদের তৃতীয় প্রজন্ম। এদের চিন্তা-ভাবনা খুবই ঝকঝকে। মোটামুটি খেতে-পরতে পায়। ভালভাবে আছে। ভাল শিক্ষা অর্জন করতে পারছে। এদের বাইরে যেসব শিশু দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে, তাদের কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। তারা সাহিত্য পড়ার কথা ভাবতেও পারে না। অল্প বয়সেই তাদের কাজে নেমে পড়তে হয়। না হলে সংসার চলবে না, অভুক্ত থাকতে হবে।

আরও পড়ুন-অনুসন্ধিৎসা ও কৌতূহলের অনবদ্য ফসল

এটা ঠিক, এই দেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। সেটা যদি এই সমস্ত পরিবারের শিশুদের মেনে চলতে হয়, তাহলে বহু মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাবে। এমন অনেক পরিবার আছে, যেখানে শিশুরা কিছু রোজগার করে আনে বলেই অক্ষম মা-বাবারা খেতে-পরতে পান। অর্থাৎ শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেই শুধু চলবে না, বিকল্প ব্যবস্থাও ভাবতে হবে। সেটা তো করা যায়নি। একদিকে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলাম অথচ শিশুর শৈশব ফিরিয়ে দিতে পারলাম না, সেটা তো ঠিক হল না। একটা কথা মনে রাখতে হবে, খিদে-পেটে শৈশব উপভোগ করা যায় না।
এই সমস্যার সমাধান করা খুব মুশকিল। কারণ আমাদের দেশে সমবণ্টন হয়নি। কমানো যায়নি জনসংখ্যা। কিছু কিছু মানুষের হাতে প্রচুর টাকা। তারা অতি-বড়লোক। সেই বড়লোকদের হাতেই মূল টাকাটা জমে আছে। এতে দেশের কোনও লাভ হচ্ছে না। ঘরে ঘরে পৌঁছচ্ছে না সুফল। বড়লোকরা আরও বড়লোক হচ্ছে, গরিবরা দিনে দিনে আরও গরিব। টাকাটা সারা দেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে হয়তো সমস্যার সমাধান সম্ভব হত। তা হলেই এই দেশ, এই পৃথিবী শিশুর বাসযোগ্য হয়ে উঠত।

আরও পড়ুন-ডেঙ্গি পরিস্থিতি উদ্বেগজনক নয়

ভালবাসা পুনরুদ্ধার করতে হবে

অর্পিতা ঘোষ
নাট্যব্যক্তিত্ব

সত্যিই কি পারলাম বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করতে? টেকনিক্যালি সাউন্ড হতে গিয়ে যেভাবে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা হচ্ছে, ধর্মীয় ভাবনা উসকে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, যেভাবে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আপন সংস্কৃতি থেকে, তাতে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগছে, আমরা ঠিক কী দিয়ে যাচ্ছি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে? বাসযোগ্য করে তোলা মানে মানুষে-মানুষে ভালবাসা তৈরি করা। অথচ আমাদের দেশে হচ্ছে এর উল্টোটাই। সেটাই সবচেয়ে মর্মান্তিক। তার সঙ্গে পলিউশন এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিং তো আছেই। সবমিলিয়ে আগামী প্রজন্মকে খুব খারাপ পৃথিবীর মধ্যে দাঁড় করাচ্ছি বলে আমার মনে হয়।
কীভাবে ওভারকাম করা সম্ভব? প্রথমেই মনে হয় মানুষে- মানুষে সম্পর্ক, ভালবাসা পুনরুদ্ধার করতে হবে। এগুলো করতে গেলে ছোটদের শেখাতে হবে কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করতে হয়। শুধু গাছ লাগালে হবে না। তাদের এই কাজের মধ্যে যুক্ত করতে হবে।
এখন ছোটদের হাতে মোবাইল। এর ফলে তাদের একমাত্র রাস্তাই হয়ে যাচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। মানুষ এখন মানুষের সঙ্গে কথা বলে না। হাতে মোবাইল নিয়ে দীর্ঘ সময় বসে থাকে। একমাত্র ভালবাসাই পারে এই সমস্যার সমাধান করতে।

