আগাথা ক্রিস্টি, দ্য কুইন অফ ক্রাইম

২৩ এপ্রিল দিনটিকে আন্তর্জাতিক বই দিবস হিসেবে পালন করা হয় ইউনেস্কোর তরফে। দিনটিকে বিশ্ব কপিরাইট দিবস বলেও মানা হয়। এমন এক দিনে এমন এক লেখিকার কথা মনে পড়া স্বাভাবিক সারা বিশ্বে এক শতকের বেশি যাঁর বই সমান হারে জনপ্রিয় ও বিক্রির নিরিখে তুলনীয় একমাত্র বাইবেল ও উইলিয়ম শেক্সপিয়রের সঙ্গে! সেই বিশ্ববন্দিত লেখিকা আগাথা ক্রিস্টিকে স্মরণ করলেন প্রীতিকণা পালরায়

Must read

গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের তথ্য অনুয়ায়ী বিশ্বের সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের লেখিকা হলেন ‘মিস মার্পল’ ও ‘এরকুল পোয়ারো’র স্রষ্টা আগাথা ক্রিস্টি। ‘ম্যারি ওয়েস্টকোট’ ছদ্মনামে যিনি শুরু করেছিলেন তাঁর লেখক-জীবন। বিশ্বব্যাপী বিক্রীত বইয়ের সংখ্যা যার দুশো কোটিরও বেশি। গোটা দুনিয়ায় ৫৬টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লিখিত বই। রহস্য উপন্যাসকে সাহিত্যের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়াও এই বিভাগে দুনিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক আগাথা ক্রিস্টিকে তাই তাঁর অসামান্য গোয়েন্দাগিরির জন্য ‘দ্য কুইন অফ ক্রাইম’ উপাধিতে ভূষিত করেছে তাঁর ভক্ত পাঠকবৃন্দ। ইউনেস্কোর বিবৃতি অনুসারে তিনিই একমাত্র লেখক যাঁর রচনা সবচেয়ে বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

আরও পড়ুন-সাহিত্যের অঙ্গনে মহিলা সাহিত্যিক

অথচ এহেন মানুষটি ছোটবেলায় স্কুলে পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ পাননি। মাত্র এগারো বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ ঘটলে তাঁর পরিবারকে প্রবল আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ নেন নিজের মায়ের কাছেই। এর চেয়েও অবাক করার মতো যে তথ্য, তা হল, তাঁর প্রথম বইটি তিনি লিখেছিলেন নিজের বোনের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে। বোন শুধু ঠাট্টা করে বলেছিলেন, মেয়েরা ছেলেদের মতো জোরদার গোয়েন্দা গল্প ফাঁদতে পারে না। চ্যালেঞ্জটি মনে মনে নিয়ে লিখে ফেলেছিলেন, ‘দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস’। যদিও বইটি ছাপার অক্ষরে দেখার জন্য তাঁকে প্রায় পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ছয় জনেরও বেশি প্রকাশক পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি হাল হারেননি।

আরও পড়ুন-পিতা-পুত্রী সংবাদ 

নিয়েছিলেন বিকল্প পন্থা। ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপার জন্য দিয়েছিলেন উপন্যাসটি। আশা করেছিলেন কোনও প্রকাশকের চোখে পড়লে তিনি ছাপতে রাজি হবেন। আশা পূর্ণ হয়েছিল তাঁর। ‘দ্য টাইমস’-এ পড়েই তাঁকে বইটি ছাপার প্রস্তাব দেন জন লেইন। কিন্তু আইকনিক চরিত্র ‘এরকুল পোয়ারো’র মাধ্যমে রহস্য-সাহিত্যের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল যে বইটি তার ‘কপিরাইট’ ছাড়তে হয়েছিল ক্রিস্টিকে। পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন মাত্র ২৫ পাউন্ড। তবে বই প্রকাশের পর পরই ছবিটা পাল্টে গিয়েছিল। শার্লক হোমস-এর তুমুল জনপ্রিয়তার মাঝেও নিজের আলাদা জায়গা করে নিতে সমর্থ হয়েছিল এরকুল পোয়ারো। এটা ১৯২০ সাল।

আরও পড়ুন-অস্ত্র কারখানার হদিশ

একেবারে শুরুতে ম্যারি ওয়েস্টকোট নামে ৬টি রোমান্টিক উপন্যাস লিখেছিলেন, তারপর আগাথা ক্রিস্টি নামেই লিখতে শুরু করেন। ৬৬টি গোয়েন্দা উপন্যাস ও ১৪টি ছোটগল্প সংকলন-সহ মোট ৮০টি বই লেখেন যার মধ্যে তাঁর এরকুল পোয়ারো রহস্যের জট খুলেছেন ৩৩টি রহস্য উপন্যাসে এবং ৫০টিরও বেশি গল্পে। অন্যদিকে মিস মার্পল ১২টি উপন্যাসে এবং ২৭টির বেশি গল্পে। অগুণতি সিনেমা, সিরিজ ও নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে তাঁর লেখার ওপর ভিত্তি করে। বিশ্বের দীর্ঘতম সময় ধরে মঞ্চস্থ নাটক ‘দ্য মাউস্ট্র্যাপ’ তাঁর রচনা। ওয়েস্ট অ্যান্ড থিয়েটারে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে টানা তিরিশ বছর। ব্রিটিশ এই লেখিকা জন্মেছিলেন ইংল্যান্ডের ডেভনের টর্ক-এ ১৮৯০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। বাবা ফ্রেড্রিক আলভা আমেরিকান ও মা ক্লারিসা মার্গারেট ব্রিটিশ। তিন ভাইবোনের মধ্যে আগাথা ছিলেন সবচেয়ে ছোট। বিয়ের আগে অবধি পদবি ছিল ‘মিলার’। আর্চি বন্ড ক্রিস্টি নামে এক পাইলটের সঙ্গে বিয়ের পর ক্রিস্টি পদবি গ্রহণ করেন। পরবর্তী কালে এই স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও পদবিটি রেখে দিয়েছিলেন। ম্যাক্স ম্যালোবেন নামের এক প্রত্নতত্ত্ববিদকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন যিনি ইরাকে থাকতেন। আগাথা বছরের বেশ কয়েকটি মাস স্বামীর কাছে ইরাকে গিয়ে থাকতেন।

