বেতার বার্তার আদিপুরুষ মাহলন লুমিস

এটা অনেকেরই অজানা যে বিজ্ঞানী গুগলিয়েলমো মার্কনি বা আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু নন তাঁদের অনেক আগেই এক ধরনের ইলেকট্রিক সিগন্যালকে কাজে লাগিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় খবর পাঠানোর কাজ সফলভাবে সেরে ফেলেছিলেন ‘মাহলন লুমিস’। তিনিই ছিলেন বেতার বার্তার আদিপুরুষ। লিখছেন অর্পণ পাল

Must read

রেডিও আবিষ্কারের কৃতিত্ব ইতালির বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক গুগলিয়েলমো মার্কনি পেয়ে গিয়েছিলেন বেশ চাতুর্য প্রয়োগ করেই; আর বঞ্চিত হয়েছিলেন আমাদের বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। মার্কনি সাহেব এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবে নোবেলও পেয়ে যান কয়েক বছর পর, যে-কারণে আমাদের ওই মানুষটির ওপরে ভারি রাগ। যেন তাঁর জন্যেই জগদীশচন্দ্রকে নোবেল-বঞ্চিত করা হয়েছিল। যদিও এ কথা ঠিক যে বেতার আবিষ্কারের ধারায় জগদীশচন্দ্রের কৃতিত্ব ছিল যথেষ্টই এবং তিনি বিনা তারে বার্তা পাঠানোর কাজে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন, কিন্তু অন্য দিক থেকে পরিস্থিতির বিচারে মার্কনিকেও পুরোপুরি দোষ দেওয়া চলে না।

আরও পড়ুন-শিলাবৃষ্টির জের, নাসিকে পেঁয়াজের দাম বাড়ল ৩০%

তবে জগদীশচন্দ্র-মার্কনি প্রসঙ্গ এই লেখার বিষয় নয়। বেতার বা বিনা তারে বার্তা পাঠানোর কাজে এই মার্কনি বা জগদীশচন্দ্র, কেউই পথিকৃৎ নন। এক ধরনের ইলেকট্রিক সিগন্যালকে কাজে লাগিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় খবর পাঠানোর কাজ মার্কনির চেয়েও প্রায় তিরিশ বছর আগে সফলভাবে সেরে ফেলেছিলেন মাহলন লুমিস নামে এক আমেরিকান দাঁতের ডাক্তার। আজ আমরা তাঁর কথাই বলব।
তখন মার্কনির জন্মই হয়নি। আর আমাদের জগদীশচন্দ্র পূর্ববঙ্গে একটি স্কুলের নিচু ক্লাসের ছাত্র। সেই সময়ে, ১৮৬৬ সালের মে মাসের এক সুন্দর রৌদ্র-করোজ্জ্বল দিনে সে-দেশের ব্লু রিজ পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন চল্লিশ বছরের এই ডাক্তার। পাহাড়ের নিচে তখন দাঁড়িয়ে সে দেশের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন এক নতুন ধরনের অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে আরও বলার আগে এই লুমিস সাহেব আসলে কে ছিলেন, সেটা একটু বলে নেব।

আরও পড়ুন-যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর চাপ, পাল্টা শর্ত দিয়ে ‘কৌশল’ ইজরায়েলের

মাহলন লুমিস : দাঁতের ডাক্তার থেকে উদ্ভাবক
মাহলন লুমিস (Mahlon Loomis)-এর জন্ম ১৮২৬ সালে, নিউ ইয়র্কে। বাবা ছিলেন অধ্যাপক, বাড়িতে যে জন্য পেয়েছিলেন পড়াশুনোর উপযুক্ত পরিবেশ। তাঁর পড়াশুনো দন্ত-চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে, ডিগ্রি পাওয়ার পর বিভিন্ন শহরে ঘুরে-ঘুরে চেম্বার চালান কয়েক বছর, তারপর ১৮৫৬ সালে বিয়ে করে থিতু হন ওয়াশিংটনে। এর কয়েক বছর পর, মোটামুটি ১৮৬০ সালের দিকে তিনি শুরু করেন তড়িৎবিদ্যা নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বিদ্যুৎ পাঠিয়ে গাছেদের বৃদ্ধির হার কোনওভাবে বাড়ানো যায় কি না, এটাই তখন ছিল তাঁর পরীক্ষার বিষয়বস্তু। পাশাপাশি তাঁর মনে হল, যদি খুব উঁচুতে বিদ্যুৎবাহী ঘুড়ি উড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে কি কোনওভাবে বাতাসের মধ্যে ভাসমান অবস্থায় থাকা তড়িৎ-চার্জ বা আধানকে ওই বিদ্যুতের সঙ্গে যুক্ত করে কাজে লাগানো যেতে পারে? হয়তো ওই চার্জকে কাজে লাগিয়ে বার্তাও পাঠানো যেতে পারে!
সেই চিন্তা থেকেই শুরু হল বাতাসের মধ্যে দিয়ে বিনা তারে তড়িৎ-সিগন্যাল পাঠানোর পথে প্রথম পদক্ষেপ। আর উঁচুতে ঘুড়ি পাঠানোর খুব ভাল উপায় পাহাড়ের মাথায় চড়া। আর সেটাই করলেন তিনি, ব্লু রিজ পাহাড়ের ওপর উঠলেন; অন্যদিকে প্রায় চব্বিশ কিলোমিটার দূরে অন্য একটা পাহাড়ের মাথায় বসানো রইল আরও একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা।

