মরিয়ম হাঁটু গেড়ে বসে আছেন। তাঁর নিদারুণ কষ্ট প্রকাশের ভাষা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর ছেলের শেষ আর্তনাদ এখনও তাঁর কানে ভাসছে, দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করার পর তাঁর ছেলে এইমাত্র মারা গিয়েছে। দুপুরবেলাতেও চারিদিক অন্ধকার। আর এখন যেন হঠাৎ করে মাটি কাঁপতে শুরু করেছে। (মথি, ২৭:৪৫, ৫১) মরিয়মের হয়তো মনে হয়েছে যে, যিহোবা সমস্ত পৃথিবীকে জানাতে চাইছেন, অন্য যে কোনও ব্যক্তির চেয়ে তিনি নিজে যিশুখ্রিস্টের মৃত্যুতে কতটা কষ্ট পেয়েছেন।
আরও পড়ুন-মা সারদা আসলে কে ছিলেন?
অন্ধকার কাটিয়ে, গলগথা বা মাথার খুলি নামক স্থানে মধ্যাহ্নের আলো যখন আবার উঁকি দিচ্ছিল, তখন মরিয়ম তাঁর ছেলের জন্য কাঁদছিলেন। (যোহন, ১৯ :১৭, ২৫)
রাশি রাশি স্মৃতি তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। প্রায় ৩৩ বছর ধরে জমে থাকা অজস্র স্মৃতি। এক এক করে সব মনে পড়ছে তাঁর। তিনি এবং তাঁর স্বামী যোশেফ যখন তাঁদের প্রিয় সন্তানকে জেরুজালেমের উপাসনালয়ে নিয়ে আসেন, তখন শিমিয়োন নামের একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেন। ‘যিশু অনেক মহৎ কাজ করবেন’, বলার পর তিনি বলেন যে, ‘একদিন মরিয়ম অনুভব করবেন যেন তিনি খড়্গের দ্বারা বিদ্ধ হয়েছেন’। (লুক, ২ : ২৫-৩৫) এখন এই চরম শোকের সময় সেই কথাগুলোর অর্থ বেশ ভাল করে উপলব্ধি করছেন মরিয়ম।
আরও পড়ুন-বড়দিনের বাঙালি গিন্নিরা
এমনকী যিশু যদি তাঁর পরের ভাই যাকোবকে পারিবারিক ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়েও থাকেন, তবুও বড় ছেলের এভাবে সংসার ছেড়ে চলে যাওয়াটা তাঁর পরিবারের পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। মরিয়ম দায়িত্ব পালনের গুরুভার নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, কিন্তু ভীত হয়ে পড়েছিলেন কি? মনে হয় না। তাঁর একক সংগ্রাম অবিস্মরণীয়। নাসরতীয় যিশু বলে পরিচিত তাঁর ছেলে যখন দীর্ঘ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মশীহ হবেন, যখন তিনি যিশুখ্রিস্ট হবেন, তখন তিনি এই ব্যাপারটা কীভাবে দেখবেন? এ-বিষয়ে বাইবেল-এ বর্ণিত একটি বিবরণ পাঠ করা যেতে পারে।
যিশু যোহনের কাছে ব্যাপ্তিস্মা নিয়ে ঈশ্বরের অভিষিক্ত ব্যক্তি, প্রতিনিধি বা মশীহ হন। তারপর তিনি শিষ্যদের মনোনীত করতে শুরু করেন।
আরও পড়ুন-নামী আইটি সংস্থায় ৮ তলা থেকে ছিড়ে পড়ল লিফট, আহত ৯
গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতেন, তাঁদের সময় ও সঙ্গ দিতেন। নাসরত থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে এক বিয়েবাড়িতে সপরিবারে গিয়েছিলেন মরিয়ম, যিশুও সঙ্গে ছিলেন। সেই বিয়েবাড়িতে দ্রাক্ষারস ফুরিয়ে গিয়েছিল। তখনকার সময়ে বিয়েবাড়িতে দ্রাক্ষারসের অভাব খুব লজ্জাজনক ব্যাপার হিসেবে গণ্য হত। সেই বাড়িকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে মরিয়ম