পাহাড় দেখতে চান? শুধু পাহাড় ভালবাসেন? না, তাহলে অন্তত চারখোলে আসবেন না।
যদি আপনার অভিমানগুলো আর গোপন না রাখতে পারেন, পাহাড়ের সঙ্গে সেগুলো শেয়ার করতে চান তাহলেই চলে আসতে পারেন চারখোল। চারদিক খোলা পাহাড়। কালিম্পং থেকে মাত্র এক ঘণ্টার পাহাড়ি পথ। রেলি নদীর পাড়ে সামালবং অঞ্চলের ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। লোলেগাঁও থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। প্রায় ৫০০০ ফুট উচ্চতায় পাইন, সাইপ্রাস, ওক, শাক, গুরাস আর বরফঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ন্যাওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের কোলে এখানে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের হিমালয়ান পাখি। পথে যেতে যেতে পাহাড়ি সবুজ আপনাকে সাময়িক স্বস্তি দেবে। চোখের শীতলপাটি হয়ে উঠবে পাহাড়ি বুনো ফুল। শহরের ক্লান্তি আর মন খারাপ নিয়ে যদি ঘুমিয়েও পড়েন, ভোর হতে না হতেই দেখবেন আপনার সামনে বুদ্ধ ঘুমিয়ে আছে। সূর্যের আলো এসে ডাকছে বুদ্ধকে। আপনাকেও। বিছানায় শুয়ে অনাবিল জিজ্ঞাসাগুলো সেরে নিতে পারেন। অভিমানগুলো বন্ধক রাখতে পারেন কাঞ্চনজঙ্ঘার কাছে। অহিংসার কথাগুলো গেঁথে নিতে পারেন আরও একবার।
আরও পড়ুন-তোপ দেগে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং’ হল ‘বিজেপির উস্কানি কমিটি’
পাহাড়ি এই অভিমানের কাব্যটা শুরুতেই স্বস্তি দেবে ভোরের নাথু লা। ভারত-চিন সম্পর্কের কথা আপনাকে ভুলিয়ে দেবে নিমেষেই। বরফ-ঢাকা পাহাড়চূড়াই মনে হয় সম্পর্কের বরফ গলাতে পারে। চারখোল-এ সাতসকালে আপনার বাঁ চোখ আটকে যাবে স্লিপিং বুদ্ধতে। আর ডান চোখ নাথু লাতে। আর বারান্দায় বসে লবঙ্গ দেওয়া লাল-চা বা ডার্ক কফি বলে দেবে পিকচার আভি বাকি হ্যায় দোস্ত!
সকালের খাবার টেবিলে আলুর পরোটা। ডবল ডিমের ওমলেট। আর কয়েক মুঠো মুগ্ধতা আর আতিথেয়তা। খাবার শেষ করে দু-এক পা হেঁটেই পরিত্যক্ত মনাস্ট্রি ঘুরে নিয়ে সোজা পাশের পাহাড়ি গ্রাম কাফের গাঁও। ছোট ছোট পায়ে হেঁটে ট্রেক করে পাইন ফরেস্ট। অপূর্ব ট্রেকের পথ। তবে গাইডের তারিফ না করে উপায় নেই। ১৩ বছরের অঙ্কিত তামাং আর ১৪ বছরের শালিনা তামাং। স্কুল ছুটি তাই আমাদের পথ দেখাতে সে কী উৎসাহ! চারখোল থেকে পাইন ফরেস্ট ৪০ মিনিটের হাঁটাপথ। পুঁচকে গাইডের সাহসে পৌঁছে যাওয়া কোনও ব্যাপারই নয়। ওদের কাছে তো এই ট্রেক জলভাত। ওরা প্রতিদিন চারখোল থেকে এক ঘণ্টা হেঁটে ঢালু পথে স্কুল যায়। বাড়ি ফেরে উৎরাই পথে দু’ঘণ্টায়।
আরও পড়ুন-নতুন ক্লাবের জার্সিতে সেরাটাই দেব : মেসি
এই পাহাড়ি গ্রামের একদিকে কালিম্পংয়ের পাহাড়, অন্যদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। এখান থেকে দেখা যায় শিলিগুড়ির সমতল। সব মিলিয়ে মেঘ, নীল আকাশ আর পাইনের ক্যানভাস তৈরি করে চারখোল। প্রতিবেশী ঝান্ডিদারা ভিউ পয়েন্ট থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত মন ভরিয়ে দেবে।
ঠিক সন্ধে নামার আগেই চারখোল হয়ে ওঠে রূপবতী রাজকন্যে। সেজে ওঠে রুপোলি নরম আলোয়। অন্ধকারের পরে জ্বলে ওঠে হাজার বাতি। রাতের আলো যেন ১২০ ঘরের এই পাহাড়ি গ্রামের প্রতিদিনের দীপাবলি। চারখোল থেকেই প্রতি রাতের শিলিগুড়ি, সিতং, আলগোরা, কালিম্পংয়ে আকাশপ্রদীপ জ্বলতে থাকে।