আরও পড়ুন-তৃণমূল কর্মী খুনে গ্রেফতার হল বিজেপির বুথ সভাপতি

লুমিস যে পাহাড়ে উঠলেন, সেখান থেকে তিনি উড়িয়ে দিলেন ছ’শো ফুট তামার তারে বাঁধা ঘুড়ি। সেই ঘুড়ির নিচে লাগানো ছিল গ্যালভানোমিটার (যা দিয়ে তড়িৎ যাচ্ছে কি না বা কতটা যাচ্ছে সেটা মাপা যায়) এবং আরও কয়েকটা যন্ত্র, আর পাহাড়ের পাদদেশে ছিল অন্য একটি যন্ত্র, যেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে।
অন্য পাহাড়ের ওপরেও লাগিয়ে রাখা হয়েছিল আর একটা একই ধরনের ঘুড়ি, কয়েকটা যন্ত্রও। প্রথম ঘুড়ির মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত তড়িতের প্রভাব বাতাসের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে ওই দ্বিতীয় ঘুড়িতে, আর দ্বিতীয় ঘুড়িতে প্রবাহিত তড়িতের কম-বেশি হওয়া দেখে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে সত্যি-সত্যিই তড়িৎ বা বিদ্যুৎ জিনিসটা বাতাসের মধ্যে দিয়ে বার্তা বহনে সক্ষম। অবশ্য তাঁর এই পরীক্ষায় দুটো ঘুড়ির মধ্যে উচ্চতার হেরফের হলে দ্বিতীয় ঘুড়ির তড়িৎ প্রথমটার দ্বারা কখনও-কখনও প্রভাবিত হতও না, যেটাকে তিনি ব্যাখ্যা করতে পারেননি। তবে এইভাবেই যে একদিন সমুদ্রের এক দিক থেকে অন্য দিকে সিগন্যালের মাধ্যমে বেতার বার্তা পাঠানোর কাজ করা সম্ভব হবে, এটা তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন।

আরও পড়ুন-যমজ নগরীতেও এবার পালিত হল দেব-দীপাবলি

শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতা
লুমিস নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েছিলেন তাঁর এই আবিষ্কারের পেটেন্ট নিয়ে একটা বড় মাপের কোম্পানি খুলে তারপর এই পদ্ধতিতে দূরবর্তী জায়গায় বার্তা পাঠানোকে সহজসাধ্য করতে। তাঁর হয়ে সে দেশের এক সেনেটর চার্লস সামনার সেনেটে একটা বিলও উত্থাপন করেন, সেই বিল পাশ হলে লুমিসকে পঞ্চাশ হাজার ডলার গবেষণার জন্য দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা হয়ে যেত। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য, সেনেটের অন্য কয়েকজন সদস্যের আপত্তিতে দীর্ঘ দিন সেই বিল আটকে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর নামে পেটেন্ট বরাদ্দ হলেও সরকারি অর্থসাহায্য তিনি কিছুই পাননি। নিজের জমানো টাকা খরচ করে লুমিস আরও কয়েক বছর গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু খুব বেশিদূর এগোতে পারেননি। তাঁর আরও দুর্ভাগ্য, আমেরিকায় ওই সময়টায় একটা বড় মাপের আর্থিক মন্দা শুরু হয়, যার ফলে প্রচুর কোম্পানি লালবাতি জ্বালতে বাধ্য হয়েছিল। লুমিসও এই কারণেই বহু চেষ্টা করেও আর কোম্পানি বানাতেই পারেননি, স্রেফ টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার উন্নতি করেছেন এমন কথা উল্লেখ করে লেখা এক পেটেন্ট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাঁকে। আবার অনেকে তাঁর এই আবিষ্কারের গুরুত্বকে পাত্তাই দেননি।

আরও পড়ুন-Uttakashi: ভগবান ভরসা, সুড়ঙ্গের সামনে বিগ্রহে চলছে পুজো

১৮৮৬ সালে মাত্র ষাট বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়, আর এর দু-বছর পরে এক জার্মান বিজ্ঞানী হেইনরিখ হাৎর্জ সফলভাবে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ তৈরি করে তা দিয়ে নানা পরীক্ষা করেন। তাঁর পথ অনুসরণ করে এরপর আরও একাধিক বিজ্ঞানী এই তরঙ্গ নিয়ে কাজে লেগে পড়েন, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মার্কনির হাত ধরে আটলান্টিকের এক দিক থেকে অন্য দিকে বেতার বার্তা প্রেরণ। এরপর শুরু হয় বেতার মাধ্যমে বার্তা পাঠানোর এক নতুন যুগ, বিশ শতকের শুরু থেকেই যার জয়জয়কার দেখতে শুরু করে গোটা বিশ্বের মানুষ।
অন্যদিকে হারিয়ে যান লুমিস। মনে-প্রাণে চেয়েছিলেন সম্পূর্ণ নিজস্ব চেষ্টায় একটা টেলিগ্রাফ কোম্পানি খুলে বিশ্বের নানা প্রান্তে বেতার বার্তা পাঠাবেন, সেটাই পরে সম্ভব হয়েছিল, শুধু তিনি দেখে যেতে পারেননি। তখন স্বীকৃতি না পেলেও আজ লুমিসকেই অনেকে ‘বেতার-বার্তা প্রেরণের জনক’ আখ্যা দিয়ে থাকেন।

Latest article