আরও পড়ুন-এক হারেই সব শেষ নয়: শচীন

শিল্পেরও একটা বড় ভূমিকা আছে। শিল্পীদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শিশু কিশোর আকাদেমির সভাপতি হিসেবে কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। ছোটদের কাছে আমাদের ঐতিহ্যগুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। শাস্ত্রীয় সংগীত, নাটক, সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে। চেষ্টা করছি দেশ সম্পর্কে ছোটদের মনে ভাবনা জাগ্রত করার। সেই ভাবনাটা মোটেও বিচ্ছিন্ন ভাবনা নয়। আমরা চেষ্টা করছি আমাদের মতো। সামগ্রিক একটা চেষ্টার প্রয়োজনীয়তা আছে।

মোবাইল অ্যাডিকশন ক্ষতি করছে

দিনে দিনে ছোটদের মধ্যে মোবাইল অ্যাডিকশন মারাত্মক রকম বাড়ছে। এর জন্য দায়ী আমরাই। আসলে ছোটদের দেওয়ার মতো সময় এখন বড়দের নেই। এর প্রধান কারণ নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। দাদু-ঠাকুমা নেই। মা-বাবা নিজেদের কাজে ব্যস্ত। ছোটদের দেখভাল করেন পরিচারিকা। রাতে কাজ থেকে ফিরে বাবা-মা ক্লান্ত। সন্তানের সঙ্গে খুব বেশি সময় কাটাতে পারেন না। বাচ্চার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে তাঁরা নিশ্চিন্ত। ফলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। মোবাইলে ডুবে ছোটরা হয়ে যাচ্ছে অসামাজিক। এখন এক জায়গায় কয়েকজন বাচ্চা জড়ো হলেও মোবাইল নিয়ে খেলতেই বেশি আগ্রহী।

আরও পড়ুন-কেন্দ্রের এজেন্সি-রাজনীতির বিরুদ্ধে তোপ দাগলেন শত্রুঘ্ন

আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি বাড়ির আশপাশে প্রচুর মাঠ। বিকেলবেলায় সবাই খেলাধুলা করতাম। এখন সেই সুযোগ নেই। মাঠের বড় অভাব। দূরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হওয়া সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। সব মিলিয়ে জটিল পরিস্থিতি। এই ভাবেই চুরি যাচ্ছে শৈশব।
করোনার সময় থেকেই মোবাইলের প্রতি অ্যাডিকশন বেড়ে গেছে। বিশেষত অনলাইন ক্লাসের পর। ঘরবন্দি থাকার কারণে অনেকেরই বেড়ে গেছে সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম। মা-বাবা এবং জানাশোনা লোকের বাইরে ছোটরা মেলামেশা করতে পারছে না। পরিস্থিতি দেখে-বুঝে মানুষ এখন কিছুটা হলেও সচেতন। আরও বেশি সচেতন হতে হবে।
প্রতিদিন ছোটদের নিয়ে যেতে হবে মাঠে। ক্রীড়াজগতের মানুষ হিসেবে আমি মনে করি, স্পোর্টসের থেকে বড় অ্যাটমোস্ফিয়ার আর কিছু হতে পারে না। খেলাধুলা করলে ছোটরা ডিসিপ্লিন শিখবে, তাদের ফোকাসও হবে। আসবে পাংচুয়ালিটি। মেলামেশা করতে পারবে সবার সঙ্গে। সময় কাটানোর সুযোগ দিতে হবে সবুজ গাছপালার সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে। বড়দের আরও বেশি ভাবতে হবে ছোটদের কথা। তবেই টেকনোলজির জাঁতাকল থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে শিশুরা।