যিশুকে অনুরোধ করেন কিছু একটা ব্যবস্থা করতে। এতে যিশু প্রথমে বলেন, এটা তাঁর কাজ নয়। এ-ও বলেন যে, মরিয়মের এই চেষ্টা থেকে বিরত থাকা উচিত। মরিয়ম বোঝেন যে যিশু এখন আর তাঁর পুত্র নন। তা হলে যিশু এখন তাঁর কে? এরই মধ্যে যিশু একটি অলৌকিক কাণ্ড ঘটান। তিনি জলকে দ্রাক্ষারসে পরিণত করেন এবং সবাই অবাক হয়ে যান। মরিয়ম এর পর থেকে যিশুকে শুধু তাঁর সন্তান হিসেবে নয়, বরং প্রভু ও ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখতে শুরু করেন।
আরও পড়ুন-সম্প্রীতি-জননী
শোক, দুঃখ ও যন্ত্রণা নানা কারণে ভোগ করতে হয় মানুষকে। কিন্তু সন্তান হারানোর শোকের চেয়ে বড় শোক আর হয় না। মৃত্যু হল এক ভয়ানক শত্রু, আর কোনও না কোনওভাবে আমরা সবাই মৃত্যু-আঘাত পাই। (রোমীয়, ৫ : ১২; ১)
(করিন্থীয় ১৫ : ২৬)
এই ধরনের আঘাতের যন্ত্রণা নিয়ে কি বেঁচে থাকা সম্ভব?
যিশুর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এবং তার পরের ঘটনাগুলোর সঙ্গে মরিয়ম যেভাবে জড়িত, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার মাধ্যমে জানা যেতে পারে কীভাবে নিজের প্রিয় পুত্রের ভয়াবহ যন্ত্রণাময় মৃত্যুর অভিঘাত সহ্য করেছিলেন মা মেরি। মরিয়ম যিশুর গৃহত্যাগের অনুমান করেছিলেন অনেক আগেই। এও ভাবতে শুরু করেছিলেন যে, যিশু যদি ঘর ছেড়ে চলে যান তাহলে তিনি ও বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের ওপর কতটা চাপ আসতে পারে এবং আরও কী কী সমস্যা আসতে পারে। মনে হয়, এর মধ্যেই তিনি তাঁর স্বামী যোশেফকে হারিয়েছেন। তাহলে বড় ছেলে গৃহত্যাগী হওয়ার পর যিশুর চেয়ে ছোট ছয় জন ভাইবোনের ভরণপোষণের গুরুদায়িত্ব সামলাতে যথেষ্ট লড়াই করতে হয়েছে মরিয়মকে।
আরও পড়ুন-প্রজাতন্ত্র দিবসে কন্যাশ্রীর ট্যাবলো, এবারের অতিথি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট
(মথি ১৩ : ৫৫, ৫৬; মার্ক ৬ : ৩)
সুসমাচারের পুস্তকগুলিতে যিশুর সাড়ে তিন বছরের পরিচর্যার যে বিবরণ রয়েছে, তাতে মরিয়মের বিষয়ে খুব বেশি উল্লেখ নেই। মনে রাখতে হবে যে, তিনি ছিলেন সম্ভবত একজন বিধবা অর্থাৎ একজন একক মা, যাঁর ঘরে অল্পবয়সি সন্তানেরা ছিল। তাই যিশু যখন তাঁর নিজের এলাকায় প্রচারে যেতেন, তখন মরিয়ম কেন তাঁর সঙ্গে প্রচারে যেতে পারতেন না, এই বিষয়টি বোঝা কঠিন নয়।
তা সত্ত্বেও তিনি মশীহ সম্বন্ধে যে আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো জেনেছিলেন, তা নিয়ে ক্রমাগত চিন্তা করতেন এবং তাঁদের পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী নিয়মিত স্থানীয় সমাজগৃহের সভাগুলোতে যেতেন। নাসরতের লোকেরা অনেকেই যিশুকে মশীহ হিসেবে মেনে নিতে পারেনি, এমনকী যিশুর ভাইয়েরা পর্যন্ত যিশুকে বিশ্বাস করতেন না। এতে যারপরনাই ব্যথিত হতেন মরিয়ম, ভীষণ কষ্ট পেতেন, কারণ তিনি যিশুর মহত্ত্বে পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছিলেন। যিশুকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল, এতে সবসময় উৎকণ্ঠা ছিল মরিয়মের, তার ওপর নিজের বাড়িতেও যিশুর হয়ে নিরন্তর লড়াই করতে হয়েছে মরিয়মকে। তাঁদের আত্মীয়স্বজনেরা ‘পাগল’ বলতেন যিশুকে। ভাইয়েরাও এই বিদ্রুপে যোগ দিতেন, কিন্তু মরিয়ম আমৃত্যু অনড় ছিলেন নিজের প্রত্যয়ে। যিশুখ্রিস্ট ‘ঈশ্বরের সন্তান’ তথা ‘মানবপুত্র’ হয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পরে। তেমনি মা মেরি ‘ঈশ্বরের মাতা’ হয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে। যিশুর জীবদ্দশায় তিনি জানতেন, এমন মহৎপ্রাণ সন্তানের মা হওয়ার সুযোগ সকলের হয় না।
আরও পড়ুন-নতুন করে এবার মধ্য গাজা দখলে ছক ইজরায়েলের
রাজার চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠা যিশুকে রাজদ্রোহে অভিযুক্ত করে রাজার দোহাই দিয়ে যখন খুন করা হয়েছিল, তখন যন্ত্রণায় শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন মা মেরি, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও প্রিয় সন্তানের প্রতি বিশ্বাস হারাননি। নিজের অন্তর্ভেদী হাহাকারকে শান্ত করেছিলেন নারীর সর্বংসহা মানবিক সত্তা দিয়ে। সন্তানহারা জননী প্রিয় সন্তানের মৃত্যুর মধ্যেই খুঁজে নিয়েছিলেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে এবং নিজেকে বেঁধে ফেলেছিলেন কঠোর সংযমে।
ইতিহাসের উল্লেখ অনুযায়ী বিশ্ব থেকে হিংসা ও ভেদাভেদ মুছে ফেলতে ২৪ ডিসেম্বর রাতে বেথেলহেমের এক গোশালায় কুমারী মা মেরির কোলে জন্ম হয় যিশুর। বহু বছর আগে নাজারেথবাসী মরিয়ম যোশেফ নামে এক ব্যক্তির বাগদত্তা ছিলেন। একদিন ঈশ্বরের দূত জিব্রাইল আসেন মরিয়মের কাছে, এসে তাঁকে বলেন, ঈশ্বর মানুষের মুক্তির জন্য পৃথিবীতে একটি পবিত্র আত্মা পাঠাচ্ছেন। সেই আত্মা মরিয়মের পুত্র হিসেবে জন্মগ্রহণ করবে। তাঁর নাম হবে যিশু। অবিবাহিত মেরি প্রথমে চিন্তিত হলেও পরে ঈশ্বরের অপার কৃপার কথা ভেবে রাজি হন। যোশেফ তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা মরিয়মকে বিয়ে করতেন না। কিন্তু একদিন রাতে এক দৈব স্বপ্ন দেখে মেরিকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর বেথেলহেমে পশুর শস্যাগারে মরিয়ম জন্ম দেন যিশুর। মহামহিম ঈশ্বর আকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মাধ্যমে যিশুর জন্ম নির্দেশ করেছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের জ্ঞানীগুণীরা সেই নক্ষত্রের পথ অনুসরণ করে যিশুর জন্মস্থানে পৌঁছন। তাঁরা শিশু যিশুর জন্য প্রচুর উপহার নিয়ে আসেন।
আরও পড়ুন-৭০ কোটি টাকার ব্যবসা, নতুন নজির ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের
ঈশ্বরের দূতেরা বেথেলহেমে যিশুর জন্মের সুসংবাদ দেন এবং উপহার বিলি করেন। খুশি হয়ে রাখালেরা গান গাইতে থাকেন এবং উৎসবে মেতে ওঠে। কালক্রমে সেই আনন্দ উৎসব পরিণত হয় বড়দিনের উৎসবে। মা মেরির মাধ্যমে এই জ্যোতির্ময় আলো তথা পবিত্র আত্মা এসে পