সর্বাধিপত্যবাদের গ্রাসে আমাদের দেশ!

সবকিছুর দখলদারি চাই। ম্যায় মগজেরও। তাই হিজাব হোক বা রাম নবমীতে আমিষ ভক্ষণ, সবকিছু নিয়েই হিংসার ঘূর্ণাবর্ত নিয়ত। সংসদীয় গণতন্ত্রকে শিকেয় তুলে বিরোধী মুক্ত ভারত চাইছে গেরুয়া পক্ষ। এই অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। লিখছেন পূর্ণেন্দু বসু

Must read

সবর্বাধিপত্যবাদ একটি মতবাদ। এই মতবাদ একটি বিশেষ রাজনৈতিক ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রসারিত হয়। ভাবনাগত দিক থেকে এই মতবাদ ফ্যাসিবাদ তথা নাৎসিবাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই বিষয়ে বহু আলাপ আলোচনা-লেখা হচ্ছে এবং আরও হবে। ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে সর্বাধিপত্যবাদের প্রভাব এখন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ইংরেজি পরিভাষায় সর্বাধিপত্যবাদ হল টোটালিটারিয়ানিজম (totalitarianism) যা সবকিছু দখল করতে চায়। মগজ পর্যন্ত। বর্তমানে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতে এই মতবাদের প্রতিষ্ঠা-পর্ব চলছে।

আরও পড়ুন-নবান্নের নোটিশ ১৩ হাসপাতালকে

কয়েকটা সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক— সম্প্রতি রামনবমীকে কেন্দ্র করে বহুস্থানে মাংস বিক্রি এবং আমিষ খাওয়ার বিরুদ্ধে প্রচার ও সন্ত্রাসের বাড়াবাড়ি দেখলাম আমরা। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) এবিভিপি-র তাণ্ডব দেখলাম। বিষয়টা শুধু সেখানেই থেমে থাকল না, জেএনইউ-র উপাচার্যকে দেখলাম, এ বিষয়ে সঙ্ঘ পরিবারের আধিপত্যবাদী মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার হীন অপচেষ্টাকে মদত দিতে। কর্ণাটকে ‘হিজাব’ নিয়ে যা চলছে তা-ও এই মতবাদেরই প্রকাশ। কাশ্মীর প্রশ্নে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল হল একটি রাজ্যকে দু’ভাগে ভেঙে দিয়ে দু’টি কেন্দ্রীয় শাসনাধীন অঞ্চলে পরিণত করার আর একটি দৃষ্টান্ত। এর লক্ষ্য হল— ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একমাত্র রাজ্যে হিন্দু প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা।
এই সর্বাধিপত্যবাদের বড় প্রদর্শন ক্ষেত্র হল সংসদ। শাসক পক্ষ যা মনে করবে, সেটাই সংসদে পাশ করাবে। কৃষি আইন, লেবার কোড থেকে শুরু করে একের পর এক আইন পাশ করানো হচ্ছে গায়ের জোরে। এই মতবাদ সবকিছুকে গ্রাস করছে। সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে শিক্ষা-ইতিহাস-ভূগোল, কোনও কিছু বাদ নেই। সঙ্ঘ পরিবার সবকিছুকে অক্টোপাসের মতো টেনে ধরছে। তাই ওরা বলে, ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’ গড়ার কথা। আসলে সঙ্ঘ পরিবার অর্থাৎ আরএসএস পরিবার, বিরোধী-মুক্ত শাসন চায়।

আরও পড়ুন-‘দুয়ারে ভ্যাকসিন’ কর্মসূচি হাওড়ায়

সঙ্ঘ পরিবারের উদ্যোগে, নাগরিক আইনের সংশোধন করে মোদি সরকার ভারতে বসবাসকারী মুসলিমদের একটা বড় অংশকে বিদেশী বলে চিহ্নিত করার কাজ করছে। সঙ্ঘ পরিবারের যাঁরা বিরোধিতা করবে, তাঁদের সরকারের যাঁরা সমালোচনা করবেন, তাঁদের দেশদ্রোহী, পাকিস্তানপন্থী, আরবান নকশাল বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। দিল্লির শাহিনবাগে নতুন নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে লাগাতার অবস্থানকে ‘উচিত’ শিক্ষা দিতে দিল্লির পরিকল্পিত দাঙ্গা ঘটানোর উদ্যোক্তা এই সঙ্ঘ পরিবার। ‘জয় শ্রীরাম’—রণধ্বণি ‘পুরুষোত্তম’ রামের জয়ধ্বনি নয়। এটা হল সর্বাধিপত্য প্রতিষ্ঠার রণহুংকার। রাষ্ট্র ও সরকার এদের কাছে এক। আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য অর্থাৎ ক্ষমতার স্বাতন্ত্রীকরণে এরা বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে না বহুত্বে। জাতি-ধর্ম-ভাষা-রাষ্ট্র-সব কিছুকেই এরা হিন্দুত্বের ফ্রেমে ভরে দিতে চায়। তা না হলে, হিন্দুরাষ্ট্রের কথা আসছে কেন? অমিত শাহ কেন হিন্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার তত্ত্ব পরিবেশন করছেন?