আরও পড়ুন-হিমাচলে ২৩% প্রার্থীর বিরুদ্ধে রয়েছে ফৌজদারি মামলা

বড়দের অনেক বেশি ম্যাচিওর হতে হবে

বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে তোলার জন্য পাঁচটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে।
প্রথমত, হ্যাপিনিং ইনডেক্স বা আনন্দসূচক বাড়াতে ছোটদের আরও বেশি সময় দিতে হবে। এটা করতে হবে পরিবারের বড়দের। প্রশ্নোত্তর পর্ব ছাড়াও ছোটদের কথা আরও বেশি করে শুনতে হবে পজিটিভ বডি ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে। এর ফলে ছোটরা মনে করবে মা-বাবা নিশ্চয়ই আমার সাপোর্টে আছে। আমি একা নই। এটা আনন্দসূচক বাড়ানোর মস্তবড় উপায়।
দ্বিতীয়ত, বাড়াতে হবে ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি। দিনে অন্তত নব্বই মিনিট খেলাধুলার মধ্যে থাকতে হবে। ভর্তি করা যেতে পারে ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, বাস্কেটবল প্রভৃতির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। এর ফলে ছোটদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ ঘটবে। কনফিডেন্স বাড়াতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি বাড়বে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। সচেতন হতে হবে খাওয়াদাওয়া নিয়েও। আমরা অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় জিনিস ছোটদের খাওয়াই। বিশেষত মিষ্টি জাতীয় জিনিস। এই বিষয়েও আমাদের সচেতন হতে হবে।

আরও পড়ুন-বৈদিক ভিলেজে মাদক খাইয়ে তরুণীকে গণধর্ষণ, ধৃত ৪

তৃতীয়ত, নিজেরা ছোটদের পড়াই বা না পড়াই, প্রতিদিন পড়াশোনার খোঁজ-খবর নিতে হবে। এটা করতে হবে মানসিক আদান-প্রদান বা মানসিক সংযোগের জন্য। তাকে দিতে হবে যথাযথ পড়াশোনার পরিবেশ। সবটাই আউটসোর্স করলে চলবে না। জানতে হবে লেখাপড়ায় সন্তানের কোথায় দুর্বলতা। সেটা পূরণ করার চেষ্টা করতে হবে।
চতুর্থত, এই সময় আমরা প্রায় সবাই মোবাইলে অ্যাডিকটেড। দিনের যে-কোনও একটা সময় ফোনটাকে দূরে সরিয়ে রেখে মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হবে। এতে বোঝা যাবে সন্তানের হাবভাব। জানা যাবে সে কোনও কষ্ট পাচ্ছে কি না। এটা তৈরি করবে মানসিক সংযোগ।
পঞ্চমত, বহু মানুষ ম্যাচিওর না হয়েই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি শুরু করে দেন। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে একজন গার্জিয়ান থাকেন। বহু ক্ষেত্রে তাঁর সামনে অনেক কিছু প্রকাশ করা যায় না। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে বাবা-মা এবং বাচ্চা। নির্দ্বিধায় একে অপরকে আঘাত করা যায় মানসিক এবং শারীরিকভাবে। গলা তুলে কথা বলা যায়। এগুলো ঘটে বাচ্চাদের সামনেই। মনে করা হয়, বাচ্চারা কিছুই বুঝছে না। ধারণাটা ভুল। ছোটরা বড়দের দেখেই শেখে। তারা বুঝে যায় রাগ প্রকাশ করার মাধ্যম মারধর বা উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা। এই ক্ষেত্রে মা-বাবার মানসিকতার যথেষ্ট পরিবর্তন প্রয়োজন। তাঁদের অনেক বেশি ম্যাচিওর হতে হবে। এই বিষয়গুলোর ওপর জোর দিলে সমস্যা অনেকটাই দূর হবে বলে আমার বিশ্বাস। এইভাবেই পৃথিবী ছোটদের বাসযোগ্য হবে।

Latest article