পদক এল। ধুমধাম করে সংবর্ধনা হল। ছবি উঠল। টিভিতে দেখা গেল। কাগজে ছবি বেরোল। তারপর আর একটা অচিন্ত্য শিউলি ন্যূনতম খেলার সাজ-সরঞ্জাম না পেয়েও নিজের উদ্যোগে উঠে এল। এরাই পরে বিশ্ব মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ায়। খুব খারাপ লাগে যখন দেখি বারবেলের বদলে বাঁশ বা ম্যাট্রেস না পেয়ে মাটি কুপিয়ে তাতেই কুস্তির অনুশীলন হচ্ছে। মন খারাপ হয়ে যায়। আমরা অলিম্পিকে পদক চাইব, কিন্তু পাশে থাকব না।
আরও পড়ুন-ক্রীড়াবিদদের কলমে জাতীয় ক্রীড়াদিবস
বলা হচ্ছে, তোমাদের উন্নত অনুশীলনের ব্যবস্থা করব। শুনেই যাচ্ছি। আমি যখন ফুটবল খেলেছি, তখন কিচ্ছু পাইনি। মেনে নিলাম। সে তো চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগের কথা। পরিকাঠামোর অভাব ছিল। কিন্তু এখন যখন আমরা স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পালন করছি, তখন এই ছেলেমেয়েদের জন্য আরও উন্নততর অনুশীলনের ব্যাবস্থা করতে পারছি না কেন? অচিন্ত্য শিউলি আমাদের ঘরের ছেলে। মীরাবাই চানু, তেজস্বীন শঙ্করের ব্যাপারে না হয় নাই ঢুকলাম। অচিন্ত্য কীভাবে অনুশীলন করে বার্মিংহামে সোনা জিতেছে শুনে তাজ্জব হয়ে গিয়েছি। ছেলেটা পাশে কোচ আর দাদাকে ছাড়া কাউকে পায়নি! ওর মা বলেছেন ছেলে একটা দশ টাকার সামোসা কিনতে গিয়েও ফিরে এসেছে। এই সামর্থ্য তরুণ ভারোত্তোলকের ছিল না।
আরও পড়ুন-সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করে এ কী অবস্থান ! সিপিএম নেতাদের নামে মামলা
আরও একটা জাতীয় ক্রীড়াদিবস এল। কিন্তু বুকে হাত রেখে এটা বলতে পারছি না যে পরিস্থিতির বদল হয়েছে। একটু অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও একটা কথা না বলে পারছি না, এই যে ক্রীড়াদিবস নিয়ে এত নাচানাচি হয়, তাহলে আমরা ফিফার হাতে সাসপেন্ড হই কেন? হয়তো এই সাসপেনসন উঠে যাবে। কিন্তু বিশ্ব দরবারে মুখ তো পুড়ল! কেন এই জায়গা পর্যন্ত গড়াল ব্যাপারটা। সরকারের নজর থাকবে না? আমি নিজে দেশের হয়ে ফুটবল খেলেছি। কাঁটাটা বুকে তাই বেশি বিঁধেছে। এই লেখা যখন লিখছি, তখন ভারত ফিফার মানচিত্রে নেই। বেদনাদায়ক। ভাবতেই পারছি না।
আরও পড়ুন-আলোর কাজে উঠে আসবে ইতিহাস, পুরাণ
২০ অগাস্ট গোষ্ঠ পালের জন্মদিন গেল। পাঁচ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে এই দিনটি সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে। ময়দানের বটতলা থেকে ইস্টবেঙ্গল তাঁবু পর্যন্ত রাস্তার নাম দেওয়া হয়েছে গোষ্ঠ পাল সরণি। অসাধারণ এই উদ্যাগকে আগেও সাধুবাদ জানিয়েছি। এখনও জানাচ্ছি। কিন্তু এই প্রশ্নটা মাথায় আসছে যে, বাংলা এমন ভাবতে পারলে অন্যেরা পারে না কেন? ময়দানে ১৯১১-র নায়কের মূর্তি বসানোর পিছনে অনেক ভাবনা-চিন্তা ছিল। একজন সুঠাম চেহারার মানুষ বল নিয়ে কসরত করছেন। আর তা দেখে ময়দানের ছোট-বড় সব ক্লাবের খেলোয়াড়রা মনের মধ্যে জেদের জাল বুনছে, আমাকেও ওঁর মতো হতে হবে। এই ভাবনাটার মধ্যে কী অসাধারণ বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলুন তো? ভাবলে মন ভরে ওঠে।
আরও পড়ুন-করোনা টিকার মেধাস্বত্ব চুরির অভিযোগে ফাইজারের বিরুদ্ধে মামলা মডার্নার
