হারানো দিনের স্মরণীয় নায়িকা, চরিত্রকে জীবন্ত করে তোলার ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী মলিনা দেবী

গত শতাব্দীর তিন, চার, পাঁচ, ছয়-এর দশকে যিনি আটপৌরে বাঙালি ঘরোয়া নারী চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে স্বতঃস্ফূর্ত সাবলীল ছিলেন, সেই মলিনা দেবীর পরিচয় তুলে ধরেছেন ড. শঙ্কর ঘোষ

Must read

কথামুখ
কলকাতায় অন্নপূর্ণা বোর্ডিং হাউসের মালিক রজনী চাটুজ্জে সপ্তাহান্তে একবার বাড়ি ফিরেও শান্তি পান না, কারণ স্ত্রী অন্নপূর্ণা সংসার ও সন্তানদের সামলাতে গিয়ে স্বামীর জন্য দু’দণ্ড সময় দিতে পারেন না। এদিকে হঠাৎ একদিন তাঁর স্বামীর জামার পকেটে প্রেমপত্র দেখে অন্নপূর্ণার চক্ষুস্থির। চিঠির ভাষা লাগামহীন; লিখেছে, ‘তুমি যেমন বৃদ্ধ আমিও কিন্তু কচি খুকি নই।’ স্বামীকে বশে আনার অনেক চেষ্টাও তিনি করলেন, পারলেন না । একদিন বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সটান হাজির কলকাতার বোর্ডিং হাউসে। সেদিন সত্যি সত্যিই বিয়ে হচ্ছে। তবে বিয়ে হচ্ছে বোর্ডার রামপ্রীতির সঙ্গে অঘোর বাবুর মেয়ে রমলার। পরিণতি অবশ্যই মিলনাত্মক। এতক্ষণে পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কোন ছবি সম্পর্কে এই প্রস্তাবনা। ঠিক ধরেছেন। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। রজনীবাবু হলেন তুলসী চক্রবর্তী আর অন্নপূর্ণা হলেন মলিনা দেবী। উত্তম-সুচিত্রা ভানু-জহর-সহ একরাশ শিল্পী এ ছবিতে। কিন্তু এই দম্পতি যেন এ ছবির অক্সিজেন। বাংলার একটি বিখ্যাত দৈনিকে আলোচক লিখেছেন, ‘তুলসী চক্রবর্তী ও মলিনা দেবীর মধ্যে কার যে বেশি কৃতিত্ব বিচার করা মুশকিল। দুজনে যেন পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে গেছেন।’

আরও পড়ুন-কেন্দ্রের অসহযোগ মোকাবিলায় রাজ্য

জীবনকথা
১৯১৬ সালের ৭ মার্চ মলিনা দেবীর জন্ম হাওড়ায়। বাবা-মা হরিপদ ঘোষ ও সুশীলারানি ঘোষ। সাংসারিক অর্থাভাবের জন্যই ছোটবেলায় নাটকের জগতে এসেছিলেন। যখন মাত্র আট বছর বয়স তখন নৃত্যশিল্পী হিসেবে পেশাদারি মঞ্চে যোগদান করেন। মিনার্ভা থিয়েটারে কিন্নরী, মিশরকুমারী প্রভৃতি নাটকে নাচ করেছিলেন। পরে নাচ শেখেন ললিতমোহন গোস্বামীর কাছে। গান শিখেছেন রাইচাঁদ বড়ালের কাছে। অভিনয়-শিক্ষা নিয়েছেন অমর মল্লিকের কাছে। আসগার হোসেনের কাছে শিখেছেন হিন্দি ও উর্দু। রাইচাঁদ বড়ালের ভাই জুলু বড়ালের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি নিউ থিয়েটার্সের প্রোডাকশন কন্ট্রোলার ছিলেন। তাঁদের দুই কন্যা। নিউ থিয়েটার্সে মাইনে করা শিল্পী হিসেবে তিনি গোড়াতেই যোগদান করেন। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বীরেন্দ্রনাথ সরকার তাঁকে প্রতিষ্ঠার পথে অনেক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিলেন, সে কথা বহুবার মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন মলিনা দেবী।