আরও পড়ুন-শীঘ্রই শিয়ালদহ থেকে মেট্রো

প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে চলছে সর্বত্র সার্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজ। এই সর্বাধিপত্যবাদ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করচে চায়। তাই সংসদের সব আসন দখল করতে হবে, সব রাজ্যে সরকার গড়তে হবে এবং তার জন্য যে-কোনও পথ, যে-কোনও কৌশল গ্রহণ করতে এই শক্তির কোনও আপত্তি নেই। ১৯১৪ সালে কেন্দ্র ক্ষমতা দখল করে সঙ্ঘ পরিবারের যে শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে তা এগিয়ে চলেছে সর্বাধিপত্যবাদী মতবাদ অনুযায়ী।
এই মতবাদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আকারে আরও কিছু কথা বলা যায়। উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালীন আলাপ-আলোচনায় সর্বধিপত্যবাদ সম্পর্কে ধ্রুপদী বা ক্লাসিক বই রচনা করেছিলেন এক জার্মান ইহুদি মহিলা। তাঁর নাম Hanah Arendth বইটির নাম The Origins of Totalitarianiam। এই বইতে আলোচনা করা হয়েছে, তা বর্তমান ভারতের ক্ষেত্রে যা চলছে— সেটা বুঝতে সাহায্য করবে। এই বইটিতে দেখানো হয়েছে, কী ভাবে সর্বাধিপত্যবাদ একটা ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ এবং অভিজাতদের অংশকে আকর্ষণ করে। ভারতের যে কাজটা করে গিয়েছেন, সাভাকর, হেডগেওয়ার, গোলওয়ালকার থেকে তাঁদের অনুসরণকারীরা। ৯০-এর দশকে রামমন্দির নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি, আদবানীর রথযাত্রা, দাঙ্গা, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা, গুজরাত গণহত্যা এবং মোদিকে সামনে রেখে ক্ষমতা দখল। এটাকে আমরা বলতে পারি সর্বাধিপত্যবাদী-অভিযান। সাম্প্রদীয়িকতা, মেরুকরণের রাজনীতি, ধর্মীয় ভাবাবেগ সুষ্টি, উগ্র জাতীয়তা তথা দেশপ্রেমের উন্মাদনা— এইসব হল এই অভিযানের এক একটি হাতিয়ার।
Arendt দেখিয়েছেন, একটি সাংবিধানিক সরকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকা শাসন ব্যাবস্থায় যখন সর্বাধিপত্যবাদীরা ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে আন্দোলন করে, তখন তারা সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসের পথও গ্রহণ-করে। এই শক্তি ক্ষমতা দখলের পরেও প্রচার এবং সন্ত্রাস চালিয়েই নিজ আধিপত্য বজায় রাখে। এই ব্যবস্থায় প্রচার এবং সন্ত্রাস— যেন একই মুদ্রার অপিঠ-ওপিঠ। পাঠক মোদি জমানার কথা ভাবতে থাকুন। দেখবেন ওই ব্যাখ্যার সঙ্গে কী অপূর্ব মিল।

আরও পড়ুন-জামিন লালুর

Arendt আরও বলেছেন, নিরুঙ্কুশ ক্ষমতা দখলের পর সর্বাধিপত্যবাদীরা সাধারণ প্রচারের বদলে মানুষকে নিজেদের মতবাদের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস গ্রহণ করে। মোদি জমানায় সেই লক্ষ্যে বহু বিদ্বান ব্যক্তিকে দিয়ে ধারাবিহিকভাবে তাঁদের পক্ষে নানা বিষয়ে বই লেখানো হচ্ছে। মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে জোর কদমে। সর্বাধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে এই বিষয়টাও মাথায় রাখা দরকার। মাথায় রাখা দরকার, ‘ভয়ের দ্বারা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ’ করার সর্বাধিপত্যবাদী কৌশলের বিষয়টিও।
সর্বশেষে বলব, মোদিরা একা নয়, সর্বাধিপত্যবাদী মতাদর্শ পৃথিবীর নানা দেশে তার থাবা বিস্তার করেছে। আবারও শুরু হয়েছে যুদ্ধ। হিটলার, মুসোলিনির প্রেতাত্মা ভর করেছে ট্রাম্প, কখনও পুতিন, কখনওবা নরেন্দ্র মোদির উপর। তাই অগণতন্ত্র এবং অনুদারতন্ত্র (Illiberalism) আজ নিজেদের জাহির করতে চাইছে। অনগত ভবিষ্যত কোনদিকে সেটাই বর্তমানের এক জটিল প্রশ্ন। একটা বড় রহস্য। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘গ্রেট প্যারাডক্স’। সর্বাধিপত্যবাদ- নিপাত যাক।

Latest article