ভীমরাও রামজি আম্বেদকর। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি যে সংবিধান তার প্রধান স্থপতি। পাশাপাশি ভারতে দলিত জাগরণের পথিকৃৎ। ভারতবর্ষ এখনও যে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে তার অন্যতম কারণ আমাদের সংবিধান। এই সংবিধান প্রণয়নের পর বাবাসাহেব বলেছিলেন সংবিধানে যে আদর্শ দেশের কথা বলা আছে, আমাদের সমাজ এখনও তার উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। তাকে সেই পথে নিয়ে আসার দায়িত্ব আমাদের সকলের। ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল কথাই হল জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের জন্য অধিকারের সুরক্ষা। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের সংবিধানের উপর সবচেয়ে বড় আক্রমণ হানছে ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকার।
আরও পড়ুন-ব্যাঙ্ক বন্ধ চারদিন
পদে পদে এই সংবিধানের মর্যাদা হরণ করছেন শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং দেশ জুড়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে যার মূলে আছে দলিত, মুসলমান ও জনজাতি সম্প্রদায়ের জীবন যাপনের উপর আগ্রাসন এবং একটি অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ভাবনা। অদ্ভুত দ্বিচারীতায় এঁরা আম্বেদকরের নাম নেন, কিন্তু দেশ জুড়ে হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথার ভয়ঙ্কর বঞ্চনা ও অত্যাচারকে টিঁকিয়ে রাখেন। যেহেতু এই দেশের এক বিপুল জনসংখ্যা দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তাদের নিয়ে জাতভিত্তিক রাজনীতি গোবলয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাই আম্বেদকরকে বাদ দেওয়া যায় না। কিন্তু তথাকথিত হিন্দু রাষ্ট্রের কারিগরদের কাছে আম্বেদকর এক বিশাল বিড়ম্বনা কেননা, তিনি হিন্দু বর্ণব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করেন এবং মনুস্মৃতি যা জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার মূল এবং নারীর অধিকার খর্বকারী, তাকে আম্বেদকর পুড়িয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-রুশ কবজায় মারিউপোল, ইউক্রেন সেনার প্রতিরোধ ভাঙছে
আম্বেদকর বলেছিলেন ভারতীয় বর্ণব্যবস্থা সেই চারতলা বাড়ির মতো যার সবচেয়ে উপরে রয়েছেন বর্ণহিন্দুরা আর সবচেয়ে নিচে রয়েছেন শূদ্ররা, এমন একটি বাড়ি, কিন্তু তার মধ্যে ওঠানামার কোনও সিঁড়ি নেই। যার যে জাত জন্ম-মৃত্যু পর্যন্ত তাকে সেখানেই থাকতে হবে। আম্বেদকর সারাজীবন লড়াই করেছিলেন এই জাতিব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং শেষ পর্যন্ত কয়েক লক্ষ সঙ্গীকে নিয়ে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। প্রখর মেধা সত্ত্বেও দলিত পরিবারে জন্মগ্রহণের কারণে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি উচ্চবর্ণীয় বিদ্বেষ ও অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে আজ একই বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন এ দেশের কৃতী দলিত ছাত্রেরা। বছর কয়েক আগে রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তথাকথিত অচ্ছে দিনের ভারতে দলিতদের অবস্থা কোথায়। পশ্চিমবঙ্গেও একদা বাম জমানায় আত্মঘাতী হয়েছিলেন চুনী কোটাল জাতিগত বিদ্বেষের কারণে।
আরও পড়ুন-স্পাইসজেটের ৯০ জন পাইলটের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা
সরকারি তরফে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে করোনার ভয়াবহ সময়ে প্রতি দশ মিনিটে একজন দলিতদের উপর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কোনও তথ্য প্রমাণের অপেক্ষা না করেই আমরা মনে করতে পারি অপরিকল্পিত লকডাউন ঘোষণার ফলে কীভাবে প্রশাসনের তাড়া খেয়ে হাজার হাজার নারী, পুরুষ, শিশু কয়েক শত মাইল অনাহারে ক্লিষ্ট হয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলেন। জলটুকুও জোটেনি তাঁদের। এদের বৃহৎ অংশই কিন্তু দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত। ২০২০ সালের এই তথ্যে আমরা দেখছি দলিতদের প্রতি অপরাধ সবচেয়ে বেশি ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে, সারা দেশে ঘটা মোট অপরাধের চার ভাগের এক ভাগ ১২,৭১৪টি। তার পরেই আছে বিহার, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশ। অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশের পরেই যে রাজ্যে দলিত সংখ্যা বেশি, সেই পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাটি অতি নগণ্য ৭৭৩টি। পাশাপাশি আমরা যেন ভুলে না যাই আম্বেদকরের স্মৃতিকে অসম্মানিত করতেই ৬ ডিসেম্বর তাঁর প্রয়াণ দিবসে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়।
আরও পড়ুন-আইএসএলেই খেলবে ইস্টবেঙ্গল: মুখ্যমন্ত্রী পাশে আছেন, দাবি লাল-হলুদ কর্তার
বর্তমানে গোটা দেশের নিরিখে পশ্চিমবাংলায় দলিত সম্প্রদায়ের অবস্থা অনেকটাই ভাল। তার অন্যতম প্রধান কারণ বর্তমান সরকার পশ্চিমবাংলায় দলিতদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন। বহু প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁদের অধিকারের দাবিকে সুরক্ষিত করেছেন। দলিত সাহিত্যের বিস্তার প্রসঙ্গে একদা এক বিখ্যাত লেখিকা বলেছিলেন যে পশ্চিমবঙ্গ দলিত নেই, দলিত সাহিত্য নেই। উচ্চবর্ণীয়ের এই সদম্ভ চূড়ান্ত প্রত্যখ্যানের প্রতিবাদে আজ বাংলার দলিত সমাজকে আত্মপ্রকাশের এক বৃহৎ জায়গা করে দিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০২০ সালে দলিত সাহিত্য আকাদেমি গঠন করে।
আরও পড়ুন-বায়ার্নকে ছিটকে দিল ভিয়ারিয়াল
বাংলায় দলিত জাগরণের ইতিহাস কিন্তু সুপ্রাচীন। বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক হরিচাঁদ ঠাকুর নিপীড়িত শোষিত জাতির মধ্যে নূতন প্রাণ এনেছিলেন। সংস্কারমুক্ত করে, ব্রাহ্মণ্যবাদের কবল থেকে তিনি দলিত সমাজকে উদ্ধার করে মতুয়া ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর জাতির মধ্যে শিক্ষা বিপ্লবের সূচনা করেন। এই ইতিহাস কিন্তু আমাদের কাছে অধরা ছিল। বর্তমান সরকার হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুরকে যোগ্য সম্মান দিয়ে মতুয়া মেলার দিনটি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করেছেন, ছাত্রপাঠ্য ইতিহাসে যাতে এঁদের বিষয়ে পড়ানো হয় সে ব্যবস্থা করেছেন। মনে রাখতে হবে আম্বেদকর এর সংবিধান সভায় যাওয়ার জন্য যে নির্বাচন পেরোতে হয়েছিল তা ঘটেছিল বাংলায় দলিত নেতা যোগেশ চন্দ্র মণ্ডলের সহায়তায়। বাংলা থেকে নির্বাচিত হয়েই তিনি সংবিধান সভায় যান।
আরও পড়ুন-রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ২০ বেডের স্বাস্থ্যকেন্দ্র
আম্বেদকরের স্বপ্নের অন্যতম অংশ ছিল নারীর ক্ষমতায়ন। তিনি বলেছেন কোন দেশের উন্নতির প্রধান মাপকাঠি হল সেখানে মেয়েরা কী অবস্থায় আছে। আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মেয়েদের জন্য বহু প্রকল্প চালু হয়েছে। এ রাজ্যে মেয়েরা শুধুমাত্র মেয়ে নয় তারা কন্যাশ্রী। এই প্রকল্পের সুবিধা পেয়ে আজ দিকে দিকে মেয়েরা উচ্চশিক্ষা লাভ করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। এ-সবই আম্বেদকরের স্বপ্নের সার্থক রূপায়ণ।
দেশব্যাপী স্বৈরাচারী সরকারের ঘৃণা, বিদ্বেষের পরিপূর্ণ জাতপাতের রাজনীতির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গই সেই উত্তর যেখানে সংবিধানের মর্যাদা আজও অটুট, আম্বেদকর এ-রাজ্যেই যথাযথভাবে প্রণাম পাচ্ছেন।