আরও পড়ুন-আসানসোলের পাশে আছি, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে শীঘ্রই দেখা করবেন শত্রুঘ্ন

ছবির জগতে প্রবেশ
বাংলা ছবির নির্বাক যুগের প্রথম দিকে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সবাক যুগের গোড়াতেও তেমন কিছু ছবিতে অভিনয় করেন। নিউ থিয়েটার্সের ছবি ‘চিরকুমার-সভা’তে তিনি নির্মলার চরিত্রে অভিনয় করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। পরিচালক হলেন সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘গৃহদাহ’ ছবিতে তিনি মৃণালের ভূমিকায়। ‘রামের সুমতি’ ছবিতে তিনি রামের বৌদি নারায়ণী। ‘কপালকুণ্ডলা’ ছবিতে তিনি মতিবিবি। ‘বড়দিদি’তে তিনি বড়দিদি। ‘শহর থেকে দূরে’ ছবিতে তিনি বন্ধ্যা রমণী। সে এক অনবদ্য অভিনয়। নিউ থিয়েটার্স থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘নন্দিনী’ ছবিতে নায়িকা হিসেবে।
তিনি নায়ক হিসেবে যাঁদের পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রমথেশ বড়ুয়া, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, পাহাড়ি সান্যাল, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী।

আরও পড়ুন-সেই আনসার বিজেপিই

স্মরণীয় চরিত্রায়ণ
নায়িকা থাকতে থাকতেই চরিত্রাভিনয়ের দিকে চলে এসেছিলেন। যে জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের বিপরীতে নায়িকা হয়েছিলেন বহুবার, সেই তাঁর মা হয়েছিলেন ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ ছবিতে। তাঁর শিল্পী জীবনের অন্যতম সেরা ছবি ‘রানী রাসমণি’। তিনি নাম ভূমিকায়। বিপরীতে ছবি বিশ্বাস। তেজস্বিনী অথচ ধর্মপ্রাণ রানি রাসমণিকে মূর্ত করে তুললেন বড়পর্দায়। এমন কথা চালু রয়েছে এ ছবির শুটিংয়ের দিনগুলিতে যে তিনি উপবাসী থাকতেন। প্যাকআপ হওয়ার পর বাড়ি ফিরে স্নান সেরে খেতেন। জটিল সব চরিত্র রূপায়ণে তাঁর অভিনয় প্রতিভার ঝলক একবার দেখা যাক। ‘মাইকেল মধুসূদন’ ছবিতে তিনি মাইকেলের (উৎপল দত্ত) মায়ের চরিত্রে। খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছে সন্তান মা হিসেবে জাহ্নবীদেবীর বুক ফেটে যাচ্ছে। কী অনবদ্য অভিনয়। ‘বিদ্যাসাগর’ ছবিতে তিনি বিদ্যাসাগরের (পাহাড়ি সান্যাল) পুত্রবৎসল মা ভগবতী দেবী। ‘বিরেশ্বর বিবেকানন্দ’ ছবিতে তিনি বিবেকানন্দের (অমরেশ দাস) মা ভুবনেশ্বরী দেবী। ‘পল্লীসমাজ’ ছবিতে তিনি রমেশের জেঠিমা বিশ্বেশ্বরী। অপূর্ব বাঞ্ছিত ব্যক্তিত্ব তিনি আরোপ করেছেন চরিত্রটিতে। ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে তিনি সুখেনের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের) পিসি। বউমা অর্চনাকে (সুচিত্রা সেন) যখন তিনি বলেন, ‘বৌমা ঝগড়াটাকে বাসী হতে দিও না’— দর্শকের চোখের জল তখন রোখা সম্ভব হয়নি। আরেকটা ছবিতে আবার চূড়ান্ত কমেডি করেছেন। নায়ক সুশোভন (উত্তমকুমার)-এর শাশুড়ি হিসাবে তিনি প্রবাসে গিয়ে যে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটান, তখন দর্শকেরা হেসে লুটোপুটি খান।

আরও পড়ুন-সর্বাধিপত্যবাদের গ্রাসে আমাদের দেশ!