আরও পড়ুন-২১ জুলাই ‘শ্রদ্ধা দিবস’ হিসেবে পালন করবে তৃণমূল, ঘোষণা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
রাতের খাওয়ার পরে অন্য হোটেলের রাঁধুনি শ্যাম গুরুংকে নিয়ে রাতের চারখোল দেখে আসা অন্য অনুভূতি। নরম চাঁদের আলোয় এবার পাহাড়ি পথকে আপন করে চলেছে শ্যাম। কেষ্টপুরে কিছুদিন, কল্যাণীতে কিছুদিন প্রহরীর কাজ করেছে শ্যাম। কিন্তু শহরের উষ্ণতা ওকে থাকতে দেয়নি হলদি নদীর তীরে। ফিরে এসেছে চারখোলে। এখন হোম-স্টেতে রান্নার কাজ করে। তাতে পয়সাও বেশি আসে। অফ সিজনে খেতির কাজ করে। শহুরে ভাষায় অর্গানিক ফার্মিং। এখানে আলু, পেঁয়াজ, বাঁধাকপি, স্কোয়াশ আর কিছু লোকাল সবজির চাষ হয়। তবে গুন্ডুশাকের বিশেষত্ব তার পুষ্টি-গুণে। গুন্ডুশাকের ঝোল পেট ঠান্ডা রাখে। অনেকটা নাকি আমাদের জলঢালা পান্তাভাতের মতো। গুন্ডুশাকের লোকাল স্যুপ অনবদ্য। চাটনিও। এ-রান্নায় মুনশিয়ানা আছে হোম-স্টের রাঁধুনিদের।
আরও পড়ুন-‘মানুষের এই রায় দেখার পর রাজ্যপালের আর পদে থাকা উচিত নয়’ ক্ষোভ কুণাল ঘোষের
তবে চারখোলের আটপৌরে জীবনযন্ত্রণার কথা যখন শ্যাম বলে চলেছে হালকা চাঁদের আলোয় প্রকৃতি তখন উজাড় করে দিচ্ছে তার রূপ। ফিলফিলে গাছের নিচে বয়ে চলেছে খোলা হাওয়া। পাতায় পাতায় চাঁদের আলোয় সুর উঠেছে। সামনে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে পাইন। দূরে সোনালি আলোর বাতি জ্বলছে। রাতের শিলিগুড়িতে। যেন গোল্ডেন ভিলেজ। একটু হেঁটে এসেই অন্যদিকে আবার ডায়মন্ডছটা। এবার রুপোলি মায়াবী আলোর মেলা। রাতের কালিম্পং, আলগরা আর পেডং। রাতের হিমেল হাওয়ার চারখোল যেন আলোর ক্যানভাস। আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল, কালপুরুষ আর রাতের তারার দল চাইলে আপনার সঙ্গে রাতও জাগতে পারে।
আরও পড়ুন-শোক মুখ্যমন্ত্রীর, সুখেন্দুশেখরের স্ত্রী প্রয়াত
কখনও সারাদিন পাখিদের সঙ্গে গল্প করেছেন? ওদের পাহাড়ি গান শুনেছেন? তা হলে হাতে সময় নিয়ে চলে আসতে পারেন আপার সাংসে। সাংসে পাহাড়ের একেবারে উপরে। আলজার-এর হোম-স্টে থেকে নিচে তাকালেই সুন্দরী তন্বী ছিপছিপে তিস্তা। আর উপরে দিগন্ত প্রসারিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। হোম-স্টের লনে বসে সময় কেটে যাবে। বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে। ৫৬ পরিবারের আপার সাংসে-সমাজ একসঙ্গে ভাবে সমাজের কথা। এই আপার সাংসে থেকে হেঁটেই পৌঁছনো যায় ব্রিটিশ বাংলো ভিউ পয়েন্টে। তবে পথে দেখা মিলবে নানা রঙের পাখিদের সঙ্গে। রকমারি তাদের ডাক। নীল আকাশ, সবুজ পাহাড় আর মন ভুলানো পাখির সঙ্গ। দেখা মিলবে বিরুপদুরা আর মঙ্গলদুরার সরল পাহাড়ি মানুষদের সঙ্গে।
আরও পড়ুন-মনোনয়ন পেশ তৃণমূল প্রার্থীদের
সন্ধ্যা নামলেই সাংসে অন্য রূপ নিয়ে সেজে ওঠে। রামদাল স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে ছোটরা। রাত যত গভীর হয় আলো জ্বলে ওঠে সিকিমের নথাং-এর। তার একটু দূরে পরিষ্কার চোখে পড়ে ফিকালে গাঁও আর দার্জিলিংয়ের সাঁঝবাতি।
কিন্তু সাংসের এই পাহাড়ি গ্রামের মানুষগুলোর রূপকথার নটেগাছটা মুড়িয়ে যায় অফ সিজনে। কাজের জন্যে ছুটে যেতে হয় ভুটানের তোদে তাংটা। সেখানে বড় এলাচ-এর খেতিতে তারা কাজ করে। আবার ফিরে আসে পরিযায়ী পাখির মতো পর্যটক এলে।
সময় পেলে আপনিও একবার ঘুরে আসুন। থেকে আসুন ওদের সঙ্গে। মন ভাল হবেই।