ঘোষণা হয়েছিল রাজ্য বাজেটে। সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন শুরু আজ ১ এপ্রিল থেকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সাড়া জাগানো প্রকল্প লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। সেই প্রকল্পের বর্ধিত ভাতা কার্যকর হচ্ছে নয়া অর্থবর্ষের প্রথম দিনেই। তবে প্রতি বছরের মতো এবারও ১ এপ্রিল ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকায় উপভোক্তাদের অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছতে লেগে যাবে আরও এক-দু’দিন। মোট ২ কোটি ১৬ লক্ষ মহিলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে বর্ধিত হারে ভাতা পৌঁছবে। এ মোদির জুমলা নয়, দিদির গ্যারান্টি।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে খুশি রাজ্যের ২ কোটি ১৬ লক্ষ মহিলা, ২ এপ্রিল থেকেই বর্ধিত লক্ষ্মীর ভাণ্ডার
মোদির গ্যারান্টি কেমন? সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রার্থীদের প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়ে বলেছেন ৩০০০ কোটি টাকা মানুষকে ফিরিয়ে দেব, আপনারা প্রচার করুন। ১৪০ কোটির দেশে এই টাকা বণ্টন করলে মাথা-পিছু ২১ টাকা দাঁড়ায়। আমাদের জিজ্ঞাসা, তাহলে কি বিজেপি এই সামান্য টাকা দিয়ে পাঁচ বছরের ভোট কিনতে চাইছে? বিজেপির এই ফাঁদে পা না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
ইডি, সিবিআই, আয়কর দপ্তর এবং এনআইএ তো বিজেপির তল্পিবাহক। মেঘের আড়াল থেকে নয়, সামনে এসে লড়াই করুক তারা। ইডি, সিবিআই, আয়কর দপ্তর এবং এনআইএ’র অধিকর্তাদের রাজনীতির ময়দানে এসে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছেন অভিষেক। এজেন্সির লোকজনকে ডায়মন্ড হারবারে প্রার্থী হওয়ারও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর স্পষ্ট কথা, জনতার দরবারে বিচার হোক, দেখবেন মানুষ জবাব দিয়ে দেবে।
কেন মানুষ জবাব দেবে? কারণ, এই রাজ্যে মহিলাদের সশক্তিকরণ কোনও জুমলা নয়। একেবারে প্রত্যক্ষ সত্য।
আরও পড়ুন-ঝড়ের তাণ্ডব, প্রচার থামিয়ে হাসপাতালে গৌতম ও নির্মল
২০২১-এ বিধানসভা ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। সেই বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে এসসি-এসটি সম্প্রদায়ের মহিলাদের জন্য মাসে এক হাজার টাকা এবং বাকিদের জন্য পাঁচশো টাকা করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো শুরু করে সমাজকল্যাণ দপ্তর। এবার লোকসভা ভোট ঘোষণার অনেক আগেই মুখ্যমন্ত্রী বর্ধিত হারে ভাতার কথা ঘোষণা করেছিলেন। সেইমতো কাল থেকে শুরু হচ্ছে প্রতিশ্রুতির রূপায়ণ। কোভিড অতিমারির সময় মানুষের হাতে নগদ টাকার জোগান বাড়ানোর জন্য একাধিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার অন্যতম এই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার।
আরও পড়ুন-নিশীথের গুন্ডামি অব্যাহত, ফের মন্ত্রী উদয়নের গাড়িতে হামলা
উপভোক্তারা মাসে মাসে এই টাকা হাতে পেয়ে নানা ধরনের কাজে লাগাতে পেরেছেন। প্রতীচী ট্রাস্টের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের প্রায় ৭৮ শতাংশ উপভোক্তা সংসার খরচ চালাতে এই টাকা কাজে লাগিয়েছেন। প্রায় ৪২ শতাংশ উপভোক্তা টাকা খরচ করেছেন ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য। প্রায় ৩৫.৩ শতাংশ মহিলা পোশাক, প্রসাধনী, খাওয়াদাওয়ার মতো নিজেদের সাধপূরণ করতে খরচ করেছেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। এই আবহে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই নানা মহল থেকে ভাতা বৃদ্ধির দাবি উঠেছিল। সেই দাবিকে মান্যতা দিয়েছে মা-মাটি-মানুষের সরকার। যাঁরা এতদিন ৫০০ টাকা করে পেতেন, তাঁরা পাবেন দ্বিগুণ। এসসি, এসটি তালিকাভুক্ত মহিলারা এতদিন ১০০০ টাকা করে পেতেন। তাঁরা পেতে চলেছেন ১২০০ টাকা করে। সেই সঙ্গে এই খাতে রাজ্যের প্রতি মাসের খরচও প্রায় দ্বিগুণ হতে চলেছে। মার্চ মাসে যেখানে এই ভাতার জন্য খরচ হয়েছিল ১ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা, সেই জায়গায় এপ্রিলে রাজ্যের কোষাগার থেকে বেরবে ২ হাজার ২২৮ কোটি।
আরও পড়ুন-বিয়ে করলেই শ্রীঘরে প্রবীণ নেতাকে হুমকি অসমের মুখ্যমন্ত্রীর, সমালোচনার ঝড় রাজনৈতিক মহলে
