আফগানিস্তান নিয়ে প্যাঁচে মোদি সরকার

Must read

স্রেফ রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা। পরিস্থিতি সম্পর্কে আগে থেকে ওয়াকিবহাল থাকলেও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না-পারা, এ জন্যই এখন আফগানিস্তান হয়ে উঠতে পারে ভারতের গলার কাঁটা। মোদি সরকারের ভুল নীতি কি তবে আমাদের শত্রুর সংখ্যা বাড়াবে?
সাবধান বাণী শুনিয়েছেন জয়ন্ত ঘোষাল

কলেজ জীবনে আন্তর্জাতিক রাজনীতির টেক্সট বইটি ছিল ফ্রাঙ্কেল-এর। ফ্রাঙ্কেল তাঁর আন্তর্জাতিক রাজনীতির বইয়ের প্রথম পাতাতেই লিখেছিলেন, ‘বিদেশ নীতি হল, সার্বভৌম রাষ্ট্রের যা ইচ্ছা, তা বাস্তবায়ন করার জন্য যে নীতি ব্যবহার করা হয়, সেটা।’ অর্থাৎ, আমাদের ইচ্ছে এবং কার্যকরী ইচ্ছের মধ্যে সবসময়ই একটা তফাত থাকে। ফ্রাঙ্কেল ‘Will’ এবং ‘Effectivewill’-এর কথা বলেছেন।
ভারত নামক সার্বভৌম রাষ্ট্র আমাদের। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাই আমরা। আর গোটা দুনিয়ার সবার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখাটাই আমাদের অভিলাষ। যদিও তা সবসময় সম্ভব হয় না। যেমন, কিছুদিন আগেও আফগানিস্তানের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক ছিল। সেইসময় কারজাইয়ের সরকার, তালিবানের শক্তির সঙ্গে মিলিতভাবেই সরকার চালিয়েছিল। তখন সেই তালিবানি গোষ্ঠী কারজাইয়ের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং আফগানিস্তানে আপাতভাবে শান্তি এসেছিল। ভারত যখন তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখত তখন আবার পাকিস্তান এই ভারত-আফগান সম্পর্ক নিয়ে খুব খুশি ছিল না।

আরও পড়ুন- ঐতিহাসিক রুপো জয় ভাবিনাবেনের

সেই নেহরুর সময় থেকেই আমাদের আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান নীতি, নানা ঘাত-প্রতিঘাতে এগলেও আফগানিস্তানের সঙ্গে আমরা চেষ্টা করেছি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। ঠিক যেমন ইরানের সঙ্গেও সম্পর্কটা ভাল রাখতে চেয়েছি। তার কারণ, ইরান হল প্রতিবেশীর প্রতিবেশী, অর্থাৎ পাকিস্তানের প্রতিবেশী। তাই ইরানের সঙ্গে ঝগড়া করা যেমন বুদ্ধিমানের কাজ নয়, তেমনই আফগানিস্তানের সঙ্গে ঝগড়া করাও কিন্তু বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অর্থাৎ, শত্রুর সংখ্যা বাড়ানো উচিত নয়। শত্রুকে যতটা বিচ্ছিন্ন করা যায়, ততটাই সঠিক রণকৌশল। ঠিক এই কারণেই, ইজরাইলের সঙ্গে ইরানের এত বিষময় সম্পর্ক হওয়া সত্ত্বেও আমরা কিন্তু ইজরাইলের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিসাধন করলেও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করিনি।

আরও পড়ুন- প্রেসক্লাবে সগৌরবে প্রকাশিত হল চন্দ্রা চক্রবর্তীর ‘ছয় তারের তানপুরা’

