ক’টামাত্র ঘটনা উদাহরণস্বরূপ এখানে তুলে ধরতে পারলাম। কিন্তু এরকম অজস্র উদাহরণ ঘটনা আমাদের চারপাশে অবিরত ঘটতে থাকে, যা খবরের ফল্গুধারায় ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে আবার মিলিয়েও যায়। ক’টাই বা মনে রাখি। কিন্তু নিতান্ত অনাদরের লক্ষ্মীদের আমরা সত্যিই মনে রাখি না। অথচ আমাদের ব্যস্ত জীবনে এই লক্ষ্মীরাই এক এক সময় ছাপ রেখে যায়। এখানে পাহাড়- জঙ্গলমহল— নদীর কোলে থাকা কয়েকজন লক্ষ্মীর কথা বলব যারা অনাদরে থাকলেও আমার জীবনে আমার জীবন আলো করে আছেন।
আরও পড়ুন-তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বশাসনে ভারতীয় কান্ডারিরা
২০১৭ সালের তথাকথিত গোর্খা আন্দোলনের সময় দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং ও মিরিকে জনজীবন সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কাজ করতে গিয়ে আমরা সাংবাদিকরা পড়েছিলাম মহা ফাঁপরে। একে তো যেখানে থাকি সেই বাংলোয় কর্মীরা কাজে আসছেন না। কোনোক্রমে একটি ক্যান্টিন খোলা, সেখানেই সামান্য খাবার রাতের বেলায় পেতাম। কিন্তু সকালে-দুপুরে কী খাব। বেশিরভাগ সময় ম্যাগিই ভরসা। অনেক সময় রাতেও তাই। সকালে খালি পেটে আর কতক্ষণ টানা যায়। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার ফতোয়ায় পাহাড়ে সব দোকান বন্ধ৷ কোনও গাড়িও শিলিগুড়ি থেকে উঠছে না। কিন্তু দিনভর পাহাড়ের এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে হয় খবরের তাগিদে। ঘুরে ফিরে আড্ডা সেই চকবাজারে। সব দোকান বন্ধ দেখে আমরা নিকিতাকে অনুরোধ করি সে যদি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে। বিন্দুমাত্র না ভেবে নিকিতা রাজি হয়ে যায়।
আরও পড়ুন-লক্ষ্মীপ্যাঁচা, লক্ষ্মীর প্যাঁচা নাকি প্যাঁচাই লক্ষ্মী
শাটার নামিয়ে ভিতরে আমাদের মোমো বানিয়ে দিত। চা দিত। কিন্তু সেটা বিমল গুরুং-এর লোকজন টের পেয়ে যায়। আচমকা ওদের একটা দল এসে দোকান ভাঙচুর করতে যায়। নিকিতাকেও ব্যাপক চমকায়। শুনলে আশ্চর্য হতে হয় তখন পাহাড়ে বিমল গুরুং-এর লোকজনের ভয়নাক দাপটেও নিকিতা টলে যায়নি। ওদের মুখের ওপর বলেছিল, সব দোকান তো তোমরা জোর করে বন্ধ করে দিয়েছ। আমি না খেতে দিলে আমার রিপোর্টার ভাইরা কী খাবে। আর ওরা না থাকলে তোমাদের খবর কে করবে। এরপরে নিকাতাকে ওরা শাসিয়ে যায় দোকান খুললে দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। তাতেও ভয় না পেয়ে নিকিতা আমাদের বলেছিল, ওরা যা পারে করুক আমি তোমাদের খাবার দেব। দিয়েও ছিল। যদিও পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে আমরা জিজেএমের ওপর মহলে বলে নিকিতার দোকান চালু রেখেছিলাম। কিন্তু পাহাড়ের ঐ আগুনে সময় নিতান্ত সাধারণ একটি মেয়ে যেভাবে নিজের তোয়াক্কা না করে আমাদের জন্য ওর নিজের লোকেদের বিপরতে গিয়েছিল তা দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম। নিকিতা ওর পরিবারের লক্ষ্মী তো ছিলই সঙ্গে আমাদেরও কাছেও ও ছিল পাহাড়ি লক্ষ্মী মেয়ে।
