আলতা পায়ের আলতো ছোঁয়া 

আলতা কি যেমন-তেমন জিনিস? বৈষ্ণব পদাবলিতে সশ্রদ্ধ আদরে চর্চিত আলতা-প্রসঙ্গ। সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির প্রতীক, বাঙালি সংস্কৃতি ঐতিহ্য ও পরম্পরা মিশে রয়েছে আলতায়। কী অমোঘ তার জাদুকরী আকর্ষণ! কী তার টান! নামীদামি সকলেই করেছেন আলতার গুণগান। লিখছেন উৎপল সিনহা

Must read

‘মা কহিল, আর দেখ্ কাঙালি, তোর বাবাকে একবার ধরে আনবি, অমনি যেন পায়ের ধুলো মাথায় দিয়ে আমাকে বিদায় দেয়। অমনি পায়ে আলতা, মাথায় সিঁদুর দিয়ে, —কিন্তু কে-বা দেবে? তুই দিবি, না রে কাঙালি?’
(অভাগীর স্বর্গ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
আরও পড়ুন-আলতা পেন্টিং
আলতার সঙ্গে বাঙালির যোগ জনমে-মরণে। শাশ্বত সম্পর্ক। পুজোর দিনে সাবেক লালপাড় সাদা শাড়ি অথবা অন্য কোনও স্নিগ্ধ শোভন শাড়ির সঙ্গে পায়ে আলতার কারুকার্য যেন একটা আলাদা মাত্রা এনে দেয়। হিন্দু ধর্মে আলতাকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করা হয়। এটি সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির প্রতীক। আলতা মিশে আছে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও পরম্পরায়। আলতার কল্কা পায়ের অপরূপ শোভা।
‘গোধূলিতে সুয্যি মামার বিয়ে; মামি থাকেন সোনার বরণ ঘোমটাতে মুখ ঢাকা, আলতা পায়ে আঁকা।’ লিখেছেন রবিঠাকুর তাঁর ‘সময়হারা’ কবিতায়। আবার, ‘ওই রাঙা পায়ে রাঙা আলতা প্রথম যেদিন পরেছিলে, সেদিন তুমি আমায় কি গো ভুলেও মনে করেছিলে— আলতা যেদিন পরেছিলে?’ ব্যর্থ প্রাণের এই অভিমান ঝরে পড়েছে কাজী নজরুল ইসলামের ‘ছায়ানট’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘আলতা-স্মৃতি’ কবিতায়।
‘আলতা পায়ে, কাজল চোখে, কপালে তার টিপ, ঘরের কোণে জ্বালে মাটির দীপ।’ এ-ও তো রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ কথা। সুধীরলাল চক্রবর্তী গেয়ে গেছেন, ‘কার ললাটে সিঁদুর নিয়ে ভোরের রবি ওঠে, আলতা পরা পায়ের ছোঁয়ায় রক্তকমল ফোটে’। পুজো থেকে বিয়ে, বাঙালি জীবনের সাতকাহনে জড়িয়ে আছে আলতা অনুষঙ্গ। আলতা কি যেমন-তেমন জিনিস? বৈষ্ণব পদাবলিতে সশ্রদ্ধ আদরে চর্চিত আলতা প্রসঙ্গ। বাংলা কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে ও গানে বারবার বিজয়িনীর মতো স্বমহিমায় হাজির হয়েছে অপরূপা আলতা। কী আশ্চর্য তার টান, কী অমোঘ তার জাদুকরী আকর্ষণ! বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাতেও আলতার গুণগান। আলতা কিন্তু শুধুমাত্র প্রসাধনীই নয়, এমনকী এই আধুনিক যুগেও বাঙালি জীবনের এক অবশ্যম্ভাবী অঙ্গ।