আরও পড়ুন-দাম নিয়ন্ত্রণে হানা এনফোর্সমেন্টের

আগাথা-সৃষ্ট এরকুল পোয়ারো ইউনিক হয়েছিলেন লেখকের কল্পনার গুণেই। পায়ের ছাপ কিংবা সিগারেটের ছাই দেখে গোয়েন্দাগিরিতে তাঁর আপত্তি ছিল ভীষণ। বিশ্বাস রাখতেন নিজের মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটারে। টেনেটুনে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির পোয়ারো ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। পরিচ্ছন্নতা নিয়ে নিদারুণ শুচিবায়ুগ্রস্ত। ভুল ইংরেজি বলা বা শেক্সপিয়র থেকে ভুল কোট করতে ওস্তাদ। উত্তেজিত হলেই প্রবলভাবে ফরাসি বলতেন কিন্তু কেউ তাঁকে ফ্রেঞ্চ বললে প্রবল জাত্যাভিমানী পোয়ারো ভুল শুধরে দিতেন তাঁর, তিনি ফ্রেঞ্চ নন, বেলজিয়ান। আসলে আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা গল্প লেখার ভাবনা যখন আসে তখন তিনি এক ডিসপেনসারিতে নার্সের কাজ করেন। সেই সময় ইংল্যান্ডের টর্কিতে একদল বেলজিয়াম শরণার্থীকে দেখে ক্রিস্টি ঠিক করেন তাঁর গোয়েন্দা হবেন এক বেলজিয়ান। পোয়ারোকে আসলে কার আদলে সৃষ্টি করেছিলেন আগাথা ক্রিস্টি তা নিয়ে খুব নির্দিষ্ট করে বলে যাননি কোথাও। আত্মজীবনীতে জানিয়েছিলেন শুধু, “হঠাৎ বেলজিয়ান উদ্বাস্তুদের কথা মনে পড়ল আমার…তাহলে আমার গোয়েন্দা একজন বেলজিয়ানই হোক না কেন? রিফিউজি পুলিশ অফিসার হলে কেমন হয়?” এভাবেই সৃষ্ট হয়েছিল চিরকালের মতো বিশ্ব সাহিত্যে জায়গা করে নেওয়া এক গোয়েন্দা। আগাথার সর্বাধিক বিক্রীত বইগুলি বেশিরভাগই এরকুল পোয়ারো সিরিজের।
বেড়াতে খুব ভালবাসতেন আগাথা ক্রিস্টি। প্রত্নতাত্ত্বিক স্বামীর সঙ্গে প্রচুর বেড়াতেন।

আরও পড়ুন-বিদ্বেষ ছড়ানো নিয়ে হলফনামা, দিল্লি পুলিশকে তোপ দাগল সুপ্রিম কোর্ট

প্রত্নতত্ত্বের প্রতিও ছিল আলাদা টান। সেসবের ছাপ থাকত তাঁর লেখাতেও। ‘মার্ডার ইন মেসোপটেমিয়া’, ‘ডেথ ওন দ্য নাইল’, ‘মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’ উপন্যাসগুলিতে টের পাওয়া যায়। এ-ছাড়াও এরাকুল পোয়ারোর অনেক উপন্যাসের প্লটই ক্রিস্টি নিয়েছেন বাস্তবের ঘটনা থেকে। ‘স্যাড সাইপ্রাস’, ‘দ্য এবিসি মার্ডারস’ এগুলি তার উদাহরণ। বিখ্যাতদের জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে যা সাধারণের কাছে থেকে যায় রহস্যাবৃত হয়ে। আগাথা ক্রিস্টির জীবনেও এমন একটি ঘটনা প্রচলিত আছে। তখন তিনি বেশ পরিচিত। আচমকাই উধাও হয়ে যান। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। শেষে প্রায় ১১ দিন বাদে তাঁর খোঁজ পাওয়া যায় ইয়র্কশায়ারের একটি হোটেলে। মনে করা হয় সাময়িক অ্যামনেশিয়ার কারণে এমনটা হয়েছিল আবার অনেকে বলেন সমস্তটাই ছিল পাবলিসিটি স্টান্ট। সে-সময় নাকি তাঁর বই বিক্রি কিছুটা কমে গিয়েছিল, তাই পরিকল্পিত এই নাটক! তবে এসব বাদ দিয়ে আজও বিশ্ব সাহিত্যের জনপ্রিয়তম লেখকদের মধ্যে না ভেবেই নাম নেওয়া যায় আগাথা ক্রিস্টির। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১২ জানুয়ারি, ১৯৭৬, ৮৫ বছর বয়সে। কিন্তু ১৯২০ সালে যে ঝান্ডা উড়িয়েছিলেন গুঁফো গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো আজও তা উড়ে চলেছে স্বমহিমায়।

Latest article