আরও পড়ুন-লক্ষ্মী মেয়ের আজ কোনও লক্ষ্মণরেখা নেই
এই পাহাড়েই বিমল গুরুং-এর দলবলের হাতে পড়ে প্রাণ যেতে বসেছিল আমাদের সাংবাদিকদের। পাতলেবাসের দিক থেকে খুকরি ও আগ্নেয়াস্ত্র সমেত পুলিশকে তাড়া করে আসা শদুয়েক ভিড়টার সামনে পড়ে যাই আমরা। পুলিশের সঙ্গে গুলিযুদ্ধ চলছে। কার্বাইন থেকে সমানে ফায়ারিং চলছে। এরই মধ্যে অন্তত ডিএম-এসপির গাড়ি সমেত গোটা চল্লিশেক গাড়ি পেট্রোল বোমা মেরে জ্বালিয়ে দিয়েছে হুলিগানরা। চোখের সামনে জ্বালাতে দেখেছি সিংমারি পুলিশ আউটপোস্ট। এসব কভার করতে গিয়ে আমরা কয়েকজন পুলিশ আর হুলিগানদের মাঝে আটকে গিয়েছিলাম। বেরোনোর কোনও উপায় নেই। একটু আগে আমাকে লক্ষ্য করে পাথর আর পেট্রোল বোমা ছোঁড়া হয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ফোটাগ্রাফার পার্থদা না বাঁচালে এই স্মৃতিচারণের সুযোগ হত না।
আরও পড়ুন-বলি থেকে টলি বয়কট ট্রেন্ডে নাকাল সবাই
সিংমারি আউটপোস্টের সামনে পাথর আর আর তাড়া খেতে খেতে তখন চক্রব্যুহে আটকে গিয়েছি, আর এগোনোর বা পিছনোর উপায় নেই। ওদের হাতে পড়লে মৃত্যু অনিবার্য। ঠিক এইসময় একটা গ্রিলের দরজার ওপাশ থেকে এক মহিলা মুখ বাড়িয়ে বললেন, আপলোগ ইধার আজাইয়ে। দরজা খুলে আমাদের কয়েকজনকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিলেন৷ সোজা নিয়ে গিয়ে তাঁর রান্না ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, আওয়াজ মাত কিজিয়েগা। ওহলোগ জাননেসে মেরা পুরা পরিবারকো মার দেগা। মেরি টুইন বেবি হেয়। আমরা সকলে বিস্মিত। কিন্তু সেদিন বিবাহসূত্রে স্বামীর সঙ্গে পাহাড়ে আসা ঐ দক্ষিণ ভারতীয় মহিলা না আশ্রয় দিলে আমরা বেঁচে ফিরতাম না এটুকু নিশ্চিত।
আরও পড়ুন-আটমাসের শিশুকন্যা-সহ ভারতীয় বংশোদ্ভূত চারজনকে অপহরণ করে খুন
এনডিআরএফর স্পিডবোট দেখতে পেয়ে গ্রামের বেশকিছু লোকজন ছুটে এসেছে। এদের মধ্যে কিছু নানা বয়সি কচিকাঁচাও রয়েছে। পাড়ে বোট ভেড়ানো হল। আমাদের সঙ্গে প্যাকেট করা মুড়ি- চিঁড়ে-গুড় আর জলের বোতল ছিল। সব ক’টি বোটেই এগুলো রাখা হয়েছিল। আমরা মানে আমি— সঙ্গী ক্যামেরাম্যান আর এনডিআরএফের টিম সন্দেশখালি এসে পৌঁছেছিলাম আয়লা আছড়ে পড়ার ৪৮ ঘণ্টা বাদে। এই দুটো দিন মানুষগুলো কিচ্ছু পায়নি। সকলেই অভুক্ত। বাড়ি-ঘর বলতে কিছু নেই। সব গেছে ঝড়ে। যেটুকু বেঁচে ছিল গিলে খেয়েছে বাঁধ ভাঙা নদীর জল। খাবার না পেয়ে যে করে হোক দুটো দিন কাটিয়েছেন। কিন্তু জল! গ্রামের টিউবয়েলগুলো গিয়েছে ডুবে। একফোঁটা খাওয়ার জল নেই কোথাও। সব থেকে শোচনীয় অবস্থা শিশুদের। খাবার