ছোটবেলার ভূগোল একেবারেই আলাদা। তখন সাড়ে তেইশ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা কর্কটক্রান্তি আর সাড়ে তেইশ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষরেখা মর্কটক্রান্তি। মাঝে যতই বিষুবরেখার নির্লিপ্ততা থাকুক, নাম্বার কাটা আর বকুনির হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারেনি। এভাবেই বড় হতে হতে মানুষ হলাম আর মর্কট নিশ্চিত ভাবে মকর হয়ে উঠল। আজও একইভাবে গাঁয়েগঞ্জের ছেলেমেয়েরা একই ভুল করে, বকাও খায় তবু জানি ওরা মানুষ হলেই ওদের মর্কটও মকর হবে, গঙ্গাও আনবে।
আরও পড়ুন-শীত শীতে
বাংলা ক্যালেন্ডার মেনে পৌষ মাসের শেষ দিন বা পৌষ সংক্রান্তি হল মকর সংক্রান্তি। বাংলা তথা সারা ভারতে মকর সংক্রান্তির বিশেষ গুরুত্ব। কৃষিপ্রধান দেশে মূলত ফসলকে কেন্দ্র করে সব উৎসব। আর চাষ এবং জীবন যাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে আবহাওয়া। তাই জনজীবনে সূর্যের এক অসম্ভব প্রাধান্য। সূর্যের ধনু রাশি থেকে মকর রাশিতে প্রবেশের সময়কাল এই সংক্রান্তি। মকর রাশির অধিপতি গ্রহ শনি— রবিনন্দন। সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে বাবা এখন একমাস থাকবে ছেলের ঘরে। তাই উৎসব ঘরে ঘরে।
টুসু উৎসব পালন রাঢ় বাংলার একটি বিশেষ উৎসব। পয়লা পৌষে টুসুর ঘট প্রতিষ্ঠা করে প্রতিদিন সন্ধেতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লৌকিক রীতিতে পুজো করা হয়, টুসুগান গাওয়া হয়। পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে রাঢ় তথা পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় ‘টুসু জাগরণ’ হয়। পৌষ সংক্রান্তির ভোরে সূর্যোদয়ের আগে নদীতে বা পুকুরে টুসু বিসর্জন দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন-কে বেশি হিংস্র, বাঘ না মানুষ?
তুষ-তুষলীর ব্রতিনীরা এই দিন মাস-কালীন ব্রতের শেষে জমিয়ে রাখা তুষ-গোবরের গুলি মাটির হাঁড়িতে রেখে আগুন ধরায়। তারপর তা ভাসিয়ে দেয় নদী বা পুকুরের জলে।
উত্তরায়ণ সংক্রান্তিতে বাস্তুপুজোর প্রচলন আছে। পাটশলমির আগুনে, নতুন মাটির হাঁড়িতে দুধ-চাল-বাতাসা ফুটিয়ে চরু রান্না হয়। এই চরু বাস্তুপুজোর প্রধান অঙ্গ।
পৌষ সংক্রান্তি সম্পর্কিত একটি লোকাচার হল এই আওনি-বাউনি বা আউরি-বাউরি। এটি সংক্রান্তির আগের দিন পালিত হয়। তবে তবে দামোদরের দক্ষিণে এর নাম ‘চাঁউনি-বাউনি’ বা ‘চাউড়ি-বাউরি’। ধানগাছকে পুজো করে শস্য-সম্পদের শ্রীবৃদ্ধি কামনা করা হয়। তারই অঙ্গ হিসাবে বাংলার মেয়েরা ছড়া কেটে পৌষ বন্দনা করেন, ‘‘পৌষ পৌষ— সোনার পৌষ/এস পৌষ যেয়ো না/জন্ম জন্ম ছেড়ো না।/না যেয়ো ছাড়িয়ে পৌষ—/না যেয়ো ছাড়িয়ে,/পৌষ পৌষ— সোনার পৌষ।’’
আরও পড়ুন-মনন চিন্তন কল্পনার উৎসব
পৌষ সংক্রান্তির দিন দধি সংক্রান্তির ব্রতের সূচনা হয়। প্রতি সংক্রান্তিতে তা পালন করে, পরের বছর ওই একইদিনে ব্রতের প্রতিষ্ঠা বা সমাপ্তি করা হয়। এই দিন দই দ্বারা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীকে স্নান করিয়ে, দধি ও ভোজ্য ব্রাহ্মণকে দান করা হয়। ফল-সংক্রান্তি ব্রতের অনুষঙ্গ হিসেবে, এই সংক্রান্তিতে হরীতকী দান করলে হংসযুক্ত রথে আরোহণ করে বৈকুণ্ঠে গমন করা যায়।
মকর সংক্রান্তিতে বাঙালি বোঝে পিঠে পার্বণ। চালকে ঢেঁকিতে গুঁড়িয়ে সেই চাল গুঁড়ো দিয়ে রকমারি পিঠে বানিয়ে সকলকে খাওয়ানোর যে কী আনন্দ সেটা বাঙালি মায়েরা ছাড়া আর কেউ জানেন বলে মনে হয় না। কারা যেন বলেন ছেলে মেয়ে সমান! আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। নিজে কম খেয়ে অন্যকে খাইয়ে আনন্দ পাওয়ার মতো মনের প্রসারতা শুধু মেয়েদের মধ্যেই থাকে। শতাব্দী পরেও ছেলেরা এর ধারে-কাছে আসতে পারবে না।
