সংখ্যার জোরে বলীয়ান নয় যারা আসুন আজ তাদের কথা ভাবি

১৮ ডিসেম্বর সংখ্যালঘু অধিকার দিবস। আজকের দিনে সেই বিশেষ ভাবনার কথা লিখছেন ড. মইনুল হাসান

Must read

১৮ ডিসেম্বর সংখ্যালঘু অধিকার দিবস। ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে দিনটি ঘোষণা হয়েছিল। ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল পৃথিবীর সমস্ত সংখ্যাগত, ধর্মগত, জাতিগত, ভাষাগত হিসাবে যারা সংখ্যালঘু তাদের নির্দিষ্ট কিছু অধিকার আছে তা রক্ষা করার জন্য সার্বিক আইনি, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা ছাড়া সবার জন্য সমান অধিকার তো রয়েছেই। ভারতেও ১৮ ডিসেম্বর সংখ্যালঘু অধিকার দিবস হিসাবে পালন করা হয় বা মান্যতা দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন-দলের নেতারা চোর, দুর্নীতিগ্রস্ত বলে ফেসবুকে তোপ অনুপমের

কিন্তু সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকার কীভাবে রক্ষা হবে সেটার জন্য একটার পর একটা ধারা সংযোজিত আছে সংবিধানে। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে যে রাষ্ট্রনেতাদের আমরা লক্ষ্য করি তাঁরা যে কতখানি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন সেটা এসব দেখলেই বোঝা যায়। সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সংবিধানের ২৯ ও ৩০ নং ধারা অত্যন্ত জরুরি সংযোজন। ২৯(১) ধারাতে বলা হয়েছে, ‘ভারতের রাজ্যক্ষেত্রে বা উহার কোনভাগে বসবাসকারী নাগরিকগণের কোন বিভাগের নিজস্ব বিশিষ্ট ভাষা, লিপি বা কৃষ্টি থাকিলে, সেই বিভাগের তাহা পরিরক্ষণ করার অধিকার থাকিবে। ৩০(১) বলা হচ্ছে ‘সকল সংখ্যালঘুবর্গের, ধর্মভিত্তিকই হউক বা ভাষাভাষিই হউক, তাঁহাদের পছন্দমত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালন করিবার অধিকার থাকিবে।’ আবার সংবিধানের মৌলিক অধিকার পর্বের ১৫(১) ধারায় বলা হচ্ছে ‘কেবল ধর্ম, প্রজাতি, জাতি, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের হেতুতে অথবা তন্মধ্যে কোনও একটিরও হেতুতে রাজ্য কোন নাগরিকের প্রতিকূলে বিভেদ করিবেন না।’ ১৬(১) ধারাতে উল্লেখিত হয়েছে ‘রাজ্যের অধীনে চাকরি বা কোন পদে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ থাকিবে।’ ১৯৫০ সালে লাগু হওয়া ভারতের সংবিধানে কথাগুলো আছে। ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষা বিষয়ে যে সনদ প্রচারিত হয় তার মর্মবাণী প্রায় একই। ভারতে ধর্মগত সংখ্যালঘুদের কথা আলোচিত হয় বেশি। প্রধান হচ্ছে মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, পার্সী। এই পর্যায়ে মুসলমানরা সংখ্যায় অনেক বেশি। বিশেষত মহারাষ্ট্র, অসম, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলিতে মুসলমান জনসংখ্যা অনেক বেশি।

আরও পড়ুন-বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্য আকর্ষণ বাড়াতে পদক্ষেপ রাজ্যের