ব্যক্তিগত সম্পর্ক
‘নতুন তীর্থ’ ছবির আউটডোরে এক শিশুশিল্পী হিসেবে যখন তোপচাঁচিতে পৌঁছলাম, তখন দেখি একরাশ বিখ্যাত শিল্পী আমার চোখের সামনে। এই প্রথম দেখলাম মলিনা দেবীকে। দেখলাম ছায়া দেবীকে। ছোটবেলায় মাকে ছাড়া যে আউটডোরে গেছি, সেই অভাব ভুলিয়ে দিয়েছিলেন মলিনা দেবী এবং ছায়া দেবী। পরেশ (যে চরিত্রের শিল্পী আমি) তীর্থযাত্রীদের সঙ্গ ছাড়তে হল চোর অপবাদ নিয়ে, সে খবর শুনে মলিনা দেবী ছায়া দেবীকে বলছেন, ‘‘সব ছেড়ে
তীর্থ করতে বেরিয়ে এ কী বন্ধনে বাঁধা পড়লাম বৌমা? কোথা থেকে এত টান আসে বলতে পারো?” ফ্লোরের মধ্যে সবার চোখে জল মলিনা দেবীর এই অভিনয় দেখে। ‘লব কুশ’ ছবিতে আমি লবের চরিত্রে। তিনি রাজমাতা কৌশল্যা। ওই পোশাকে তাঁকে অপূর্ব লেগেছিল। ‘বৌদি’ ছবিতে বৌদির (সন্ধ্যারানি) ছেলে চন্দন আমি। মলিনা দেবী সন্ধ্যারানির খুড়শাশুড়ি। একটি নাটকীয় দৃশ্যে দুর্ধর্ষ দুই অভিনেত্রী যখন মুখোমুখি ফ্লোরের মধ্যে সবাই মন্ত্রমুগ্ধ।

আরও পড়ুন-নবান্নের নোটিশ ১৩ হাসপাতালকে

অন্যান্য গুণপনা
জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭৬ সালে তিনি পান সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার। গিরিশ সংসদ তাঁকে ‘নাট্যসম্রাজ্ঞী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ‘ছোটা ভাই’ হিন্দি ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সম্মান পেয়েছেন।
‘আমোদ’ নামে অধুনালুপ্ত পত্রিকায় গল্প-কবিতা-গান লিখেছেন পূর্ণিমা দাসী ছদ্মনামে। থিয়েটার করা মেয়ে, বাজারে বদনাম থাকে, তাই ছদ্মনাম। শেষ মঞ্চাভিনয় করেছেন রঙ্গনা থিয়েটারে ‘নট-নটী’ নাটকে। সেখানে তিনি গঙ্গামণি চরিত্রের শিল্পী। মহিলা শিল্পী মহলের তিনি উদ্যোক্তাদের পঞ্চকন্যার একজন। অন্যরা হলেন কানন দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী, ভারতী দেবি, সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায়। আলিবাবা-সহ কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। উত্তমকুমার যখন শিল্পী সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন তখন মলিনা দেবী সহ-সভানেত্রী হয়েছিলেন। বাংলার বিখ্যাত সব পরিচালকদের ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। শিল্পী সংসদ প্রযোজিত উত্তমকুমার পরিচালিত ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিতে তিনি অট্টামার চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে চমৎকৃত করেছিলেন। তাঁর শেষ অভিনীত ছবি ‘ময়না’ মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালে। গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এমজি এন্টারপ্রাইজ নাট্যসংস্থা খুলেছিলেন। রানি রাসমণি, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রভৃতি নাটক তাঁরা কলকাতা এবং বিভিন্ন শহরে মঞ্চস্থ করেছিলেন।

আরও পড়ুন-আগাথা ক্রিস্টি, দ্য কুইন অফ ক্রাইম

পরলোক যাত্রা
মলিনা দেবী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ১৯৭৭ সালের ১৩ অগাস্ট। মূলত মমতাময়ী চরিত্রে তিনি যে অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন সেই শূন্যস্থান অপূর্ণই রয়ে গেছে। সেখানেই তাঁর শিল্পী জীবনের চরম সার্থকতা তা নিঃসন্দেহে বলা চলে।

Latest article