আরও পড়ুন-আজ রাত পোহালেই মকরস্নান, নয়া রেকর্ড
অনেক জায়গায় সংক্রান্তির আগের দিন অনেকরকম রান্না আর রকমারি পিঠে বানানো হয় সারাদিন। সমস্ত পদ একটু করে আগে তুলে রেখে রাতে সেটা দিয়ে বাউনি বাঁধা হয়। বাউনির (লক্ষ্মী) থালা সাজিয়ে তার সামনে আসন পেতে জল রেখে নিবেদন করা হয়। খড় পাকিয়ে দড়ির মতো করে দরজায়, বাকসোয় এবং ভাঁড়ারের সব জিনিসে রাখা হয়। এভাবেই লক্ষ্মীকে ধরে রাখার এক আন্তরিক এবং ঘরোয়া প্রচেষ্টার নাম বাউনি বাঁধা। আসলে কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় চাষেতে বসতি লক্ষ্মী কথাটাই মনে হয় একান্ত প্রযোজ্য।
এদিন বাংলার কোনও কোনও প্রান্তিক অঞ্চলে মেহি পুজো করা হয়। মেহি শব্দের অর্থ হল খুঁটি। এদিন বত্সরান্তের কৃষিকাজের শেষে খুঁটিকে কেন্দ্র করে উত্স বের আয়োজন হয়। এই খুঁটি গরু বাঁধার স্থান, নানান কৃষিকাজের সাক্ষী, তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপই এই পুজোর আয়োজন করা হয়। খুঁটিকে কেন্দ্র করেই নানান কৃষি উপকরণের আলপনা আঁকা হয়। কৃষক পুরুষ শেয়ালের ডাক শুনে পুজোয় বসেন। পুজো শেষে সেই বছরের মতো কৃষিকার্যের সমাপ্তি হয়।
পৌষ সংক্রান্তির পরের দিন রাঢ় অঞ্চলের কোনও কোনও জায়গায় আক্ষেন বা আখ্যান দিন পালিত হয়। একে এখ্যান যাত্রাও বলা হয়।
আরও পড়ুন-ডিমা হাসাও নির্বাচন: বেশি ভোট তৃণমূলের! বাংলায় কংগ্রেসের আসন ভাগ নিয়ে কটাক্ষ অভিষেকের
এদিন লোকদেবতা ও অপদেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়। অনেক স্থানে এইদিন গ্রামের বালকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে যে চাল, ডাল, সবজি মাগন করে আনে, নিজেরাই মাঠে তা রান্না করে কুলাই ঠাকুরকে নিবেদন করে এবং একত্রে ভোজন করে। ওই মাগনকে কুলাইর মাগন বা কুলের মাগন বা পৌষ মাগন পালন করে।
মেদিনীপুরে এইদিন লৌকিকদেবী বড়াম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলিতে সিনিদেবী এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বারা ঠাকুরের যুগ্মমূর্তি, নারায়ণী ও দক্ষিণ রায়ের বাত্সরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয়।
মেদিনীপুর, পিংলা, ময়না, সবং অঞ্চলের মাহিষ্য কৃষক সম্প্রদায় এদিন বিকেলে বণিপুজোর আয়োজন করে। এটি একটি লোকাচার। এর তিনটি পর্যায়— যথা, মই খুঁটি প্রতিষ্ঠা, খেত মাড়ান এবং সাঁথ ধরা। চাষের জমিতে রক্ষিত একগুচ্ছ ধান গাছের গোড়ায় লবাৎ অর্থাৎ নতুন ধানের চাল বেটে প্রস্তুত মিষ্টান্ন ও ফলমূল নৈবেদ্য রেখে সরষে ও সাদা কলকে ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। তারপর তা মইখুঁটির সঙ্গে বাঁধা হয়। আগামী বছর ভাল ফসল লাভের আশায় প্রার্থনা করা হয়।
আরও পড়ুন-তথ্য দিয়ে তীব্র কটাক্ষ করলেন অভিষেক