না পেয়ে কেউ কেউ সমানে কেঁদেই চলেছে। আমাদের বোটের ওপর প্রায় হামলেই পড়ল গ্রামবাসীরা। খাবার-জল যা ছিল দিয়ে দেওয়া হল সব। এসব নিতে গিয়ে নিজেদের মধ্যেই মারামারি লেগে গেল। বড়দের খাবার যুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই ছোটরা পেরে উঠছিল না। কিন্তু অনেক ছোট ছোট হাত সামনে বাড়াচ্ছিল মুড়ি আর জলের জন্য। আমরাও যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম ঐ ছোটরাও যাতে খাবার-জল পায়। পরে গলাজল ঠেলে গ্রামের ভিতরে গিয়ে দেখেছিলাম কী ভয়াবহ পরিস্থিতি। বাড়ি-ঘর বলতে কিছু নেই। দু-একটা যা আছে তাও ডুব দিয়েছে জলে। কেউ কেউ মাচা বেঁধে তাতে উঠে বসেছে। গোটা পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে আরও বেশি ফোর্স ও খাবার-জলের প্রয়োজনের কথা ওপর মহলে জানানো দরকার। ঘণ্টা তিনেক ধরে সব দেখেশুনে এবার আমাদের ফেরার পালা।
আরও পড়ুন-মালবাজারের ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে উঠে এল তথ্য
গ্রাম থেকে বেরিয়ে সরু বাঁধ ধরে হেঁটে এসে স্পিডবোটে উঠব তখনও ঐ মানুষগুলো ওখানেই বসে৷ বোঝা গ্রামে ঢোকার আগে এই বাঁধের উপরেই একটি শিশুকে দেখেছিলাম উদোম হয়ে বসে আছে। শরীরে একটা কিছু নেই। খোলা আকাশের নীচে মাটিতে বসে। হাতে কেউ একটা বিস্কুট ধরিয়ে দিয়েছে। সে এতটাই ছোট যে ঠিকমতো খেতে পারে না। প্রথমে ঐ ভিড় আর কাড়াকাড়ির মাঝে একঝলক ওকে চোখে পড়লেও সেভাবে খেয়াল করিনি৷ বোটে যখন উঠছি তখনও সে একই জায়গায় ওভাবে বসে। কাঁদছে। অথচ ঐ শিশুটিকে দেখেও কেউ দেখছে না। যে যার তালে ব্যস্ত। আমাদের দেখতে পেয়ে এবার আচমকা শিশুটি হাত বাড়াল। এগিয়ে আসতে চাইল৷ কিন্তু হাঁটতে শেখেনি। ফলে অসহায় ছোট হাত দুটো দিয়েই প্রাণপনে আমাদের কাছে আসতে চাইছে। এবার কয়েকজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম বাচ্চাটা ওভাবে বসে আছে, ওর মা-বাবা কোথায়। গায়ে একটা জামাকাপড় নেই। খোলা আকাশের নীচে এভাবে ফেলে রেখেছে! এবার যা শুনলাম তা ভয়াবহ। যখন আয়লা আছড়ে পড়ছিল ঘর ভেঙে পড়ায় ওকে নিয়ে অনেকের মতো বাঁধের ওপর আশ্রয় নেওয়ার জন্য ছুটছিল ওর মা। পিছনে বাবা। গাছ পড়ে গুরুতর আহত হন তিনি। বাচ্চাটাকে পাড়েই প্রতিবেশীর কাছে দিয়ে ঝড় থামার পর ডিঙি নৌকো নিয়ে উত্তাল নদীতে স্বামীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাওয়ার তোড়জোড় করেন।
আরও পড়ুন-বলি থেকে টলি বয়কট ট্রেন্ডে নাকাল সবাই
