মণীশ কীর্তনীয়া: বাদাবনে জল-জঙ্গলে ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমিরের সঙ্গে ঘর-করা বাংলার শেষ সীমানার প্রান্তিক মানুষদের মন এক লহমায় জয় করে নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই সঙ্গে ১৫ হাজার মানুষের জন্য আনা শীতবস্ত্র নিয়ে চূড়ান্ত প্রশাসনিক গাফিলতির জন্য প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য মঞ্চেই জেলাশাসক-সহ আমলা-অফিসারদের তীব্র ভর্ৎসনা করলেন। বুঝিয়ে দিলেন, সাধারণ মানুষের কাজে গাফিলতি হলে তিনি বরদাস্ত করবেন না। অ্যাকশন নিয়ে নেবেন।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর উৎসাহে তথ্যচিত্রে কানন দেবী
এই রুদ্রমূর্তির পাশাপাশি আরও এক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখল হিঙ্গলগঞ্জের সামশেরনগর, হেমনগর, ঝিঙেখালি-সহ সংলগ্ন ৫টি দ্বীপের মানুষজন— কোনও অবস্থাতেই উন্নয়নের সঙ্গে আপস করবে না তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার। ঢালাও উন্নয়নই যে মুখ্যমন্ত্রীর পাখির চোখ মঙ্গলবার জল-জঙ্গলে বাস-করা মানুষগুলোর সামনে আরও একবার পরিষ্কার করে দিলেন তিনি। এর আগে নদিয়া সফরে গিয়ে বলেছিলেন, এবার সুন্দরবনের মাটিতে দাঁড়িয়েই ঘোষণা করলেন— বাদাবনের মানুষদের সুবিধার্থেই সুন্দরবন আলাদা জেলা হবে। সেই সঙ্গে এখানকার মানুষদের সুচিকিৎসার জন্য হবে একাধিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
আরও পড়ুন-ভারতের আজ সিরিজ রক্ষার ম্যাচ
এদিন হিঙ্গলগঞ্জের সামশেরনগরে সরকারি পরিষেবা প্রদান অনুষ্ঠানে উপভোক্তদের হাতে বিভিন্ন প্রকল্পের সহায়তা তুলে দেওয়ার সময় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আমি আপনাদের জন্য পনেরো হাজার শীতবস্ত্র এনেছি। কিন্তু সেগুলো কোথায়, দেখছি না কেন? পিছন ঘুরে সটান প্রশ্ন করেন জেলাশাসক শরথ দ্বিবেদীকে। কম্বল, চাদর ও সোয়েটার এনেছি। সেগুলো এখানে আসেনি কেন? জেলাশাসক উত্তর দেন, শীতবস্ত্র বিডিও অফিসে রাখা আছে। এ-কথা শুনে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, কয়েকটা তো আনা যেত, আমি হাতে করে দিতাম বাকিগুলো আপনারা ক্যাম্প করে দিতেন। এরপরই জেলাশাসককে তিনি নির্দেশ দেন, এখুনি শীতবস্ত্রগুলি বিডিও অফিস থেকে আনান। যতক্ষণ না শীতবস্ত্র আসছে আমি মঞ্চেই বসলাম। সামনের উপচে পড়া জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারাও বসুন। সভা বন্ধ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চেই বসে পড়েন। ফাঁপরে পড়ে তখন জেলাশাসক শীতবস্ত্র আনতে পাঠান।
আরও পড়ুন-কেন হয় ইস্কেমিক স্ট্রোক?