আমাদের দেশের মকর সংক্রান্তির বিভিন্ন রূপ পরিলক্ষিত হয়। তামিলনাড়ুতে মহাধুমধামে পোঙ্গল উদযাপন করা হয়। সংক্রান্তিতে শুরু হয়ে, পরের মাসের তৃতীয় দিন পর্যন্ত তা চলে। তেলুগু ভাষাভাষী অঞ্চলে তা এক বা দু’দিন ধরে চলে। পঞ্জাবে হয় লোহরি। তামিলরা প্রথম দিনে কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বালান এবং সেই আগুনে পুরনো কাপড়চোপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র আহুতি দেন: জীর্ণ পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে নতুনের আবাহন। পরের দিন দুধ আর গুড় মিশিয়ে তার মধ্যে নতুন ভাজা চাল এবং মুগডাল ফোটানো হয়। যতক্ষণ না সেই দুধ উথলে ওঠে, ততক্ষণ ফোটানো চলে। দুধ উথলানোকে শুভ বলে গণ্য করা হয়, তাই সবাই উচ্চকণ্ঠে ‘পোঙ্গালো পোঙ্গল’ বলে ওঠেন। তামিল বা তেলুগু ভাষায় শব্দটির অর্থ হল ‘হাঁড়িতে ভাত সেদ্ধ করা’। এক কথায় পোঙ্গল হল, নতুন চাল, ভাজা মুগ, বাদামি আখের গুড়, ইক্ষু-শক্কর, দুধ ও নারকেল দুধের সঙ্গে কিশমিশ, কাজু, এলাচে প্রস্তুত এক সুস্বাদু মিষ্টান্ন।
এই সময় পাঞ্জাব থেকে তামিলনাড়ু পর্যন্ত সব জায়গায় গুড় এবং তিলের মিষ্টি তিল-গুড় বা তিল-লাড্ডু থাকে। কারণ আখ এবং তিলের ফসল এই সময় উৎপন্ন হয়। কিন্তু কেরল বাংলায় এই দুই ফসলের কোনওটিই তেমন হয় না, নারকেলের মিষ্টির রমরমা চলে।
আরও পড়ুন-লড়েও দু’গোলে হার সুনীলদের, অস্ট্রেলীয়দের মুখে প্রশংসা ভারতের খেলার
অসমেও এই সময় নতুন ধান ওঠে, তাই উপবাস, ভোজের মধ্যে দিয়ে জমে ওঠে ভোগালি বিহু। পঞ্জাব থেকে বিহার পর্যন্ত গোটা উত্তর ভারতে তিল, গুড় এবং দুধের মিষ্টান্নের পাশাপাশি অত্যন্ত জনপ্রিয় হল চাল, ডাল এবং মরশুমি সবজি দিয়ে তৈরি খিচুড়ি। আবার পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে আছে সুজির হালুয়া, আর তামিলনাড়ুর মতো কিছু রাজ্যে দুধ আর চালের পায়েস এবং মিষ্টি।
বাংলায় পৌষ সংক্রান্তির একটি উল্লেখ যোগ্য ঘটনা গঙ্গাসাগর মেলা। কুম্ভ মেলার পর লোকসমাগমে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সাগর মেলা। লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী গঙ্গাসাগরের মেলায় পুণ্যস্নান করতে সাগরদ্বীপে যান। কত প্রাচীনকাল থেকে চলছে এই প্রথা। কথিত আছে, সগর রাজার ছেলেদের উদ্ধার করতেই সগরের নাতি ভগীরথ কপিল মুনির নির্দেশমতো স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে আসেন। গঙ্গা শিবের জটা থেকে বেরিয়ে পৃথিবীতে প্রবাহিত হয়ে কপিল মুনির আশ্রমে পৌঁছয় এবং সাগরে গিয়ে মেলে। সেই দিনটি ছিল মকর সংক্রান্তি। তাই মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগর স্নানের বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। আজও মানুষের মনে বিশ্বাস, এই পুণ্য দিনে গঙ্গা এবং সাগরের সঙ্গমে স্নান করলেই নাকি সমস্ত খারাপ থেকে মুক্তি মেলে। যেখানে সাগর বা গঙ্গা নেই সেখানে মানুষ অন্য নদীতেও গঙ্গা জ্ঞানে মকরস্নান সারেন।
আরও পড়ুন-বাজেট অধিবেশন ৫ ফেব্রুয়ারি
পৌষ বছরের সব কালিমা দূর করে মাঘে আনবে নতুন সূর্য। তাই ব্যর্থ প্রাণের সব আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলতে আগুন জ্বালা হবে। পৌষের কোনও কালি থাকবে না উত্তরায়ণ পর্বে। ময়লা কাপড়, পোড়া বাসন, ঘরের ঝুল পরিষ্কার হবে। একর্ষি তার বার্ষিক সাতরঙা ঘোড়ায় চড়ে আবার দৃষ্টি রাখছেন উত্তর প্রান্তে। উত্তরায়ণ কালে মৃতে মোক্ষ জ্ঞানে ভীষ্মদেব অপেক্ষা করেছিলেন শরশয্যায়।
মকর সংক্রান্তি আসলে নতুন আলোর দিন। সূর্যের দক্ষিণায়নের শীতল দিন,দীর্ঘ রাতের অবসান। আলোর পথ বেয়ে মুক্তির বার্তা নিয়ে মাতা মেরির কোল আলো করে আলোর দুতেরা আসে এসময়। উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার আর সৌর ক্যালেন্ডারে কিছু দিনের তফাত হয়েছে ঠিকই কিন্তু মকর সংক্রান্তি যে অন্ধকারের পর আলোর বার্তা বহন করে আনে সব দেশে সেকথা সবাই জানে। তাই তো সংক্রান্তির পর আসে উত্তরায়ণ— আলোর বার্তা।