বর্তমানে তরল অবস্থায় শিশিতে পাওয়া গেলেও প্রাচীন যুগে আলতা পাতা ব্যবহার করা হত। আলতা পরা রাঙা দুটি পায়ে নববধূ যখন শ্বশুরবাড়ি প্রবেশ করে, তখন তার আগমন সমগ্র পরিবেশকে আনন্দময় করে তোলে। লাল রংকে শুভ বলে মনে করা হয়। এ-বাঙালির চিরন্তন ধারণা। শুভ আচার ও অনুষ্ঠানে আলতা কীভাবে তার স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে তার সুনির্দিষ্ট উল্লেখ ইতিহাসে তেমন না পাওয়া গেলেও গ্রামবাংলায় আলতার ব্যবহার বহু পুরনো। এর ব্যবহারিক কারণ পল্লিগ্রামে মেয়েদের পায়ে এক ধরনের ছত্রাকঘটিত রোগ হত, যাকে ‘হাজা’ বলা হয়। এই চর্মরোগ থেকে নিস্তার পেতেই প্রাথমিকভাবে আলতা ব্যবহৃত হত, যা সেইসময় শুধুই ছিল এক আয়ুর্বেদিক ছত্রাকনাশক তরল ওষুধ। তবে আজ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আলতার ব্যবহারে এসেছে বহু পরিবর্তন। যে কোনও অনুষ্ঠানে আলতা-পরা আজকের অন্যতম ফ্যাশন। সভ্যতা যতই এগিয়ে যাক, বাঙালি যতই আল্ট্রা মডার্ন হয়ে উঠুক, সমগ্র ভারতীয় সংস্কৃতিতে আলতা একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে ভবিষ্যতেও বিবেচিত হবে, এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
আলতা, যা বেঙ্গল রোজ নামেও পরিচিত, এক ধরনের তরল লাল রং, যা হাত এবং পায়ে প্রয়োগ করা হয়।‌ এটি মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষত বাংলাদেশে এবং ভারতের পূর্ব প্রদেশগুলোতে, যেমন পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওড়িশায় ব্যবহার করা হয়। এটি মূলত পুজোআচ্চা, বিবাহ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে তুলো অথবা তুলির সাহায্যে প্রয়োগ করা হয়। গায়ে হলুদ, পয়লা বৈশাখ, বাড়ির বিভিন্ন মাঙ্গলিক আচার অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, বিশেষত নৃত্যানুষ্ঠানে আলতা পরার চল আছে। সব বয়সের মেয়েরাই আলতা পছন্দ করে। লালপাড় শাড়ি, লাল টিপ, কাচের চুড়ি আর আলতা-রাঙা পা বাঙালি নারীর শাশ্বত সৌন্দর্য। আগেকার দিনে গাঁয়ের বধূরা পালকি চড়ে আলতা-রাঙা পায়ে সলাজ চাহনি নিয়ে নতুন সংসারের দরজায় এসে দাঁড়াত। সমবেত উলুধ্বনির সমারোহে রানির মতো প্রবেশ করত নতুন জীবনে।
প্রথমদিকে পানপাতা, পানের রস, কুমকুম, সিঁদুর ইত্যাদি উপাদানের সাহায্যে আলতা তৈরি হত। ‌পরবর্তীতে জতু দিয়ে এবং বর্তমানে লাক্ষার নির্যাস অথবা কৃত্রিম রঙের মাধ্যমে আলতা প্রস্তুত করা হয়। তাই অনেকেই বলেন, আজকাল আলতাতেও ভেজাল। তা সত্ত্বেও, আজও বহু অনুষ্ঠান আলতা ছাড়া অসম্পূর্ণ মনে হয়। আলতার তাৎপর্য হল, এটি রক্তের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, যা প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির প্রতীক। ‌এটি সাজসজ্জার একটি সুলভ অথচ প্রয়োজনীয় উপকরণ, যা দিয়ে তুলির সাহায্যে খুব সহজেই রং করা যায় এবং এর জন্য তেমন শৈল্পিক দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে না। তবে বড় শিল্পীর হাতে আলতা দিয়ে জটিল নকশার নয়নাভিরাম আলপনাও সম্ভব। একটা সময় পর্যন্ত আলতা দিয়ে হাতে লেখা রাজনৈতিক পোস্টার ও বিজ্ঞাপন দেখা যেত।