বিষ্ণুপুর থানার উলিয়ারা পঞ্চায়েতের ডিহর গ্রাম। এই এলাকায় বাউরি এবং ছিন্নমূল পরিবারের সংখ্যা বেশি। অধিকাংশই গরিব, খেটেখাওয়া মানুষ। এঁদের জীবনে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বিনা পয়সায় রেশন, কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্পের অবদান ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বাঁকুড়ার জগদল্লা-২ পঞ্চায়েতের হরলকানালি শালতলা। সেখানেও প্রান্তিক মানুষের জীবনে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের গুরুত্ব তুলনারহিত। নিয়মিত লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা পান বাঁকুড়ার শালতোড়ার রঘুনাথচকের সুকুরমণি হেমব্রম, শিবানী মাণ্ডি, অনাদি মুর্মুরা। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ফের বাংলায় ‘গেরুয়া ঝড়’ তোলার চেষ্টা করছে। মুখ সেই নরেন্দ্র মোদি। আর তা মোকাবিলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোক্ষম অস্ত্রটির নাম লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। একথা অস্বীকার করলে মিথ্যে বলতে হবে। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী প্রভৃতি প্রকল্পগুলো থেকে পাওয়া যায় এককালীন সাহায্য। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের সৌজন্যে অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসাও এখন সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। তাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ উপকৃত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের একটা আলাদা প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে। প্রতি মাসে তাঁদের অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাচ্ছে টাকা। এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবে বলে বিরোধীরা জোর প্রচার করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী লক্ষ্মীর ভাণ্ডার শুধু সচল রাখেননি, টাকার পরিমাণ দ্বিগুণ করেছেন। তাতেই তাঁর প্রতি মহিলা ভোটারদের তৈরি হয়েছে পাহাড়প্রমাণ আস্থা। একথা খণ্ডন করবে কে? প্রথম থেকেই ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হচ্ছিল। কেউ ‘ভিক্ষে’, কেউ ‘ডোল পলিটিক্স’ বলে কটাক্ষ করেছিল। আর এখন ক্ষমতায় এলে আরও বেশি টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন লোডশেডিং অধিকারীর মতো নেতারা। কেউ দু’হাজার, কেউ আবার তিন হাজারি প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন।
আরও পড়ুন-‘আমরা সবাই প্রজা কেউ রাজা নেই’ বিজেপি প্রার্থী অমৃতাকে নিশানা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
রুমাল থেকে বেড়াল হওয়ার কথা বাঙালিকে জানিয়ে ছিলেন সুকুমার রায়। এবার বাঙালির সামনে এল ‘মুখ’ থেকে ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ হওয়ার ঘটনা। সৌজন্যে নরেন্দ্র মোদি। এতদিন তিনিই ছিলেন দলের মুখ। তাঁকে দেখিয়েই বিজেপি ভোট চাইত। এবার তিনি সঙ্কট মোচনকারীর ভূমিকায়। ‘নারী সশক্তিকরণে’র নামে দলের মহিলা প্রার্থীদের ফোন করছেন। তবে, সব মহিলা প্রার্থীকে নয়। যাঁদের নিয়ে দলের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, তাঁদেরই দিচ্ছেন ‘বরাভয়’। সঙ্কট গভীর, তাই প্রধানমন্ত্রী পদে থেকেও টাকা বিলির ‘গাজর’ ঝোলাতে নেমে পড়েছেন। অভাবনীয়। অকল্পনীয়। নজিরবিহীন। পরিস্থিতি কতটা খারাপ হলে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করতে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে নামতে হয়! আর তাতেই উঠছে প্রশ্ন, ‘বেড়াল’ কি তাহলে সত্যিই ঠেলায় পড়েছে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নারী শক্তির ক্ষমতায়নের ধাক্কায় মোদি বেসামাল। তাই এমন করছেন। ২০১৪-র আগে মোদিজির একটা কথায় লক্ষ লক্ষ মানুষ আলোড়িত হত। তাঁর কথাকে ‘বেদবাক্য’ ভেবে অনেকেই চোখ বন্ধ করে পদ্মফুলে বোতাম টিপতেন। আর এখন? দলীয় কর্মীদের ক্ষোভ দূর করার জন্য তাঁকে জনে জনে ফোন করতে হচ্ছে! প্রার্থীর সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা প্রকাশ্যে আনতে হচ্ছে। বোঝাতে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর পাশে আছেন। তবেই মিটছে ক্ষোভ। ২০১৪ আর ২০২৪ সালের ‘মোদি ম্যাজিকে’র তফাতটা এখানেই। আর এই তফাতটা হয়েছে নারীর ক্ষমতায়নের বাস্তবায়নে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পের সৌজন্যে।
মোদির জুমলার সঙ্গে দিদির গ্যারান্টির এটাই তফাত।