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে ফুটবল খেলেছেন গোষ্ঠ পাল। সেই আমলে তাঁকে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিল গোরারা। তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকী তাঁর নামের পাশে চৌধুরি পদবি জুড়ে দেওয়ার কথা বলা হলে তিনি তাতে না বলে দেন। এসব শুনে গায়ে কাঁটা দিত। আমাদের এখানকার সরকার এভাবেই কাজ করছে। কত মাঠ হচ্ছে। স্টেডিয়াম হচ্ছে। কত পার্ক হচ্ছে। অ্যাকাডেমি হচ্ছে। আর জাতীয় স্তরে কী হচ্ছে? সংবর্ধনা, ছবি ও প্রচার। এখনও বুঝে উঠতে পারলাম না আমাদের জাতীয় ক্রীড়ানীতি কী? যে ছেলেমেয়েরা অলিম্পিক, কমনওয়েলথ গেমসে ভাল করছে, তাদের উঠে আসার রাস্তা এত কঠিন কেন? কেন তেজস্বীনের মতো প্রতিভাকে কমনওয়েলথে নিজের ইভেন্টের মাত্র একদিন আগে বার্মিংহামে পৌঁছতে হবে? শুনেছি ছেলেটার অংশ নেওয়াই অনিশ্চিত ছিল। ও বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপেও নামতে পারেনি। আমার প্রশ্ন, এসব কেউ দেখে না কেন। শুধু পদক নিয়ে এলে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সংবর্ধনা দিলেই হবে? কত প্রতিভা হারিয়ে যাচ্ছে বলুন তো।
ধ্যানচাঁদ হকির জাদুকর ছিলেন। আমাদের সবার নমস্য। তাঁর জন্মদিনকে জাতীয় ক্রীড়াদিবস করায় কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু এমন দিনে শুধু খেলোয়াড়দের হাতে খেতাব তুলে দিয়েই কি সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলা যাবে? আবার বলছি, কেন আমাদের একটা যথার্থ ক্রীড়ানীতি থাকবে না? কেন অচিন্ত্যরা সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে উঠে আসবে? ছেলাটা কাতর স্বরে বলছে ওর পাড়ার ক্লাবের পাশে দাঁড়াতে। কোচের পাশে থাকতে। কোচের কথাই ধরুন। ভদ্রলোক অচিন্ত্যর জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আজ অচিন্ত্যর তাও কিছু একটা হল। কিন্তু পর্দার আড়ালে থাকা সেই ভদ্রলোকের কী হল? আমরা পারি না এমন চ্যাম্পিয়ন গড়ার কারিগরকে তুলে ধরতে। বছরে একবার দ্রোণাচার্য খেতাব দিয়েই কি হাত ধুয়ে ফেলা যায়?
আরও পড়ুন-রাহুল ঘনিষ্ঠদের কটাক্ষ কংগ্রেস সাংসদ মণীশের
কোথায় যেন দেখলাম ২০২২-২৩-এ আমাদের কেন্দ্রীয় ক্রীড়া বীজেটের পরিমাণ ৩০৬২.৬০ কোটি টাকা। গতবারের থেকে ৩০৫.০২ কোটি টাকা বেড়েছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলির দিকে তাকালে এটা মোটেই যথেষ্ট নয়। আমরা যদি খেলার মাঠে বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে টক্কর নিতে যাই, তাহলে ক্রীড়া বাজেটের পরিমাণ বাড়াতেই হবে। উন্নত পরিকাঠামো ছড়িয়ে দিতে হবে দেশের সর্বত্র। খুঁজে বের করতে হবে কোথায় আর একটা মীরাবাই চানুকে অনুশীলনে যাওয়ার জন্য পণ্যবাহী ট্রাকে চেপে বসতে হচ্ছে। কোথায় আর এক নীরজ চোপড়াকে হাড়ভাঙা অনুশীলনের পর অভুক্ত শরীরে ঘরে ফিরতে হচ্ছে। কোথায় কোনও অচিন্ত্যকে একটা সামোসা কিনতে গিয়েও দশ টাকা নেই বলে মুখ চুন করে ফিরতে হচ্ছে সেদিকে।
আরও পড়ুন-একমাস ব্যাট ছুঁইনি, মুখ খুললেন বিরাট
আমরা ভারতের হয়ে খেলতে গিয়ে মশার কামড় খেয়েছি। মাঝরাতে খাটে বসে একটা-একটা করে মশা গুনেছি। টাকার কথা ছেড়েই দিলাম। আমি জানি ছবিটা এখন বদলেছে। সুনীল ছেত্রী, সন্দেশ ঝিঙ্গানরা এখন পাঁচতারা হোটেলে থাকে। ওরা আইপিএলের মতোই আইএসএলে খেলে বিশাল টাকা পায়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে খেলার ছবিটা কি বদলেছে? তাহলে প্রদীপের তলায় এত অন্ধকার কেন? কেন প্রাক্তনদের সর্বত্র দায়িত্বে আনা হচ্ছে না? পি টি উষা, অঞ্জু ববি জর্জদের কেন সার্বিকভাবে দায়িত্ব দেওয়া হবে না? কেন খেলোয়াড়দের সামনে রেখে জাতীয় ক্রীড়ানীতি তৈরি হচ্ছে না?
আরও পড়ুন-বসিরহাটে শুরু মুখ্যমন্ত্রীর প্রকল্প চোখের আলো
এইসব প্রশ্নের কোনও জবাব মিলবে বলে মনে হয় না! ভবিষ্যতের অচিন্ত্য, তেজস্বীনদের এভাবেই উঠে আসতে হবে। বড়জোর পদক পেলে সংবর্ধনার আকার আরও বৃহৎ হবে। তা না হলে পরের ক্রীড়াদিবসও এভাবেই যাবে।
এখানেই একটা প্রার্থনা। বদলে যাক এতদিনের চেনা ছবিটা। একটা নয়, গলি-গলিতে উঠে আসুক নীরজ-চানুরা। পদক তালিকায় সামনে থাকুক আমাদের দেশ। পরিবর্তনের শুরুটা হোক আজকের দিন থেকেই।