এই কারণেই অটলবিহারী বাজপেয়ী থেকে মনমোহন সিংহ, এমনকী নরেন্দ্র মোদিও রাষ্ট্রসংঘে ইরানের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। শুধু তেলের জন্য নয়, এই জিও স্ট্র্যাটেজিক কারণেও ইরানকে আমাদের পাশে রাখাটা দরকার ছিল। নরেন্দ্র মোদি সরকারের সাত বছর অতিবাহিত হয়েছে। ২০১৪ সালে সরকারে আসার পরে নরেন্দ্র মোদিও বলেছিলেন, তিনি সমস্ত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চান।
কিন্তু বাধ সাধল আফগানিস্তান। সেখানে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হল যার ফলে ভারতের বিদেশনীতি একদম মুখ থুবড়ে পড়ল। ‘ন যযৌ, ন তস্থৌ’ পরিস্থিতি তৈরি হল। এর জন্য আমরা যদি পাকিস্তান, আইএসআই এবং মোল্লাতন্ত্র-কে দায়ী করি, তবে তাতে কিন্তু আমাদের দুর্বলতাই প্রকাশ পাবে। কেননা, পাকিস্তান আয়তনে এবং শক্তিতে আমাদের থেকে অনেক ছোট রাষ্ট্র। পাকিস্তান যদি একাই আফগানিস্তানের মতো একটা রাষ্ট্রে মার্কিন সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে, তালিবানি শক্তির মাধ্যমে সেখানে নতুন একটা সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র তৈরি করতে পারে, তা হলে আমাদের ভারতের মতো একটা এত বড় রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে পুতিনের রাশিয়া— সবার সঙ্গে এত কূটনৈতিক দৌত্য করার পরেও যদি এইরকম পরিস্থিতি দাঁড়ায়, তবে সেটা তো ভারতের পক্ষে এক চূড়ান্ত ব্যর্থতার নজির।

আরও পড়ুন- জন্মাষ্টমী দেশের নানা প্রান্তে, ভারতের বাইরেও

আফগানিস্তানে যে ৩১শে অগাস্ট মার্কিন সেনা প্রত্যাহার হবে, সেটাও নতুন কথা নয়। ট্রাম্প নিজেই দোহাতে চুক্তি করেছিলেন এবং আফগানিস্তানে তালিবানি শক্তির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়েছেন। আর বাইডেনও বলে দিয়েছিলেন যে, তাঁর মূল লক্ষ্য এখন চিনের সঙ্গে প্রযুক্তিগত লড়াই। ট্রাম্পের মতো বেশি আস্ফালন করে প্রকাশ্য যুদ্ধ নয়। এটা হল টেকনোলজির নতুন ঠান্ডা যুদ্ধ। সেই কারণে চিনকে অগ্রাধিকারে রাখার জন্য আফগানিস্তানের মার্কিন ডিফেন্সবাজেট খাতে তিনি আর এত টাকা খরচ করবেন না। এমনকী, ইরাক নিয়েও তাঁর উৎসাহ কমিয়ে দিয়েছেন। অনেকে বলছেন, মার্কিন নাগরিকেরাও আর চাইছেন না, বাইরের দেশে নাক গলিয়ে এত টাকা খরচ করা হোক। কেননা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। তারাও নানারকমের সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে, করোনাকালে তো আর্থিক সঙ্কট আরও বেড়েছে।

আরও পড়ুন- রাজ্যে বাড়ল করোনা বিধিনিষেধের মেয়াদ, আনলক প্রথা অব্যাহত

এসব কিছুই তো মোদি সরকারের জানা ছিল। এমনকী, কিছুদিন আগে, ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার অজিত ডোভাল আফগানিস্তান গিয়ে তালিবানদের সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন, তালিবানরা যদি ক্ষমতায় আসে তা হলে কী-হবে না-হবে— সে-সব নিয়ে।

এখন দেখা যাচ্ছে— সত্যি কথা বলতে— তালিবানি শক্তি কিন্তু ভারতীয়দের ওপর আক্রমণ করছে না। আমেরিকান সেনাদের ওপর আক্রমণ করছে না। কেননা, তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে এখন আফগানিস্তানে রাষ্ট্র গঠন করা। আর আমরা কী করব, তা ভারত রাষ্ট্র স্পষ্টভাবে বলেনি। শুধু ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’-এর নীতি নিয়েছে। কিন্তু ‘ওয়েট আ্যান্ড ওয়াচ’ ছাড়া এখানে কি কিছু করার আছে?
(এরপর আগামীকাল)

Latest article