এখন এসব ক্ষেত্রে আলতার ব্যবহার কমে এলেও গাঁয়ে-গঞ্জে এখনও আলতালেখা মাঝেমাঝেই চোখে পড়ে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এবং প্রশান্ত ভট্টাচার্যের সুরে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আলতা পায়ের আলতো ছোঁয়া’ গানটি তো কালজয়ী বাংলা গানের একেবারে প্রথম সারিতে স্থান করে নিয়েছে। সধবা নারীর অন্যতম সেরা ভূষণ আলতা, যা কুমারী মেয়েদেরও মন কেড়ে রাখে। ধান, কড়ি, সিঁদুরের সঙ্গে পান, বেলপাতা, কখনও-বা আমপল্লবের সঙ্গে আলতাপাতা মা দুর্গার নবপত্রিকার অধিবাস থেকে মা লক্ষ্মীর পুজোর অন্যতম জরুরি অনুষঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হয়।
আলতাপাতা হল তিন ইঞ্চি পুরু পাতলা লাল রঙের তুলো, যা দশ বারোটি পরপর রেখে একটি পরিষ্কার কাগজে জড়িয়ে রাখা হত। এই তুলোর স্তর বা পরত এক-একটি ছাড়িয়ে নিয়ে বাটিতে রাখা জলে ডুবিয়ে পায়ে বুলিয়ে দিলেই পা হয়ে উঠত উজ্জ্বল আলতারাঙা।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যখন কলকাতায় আসেন, তখন তিনি আলতা ও সিঁদুরের ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর বিখ্যাত ব্র্যান্ডটির নাম ‘রাঙাজবা’। আপামর বাঙালির অকালে হারিয়ে যাওয়া আদুরে কন্যা পথের পাঁচালীর ছোট্ট দুর্গা মা লক্ষ্মীর চুবড়ি থেকে আলতাপাতা লুকিয়ে নিয়ে নিজের কাছে রেখেছিল। বাবা হরিহর মেয়ের এই শখের কথা জানত, তাই শহর থেকে ফেরার সময় দুর্গার জন্য নতুন শাড়ির সঙ্গে আলতাপাতাও এনেছিল। এই আলতা পরার প্রথা ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা নির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও রক্তের সঙ্গে আলতার সাদৃশ্য থাকায় আলতাকে নারীর উর্বরতা, সুখ ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হত।
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যেমন মহারাষ্ট্র, অসম, বিহার ও দক্ষিণ ভারতে মেয়ে-বউদের প্রসাধনী হিসেবে আলতা একসময় দারুণ জনপ্রিয় ছিল। ভারতের শাস্ত্রীয় নৃত্যের সাজে আলতা-পরা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতনাট্যম, কুচিপুডি, ওডিশি, কত্থক, মণিপুরি, কথাকলি ইত্যাদি প্রায় সমস্ত ধ্রুপদী নৃত্যেই নারী ও পুরুষ উভয় শিল্পীরাই হাতে ও পায়ে আলতার ব্যবহার করেন নৃত্যসাজের জরুরি অনুষঙ্গ হিসেবে। রবীন্দ্রনৃত্য, লোকনৃত্য এবং অন্যান্য সৃজনশীল নৃত্যেও আজকাল আলতা পরার রেওয়াজ লক্ষণীয়। এর অন্যতম কারণ আলতা-রাঙা পা, হাত ও হাতের আঙুলের সাহায্যে সৃষ্ট নাচের বিভিন্ন মুদ্রা দূর থেকে দর্শকদের দৃষ্টি ও মনোযোগ ‌আকর্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দুর্গাপুজোর চারদিন এবং লক্ষ্মীপুজো তো বটেই, এ-ছাড়াও লক্ষ্মীবার অর্থাৎ প্রতি বৃহস্পতিবার, অক্ষয় তৃতীয়া, পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন-সহ গায়ে হলুদ ও বিয়ের অনুষ্ঠানে সধবা নারীরা পরস্পরকে আলতা পরিয়ে মিষ্টি খাইয়ে একে অপরের শুভ কামনা করে, যাতে উভয়পক্ষেরই সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় থাকে।