আজকের সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষা দিবসে বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার কথা বলতে হবে। দেশভাগে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রদেশগুলির মধ্যে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলা। উদ্বাস্তু সমস্যা ছিল প্রবল। বিনিময় প্রথা চলেছে দীর্ঘদিন। হঠাৎ করে মুসলমানরা সংখ্যালঘু ও মধ্যবিত্তহীন হয়ে পড়েছে। এই ধাক্কা যেমন মুসলমান সমাজের উপর পড়েছে তেমনই অন্য সমাজেও পড়েছে। সেখান থেকে মুসলমানদের ঘুরে দাঁড়ানো শুরু। প্রধান সহায় পশ্চিমবাংলার সহায়। শিক্ষার প্রসার, অধিকার রক্ষা, নিপীড়নহীন, দাঙ্গাহীন এবং সম্প্রীতিসত্তার একটা সমাজ তুলে ধরেছে পশ্চিমবাংলা সরকার। একদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা, অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষা— দুটোতেই মুসলমান বাড়ির ছেলে-মেয়েরা এগিয়ে এসেছে। মেয়েদের মধ্যে আগ্রহ আরও বেশি। শিক্ষার্থীদের বিশেষ স্টাইপেন্ড-এর ব্যবস্থা হয়েছে। স্কলারশিপগুলোর টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটা তারা না করার জন্য পশ্চিমবাংলা সরকার সেই ভার নিজেই কাঁধে তুলে নিয়েছে। বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার, উচ্চশিক্ষার প্রসারে নজর দেওয়া হয়েছে। ব্যাঙ্কগুলো ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণ দিচ্ছে। মিশন আন্দোলন এ-ব্যাপারে অত্যন্ত বড় সহায়ক। পশ্চিমবাংলার সরকার এ-ব্যাপারে খুবই উদার মনোভাব দেখিয়ে তাদের কাজের ক্ষেত্র বাড়িয়ে দিয়েছে। সারা রাজ্যে এখন প্রচুর মুসলমান বাড়ির ছেলে-মেয়ে ডাক্তার পাওয়া যায়। মিশন আন্দোলন তার পিছনে আছে। গর্বের আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আছে স্বমহিমায়।
শিক্ষা ছাড়াও মুসলমানদের ধর্মীয় ব্যাপারগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুষ্ঠুভাবে হজযাত্রীরা মক্কা যাচ্ছেন। রমজান ও ইদ পালন কার্যত বাঙালির সবার উৎসবে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি সবেবরাতের দিন পশ্চিমবঙ্গ সরকার ছুটি ঘোষণা করেছেন। সর্বোপরি পশ্চিমবাংলা দাঙ্গামুক্ত হয়েছে। সম্প্রীতির সঙ্গে বাস করছেন সবাই। পশ্চিমবাংলার মানুষ এবং সরকার যৌথভাবে এমন পরিবেশ তৈরি করেছে। যা সারা ভারতে বিরল।

আরও পড়ুন-ভূমধ্যসাগর পেরোতে গিয়ে জাহাজডুবি, মৃত ৬০


এবার সারা ভারতের দিকে তাকাই। সংখ্যালঘু-বিষয়ক কোনও মন্ত্রী পূর্ণভাবে নেই। সংখ্যালঘুদের জন্য নির্দিষ্ট স্কলারশিপগুলো একের পর এক বন্ধ। সংখ্যালঘু নামের সামান্য ছোঁয়া আছে সেটা পালটানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার নাম পালটে গিয়েছে। অসমে বিজেপি সরকার। মদ্রাসা বন্ধ করে দেবার ব্যবস্থা করেছে। হরিয়ানায় প্রকাশ্যে নামাজ পড়া বন্ধ। উত্তরপ্রদেশে বকরিদে যে কোনও পশুবলি বন্ধ। মধ্যপ্রদেশে নতুন সরকার শপথ নিয়ে ঘোষণা করেছে প্রকাশ্যে মসজিদে আজান দেওয়া যাবে না। একটার পর একটা বিজেপি-শাসিত রাজ্যে ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষা করা এবং তা পরিচালনা করার কোনও ব্যবস্থা নেই। কোনও সরকারি দফতরই নেই। ওয়াকফ সম্পত্তি বিজেপি সরকার ও তার বশংবদরা দখল করে ফেলেছে। কোনও সুরাহা হচ্ছে না। বহু ঐতিহ্যবাহী সৌধ নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। শুধু মুসলমান নয়, সব সংখ্যালঘুর উপরই এমন অত্যাচার চলছে। তারা সংখ্যায় খুবই কম বলে বেশি সংবাদ হয় না।
২০২২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘোষণার ৩০ বছরে সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষার ৪টি বিষয় নিয়ে নির্দিষ্ট হয়েছিল। অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে, অনৈক্য ও নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে, পরিচয় রক্ষা করতে হবে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হবে। ভারত সরকার ৪ দফাতেই গোল্লা পাবে সেটা প্রমাণিত। আমাদের বসে থাকলে চলবে না। সীমাহীন হতাশার মধ্যেও আলো জ্বালানো মানুষের কাজ। সেই কাজটা এক নাগাড়ে, মন দিয়ে আমাদের করে যেতে হবে। পশ্চিমবাংলা আমাদের সামনে উজ্জ্বল বাতিঘর হয়ে থাকবে। জয় বাংলা।

Latest article