অনেকেই বারণ করেছিলেন। স্বামীর ঐ অবস্থা দেখে মহিলা কারো কথা শোনেনি। সেই যে গিয়েছেন আর ফেরেননি। পরে গ্রামের কয়েকজন খবর দেয় উত্তাল নদীতে সামাল দিতে না পেরে নৌকো সমেত ভেসে যান দুজনেই। নদীতে তাদের দেহ ভাসতে দেখা গেছে আরও অনেক হতভাগ্যের মতো। শুনি স্তম্ভিত আমি ওদের জিজ্ঞেস করি তাহলে ওর কী হবে। কে দেখছে ওকে? কে আর দেখবে। সকলে এখন নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত সবারই তো এক অবস্থা। চাল-চুলো সব গেছে। নিজেদের ছেলেমেয়েদের দেখব নাকি ওকে দেখব। এই কথোপকথন যখন চলছে তখনও অসহায় ছোট হাত দুটো বাড়িয়েই রয়েছে সে। কাছে গিয়ে একটা ছোট জলের বোতল আর মুড়ির প্যাকেট দিলাম ওকে। কিন্তু দিলে কী হবে এসব তো সে খুলে খেতেও পারবে না। তাহলে? কী করা যায় একে নিয়ে যখন ভাবছি, আচমকাই এক মহিলা ছুটে এসে ওর সামনে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে বললেন, এগুলো থাক এখানে। আমি খাইয়ে দেব। ও তো নিজে খেতে শেখেনি। ফিসফিস করে বললেন, গত দুূদিন ধরে আমিই ওকে নজরে রেখেছি। আমার নিজের দুটো ছোট বাচ্চা রয়েছে। স্বামীর তেমন রোজগার নেই৷ তারওপর ঝড়ে ঘরবাড়ি সব গেছে।
আরও পড়ুন-মেক্সিকোতে বন্দুকবাজের হানা, মৃত মেয়র-সহ ১৮
কোনওরকমে তাঁবু খাটিয়ে আর সকলের মতো এই বাঁধের উপরেই আছি। আমার স্বামী চায় না আমি ওকে নিয়ে বেশি বাড়বাড়ি করি। চলবে কী করে। কিন্তু ওকে ফেলে দিই কী করে। তাই স্বামীর চোখ এড়িয়ে ওকে মাঝেমধ্যে দেখভাল করছি। সব ঝামেলা মিটে গেলে স্বামীকে বুঝিয়ে ওকে ঘরে নিয়ে যাব ভেবেছি। এইটুকু দুধের শিশুকে কীভাবে ছেড়ে দিই বলুন। ওর গাটা গরম দেখছি সকাল থেকে। জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে। ওষুধ দরকার। আর একটু দুধ৷ না হলে এসব মুড়ি-বিস্কুট দিয়ে কী আর ওর চলে। মাঝেমধ্যেই খিদের জ্বালায় কাঁদছে। আজ ওকে নিয়ে আমার কাছেই ঘুম পাড়াব তাতে যা হবার হবে। এভাবে খোলা আকাশের নীচে পড়ে থাকলে ও বাঁচবে না। আচমকা চোয়াল শক্ত করে কথাগুলি বললেন ঐ মহিলা। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। আর কীই বা করতে পারতাম। চোখের সামনে এক মাকে দেখছিলাম যে নিজের না হলেও সদ্য মা-বাবা হারানো এক দুধের শিশুকে নিজের করে নিতে বদ্ধপরিকর শত ঝামেলা সত্যেও। একে কী বলবেন শুধু মা? না আমার কাছে ইনি হলেন লক্ষ্মী মা। আসলে কোন রূপে যে লক্ষ্মী আমার আপনার সামনে কখন ধরা দেবেন আমরা কেউ জানি না।
আরও পড়ুন-আটমাসের শিশুকন্যা-সহ ভারতীয় বংশোদ্ভূত চারজনকে অপহরণ করে খুন
পেশার সূত্রে বহুবার এসেছি। আবার এলাম ঝাড়গ্রাম। বেলপাহাড়ি, বাঁশপাহাড়ি, কাঁটাপাহাড়ি, বিনপুর সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে নামগুলো রাজ্যবাসীর চেনা। লকডাউনে কেমন আছেন এখানকার মানুষজন একটু ঘুরে দেখা। এর সঙ্গে একবার দেখে নেওয়া শবরদের এলাকাটাও। কার্যত নিজেদের গুটিয়ে রাখা এই বিশেষ শ্রেণির মানুষগুলি কেমন আছেন এই লকডাউনে। কী খাচ্ছেন কী পরছেন একবার দেখা দরকার। ওষুধই বা কোথা থেকে আনছেন। এসবের খোঁজ করতে গিয়ে পৌঁছে গেলাম শবর মহল্লায়। গিয়ে দেখলাম এরা নিজেদের জীবনে নিজেরা মেতে আছে। কোভিড খুব একটা বদল আনতে পারেনি তাদের রোজকার নেশাতুর জীবনে। সেই যা পাওয়া তাই খাওয়া কেউ দিলে তা দিয়ে চলা। আর লকডাউনের সময় কোথাও কোথাও থেকে প্রশাসনের তরফে কিছু পাওয়া যাচ্ছে। এই যা ভরসা। চারিদিক কেমন নিঝুম মেরে আছে। প্রচণ্ড রোদ-গরম এসব নিয়েই ঢুকেছি শবরদের ডেরায়। চাষাবাদ এরা কোনও কালেই করে না। লকডাউনে তো তার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু কী করে যেন নেশার সামগ্রী ঠিক জুটে যায় এই বন বাদাড়ে। কিন্তু বাচ্চাগুলো, তারা তো নেশা করে না। বাপ মায়ের রোজকার নেশাতুর জীবনের খেসারত দিতে হয় তাদেরকে। এদের মধ্যে কেউ কেউ স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। মিড-ডে মিল পেত। খানিকটা ঐ লোভেও স্কুলে যেত এরা। কিন্তু লকডাউনে সেসব চুলোয় গেছে। এখন যদি মা রান্না করে ঘরে তাহলে শাকভাত হয়। জঙ্গল থেকে আনা কচু, শাক। তাই-বা কম কী। মাঝে-মধ্যে পিঁপড়ের ডিম জঙ্গল থেকে ভেঙে আনে মরদ। মহাজন এসে তা নিয়ে যেত দাম দিয়ে। লকডাউনে তা-ও বন্ধ।
আরও পড়ুন-বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে ধাক্কা খেল মোষের পাল
এসব দেখেশুনে ক্যামেরাবন্দি চলতে লাগল। দুই একজনের সঙ্গে কথা বলা যায় কিনা তা খোঁজ করতে গিয়ে আরও ভেতরে ঢোকা। কিন্তু কথা বলবেটা কে। সব দুয়ারে নেশাতুর চোখে বসে। ভয়াবহ এই অতিমারির সময় কারও শরীর খারাপ হলে কী হবে। এসব ভাবতে ভাবতে আচমকা কখন যে নিজেরই মাথা ঘুরতে শুরু করছে টের পাইনি। ব্ল্যাক আউট হওয়ার আগেই আমার সহকর্মী ক্যামেরাম্যান তা বুঝতে পেরে আমায় ধরে ফেলে। জঙ্গলের ভিতর তখন দরকার একটু জলের। কিন্তু কে দেবে। গাছের নিচে বসে যখন খানিক সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছি, তখনই একটা জলের বোতল হাতে এগিয়ে আসছেন অবিন্যস্ত ভাবে আলুথালু বেশের এক শবর মহিলা। কিছু না বলে শুধু জলের বোতলটা এগিয়ে দিলেন। চোখে মুখে খানিকটা জল দেওয়া গেল। একটু সামলে নিয়ে তাকিয়ে দেখি তিনি তখনও দাঁড়িয়েই রয়েছেন। একটু আগেই যাকে দেখেছি নেশাতুর অবস্থায় ঘরের দরজায় বসে থাকতে। হাতের বুম বাড়িয়ে দিয়েও কোনও কথা বলাতে পারিনি তখন। আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি দেখে সেই শবর মহিলাই নিজে এগিয়ে এসেছেন জল দিতে। একে কী বলবেন? বিষয়টা আপাতদৃষ্টিতে হয়তো কিছু নয়। কিন্তু একজন তথাকথিত সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা শবর মহিলার দিক থেকে ভাবতে গেলে এর গভীরতা অনেক অনেক বেশি। আমার কাছে ইনি লক্ষ্মী শবর। যিনি তথাকথিত সভ্য সমাজের লক্ষ্মীদের থেকে কোনও অংশে কম নন। তাঁর বাহ্যিক ঠাটবাট শহুরে আদব-কায়দা- শিক্ষা জেল্লা এসব হয়তো নেই। কিন্তু আছে মানবিক বোধ-মনুষ্যত্ব। আজকের সমাজে যা ক্রমশ বিরল প্রজাতির হয়ে উঠছে।