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, মানুষকে একটা জিনিস দিলে, সেটা না পৌঁছলে খারাপ লাগে। গায়ে জ্বালা ধরে। আমি বলার পরেও এখানে পৌঁছয়নি কেন? আমি তো বলেছি সরাসরি দেব। কারও মারফত নয়। এরপরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, পুলিস কিছু করলে অফিসাররা কিছু করলে আমার দোষ হয়। অথচ আমি কিছুই জানি না! তৎক্ষণাৎ জেলা প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, জেলাশাসক, বিডিও, এসডিও, থানার আইসি-ওসি এবং অফিসাররা ঠিকমতো কাজ না করলে আমি তাঁদের বিরুদ্ধে অ্যাকশান নিয়ে নেব। যখন তিনি ডিএম-সহ বাকি অফিসারদের কার্যত প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছেন আর জবাবদিহি চাইছেন তখন তাঁদেরই হয়ে মুখ্যমন্ত্রী সওয়াল করছেন দেখে আপ্লুত জনতার মধ্যে তুমুল হাততালির ঝড় ওঠে। এমনিতেই মানুষগুলো সেই সাতসকালে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখবেন, তাঁর কথা শুনবেন বলে। তারপর চোখের সামনে দেখছেন একজন মুখ্যমন্ত্রী জেলাশাসক-সহ গোটা টিমকে কাজে গালফিলতির জন্য মঞ্চেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছেন। যা দেখে স্বতঃস্ফূর্ত জনতা হাততালির ঝড়ে বুঝিয়ে দেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের মন জয় করে নিয়েছেন। প্রায় আধঘণ্টা মঞ্চে বসে থাকার পর কিছু শীতবস্ত্র এসে পৌঁছয়। এরপর একহাজার মহিলার হাতে তা তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গে ঘোষণা করেন, বাকিটা আজ বুধবার বেলা ১২টা থেকে ১০-১২টা ক্যাম্প করে দেওয়া হবে। স্থানীয় সব মানুষ পাবেন প্রয়োজনে কুড়ি হাজার শীতবস্ত্র দেবেন। বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামী-সহ বাকিরা নজর রাখবেন। আবার হাততালির ঝড়। এদিনের সভায় মহিলাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
আরও পড়ুন-জন্ম-মৃত্যু নথিভুক্তি আসছে নতুন বিল
এদিন প্রায় ৬০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। যার মধ্যে ৯টি সেতু রয়েছে। এই অঞ্চলে দুয়ারে সরকার ক্যাম্প হয়েছে কি না জনতাকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে এখানে হয়নি। অনেকটা দূরে হয়েছে। আবারও তাঁর নির্দেশ, দরকারে দু’বার দুয়ারে সরকার ক্যাম্প করতে হবে। তাঁর কথায়, এই জন্যই আমি সুন্দরবনকে আলাদা জেলা করছি। এতে প্রশাসনিক কাজে সুবিধা হবে। সুন্দরবন নিয়ে মাস্টার প্ল্যান করছি যা কেন্দ্রকে পাঠাব। অনুমোদন এলে প্রতিবছর সাইক্লোন আর নদীভাঙনে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বাঁধ মেরামতি হবে। এখানকার পরিবহণ-ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজার নির্দেশ দেন। বাসের সংখ্যা বাড়াতে বলেন। তাঁর সরকার হাসনাবাদ-বনবিবি সেতু, হাসনাবাদ-যোগেশগঞ্জ দীর্ঘ পিচরাস্তা করে দিয়েছে বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী। উপস্থিত জনতাকে বলেন, অবশ্যই ভোটার তালিকায় নাম তুলবেন দুয়ারে সরকার ক্যাম্পে গিয়ে। কেউ আধার কার্ড চাইলে থাকলেও দেবেন না, বলবেন নেই। তবুও নামটা তুলতে হবে।
আরও পড়ুন-ধর্ষিতা নাবালিকাকে ফের ধর্ষণ শিক্ষকের!
বুধবার হেলিকপ্টারে হিঙ্গলগঞ্জ পৌঁছনোর পর প্রথমে বনবিবির মন্দিরে পুজো দেন। মুখ্যসচিব ও জেলাশাসককে নির্দেশ দেন, সরকারের তরফে মন্দিরটি পাকাভাবে তৈরি করে দেওয়ার। এদিনের সভায় স্থানীয় বিধায়ক ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন, বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, সাংসদ নুসরত জাহান-সহ জেলার অন্যান্য জনপ্রতিনিধিরা। বনবিবির পাকামন্দির তৈরি হয়ে গেলে তিনি আবার আসবেন বলে জানিয়ে গেলেন। আজ তিনি টাকিতে রাত্রিবাস করবেন।