কনে বউ শ্বশুরবাড়িতে পা রাখে দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে একটি সাদা কাপড়ে পায়ের ছাপ ফেলতে ফেলতে। এই পায়ের চিহ্নকে মা লক্ষ্মীর পায়ের চিহ্নস্বরূপ গণ্য করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ নতুন বউ তাঁর গৃহলক্ষ্মীর আসনটি এই প্রথা পালনের মাধ্যমে চিরস্থায়ী করে নেয়।
এই স্ত্রী আচার ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ। এদিনও সধবারা পরস্পরকে আলতা পরান।
এখন আলতার বাক্সে আলতার শিশির সঙ্গে বাটি ও মোটা তারের ডগায় স্পঞ্জের তুলি দেওয়া হয় না, কিন্তু কিছুকাল আগেও এসব পাওয়া যেত। এই আলতা পরাকে কেন্দ্র করেই নারীরা একসময় খুঁজে পেয়েছিলেন রোজগারের পথ। বনেদি বাড়িতে প্রতি বৃহস্পতিবার ও পূর্ণিমাতে আসতেন ‘আলতা বউ’। এঁরা বাড়ির এয়োস্ত্রী বধূদের পায়ে ঝামা ঘষে মরামাস তুলে নরুণ দিয়ে নখ ও কড়া কেটে দিতেন। তারপর বয়স অনুযায়ী বড়দের আগে আলতা পরাতেন। পরে ছোটদের আলতা পরার পালা আসত। এই আলতা বউরা পায়ে আলতা পরানোর শেষে ডানহাতের পাতার নিচের দিকে একটা আলতার টিপ এঁকে দিতেন। বিনিময়ে তাঁরা পেতেন নগদ অথবা মাসকাবারি টাকা। আলতা নামটাতেই এক চিরন্তন ভাললাগা জড়িয়ে আছে মেয়েদের জীবনে। সোহাগ মানেই আলতা রাঙা পায়ের দোলায় মন ভোলানো কথা।
মেয়েবেলায়, ছোট্ট শরীরে পুতুল খেলার সময় থেকেই মা, কাকিমাদের দেখে নরম পায়ে আলতা পরে ছোটাছুটির ইতিহাস সব মেয়েদেরই থাকে। আলতা কি ইদানীং ব্রাত্য? মোটেই না। আলতার কথা এই চূড়ান্ত প্রযুক্তি-নির্ভর যুগেও বলে শেষ করা যাবে না। রঙের নামও দুধে-আলতা। আলতা জলে পা ডুবিয়ে তবেই সংসার জীবনে প্রবেশ করত মেয়েরা। সেই ট্রাডিশন আজ কোথাও কোথাও বিঘ্নিত হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আলতাকে বিজয়িনী হতে দেখছি না কি আমরা? কর্মরতা মেয়ে-বউদের সারাদিনে আলতা পরার সময় কোথায়? তবু আলতার মর্যাদা খুব একটা টাল খায়নি আজও। আকাশ থেকে টাপুরটুপুর বৃষ্টি ঝরা বাদল দিনে কমলিনীর শিহরনের রোমাঞ্চেও কবির প্রার্থনা যেন লজ্জাবতীর পদযুগল থেকে আলতা ধুয়ে না যায়। আজকের দিনে এয়োস্ত্রীদের প্রতি বৃহস্পতিবার অতি-যত্নে নিখুঁতভাবে আলতা পরার নিয়ম শিথিল হলেও নারীর কাছে আলতার আবেদন ও আকর্ষণ মোটেও কমেনি। সধবা নারীর মৃত্যুর পর তাঁর পায়ের শেষচিহ্ন তুলে রাখা হত আলতার ছাপ দিয়ে। এই প্রথা অবশ্য পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মৃত্যুর পরেও পালিত হয়ে থাকে আজও অধিকাংশ বাড়িতে, তবে বিধবাদের ক্ষেত্রে এ-প্রথা প্রযোজ্য নয়। উল্লেখ্য, মা দুর্গার আবাহন তথা বরণের সময়, এমনকী বিসর্জনের পরেও আলতার ভূমিকা সমাপ্ত হয় না। আলতা বাঙালি-জীবনের সুখেদুখে, আনন্দে, বেদনায়, সমৃদ্ধি ও আরাধনায় সম্পৃক্ত হয়ে আছে আবহমানকাল ধরে। আলতার বিকল্প আজও পাওয়া যায়নি। আলতা বাঙালি-জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

Latest article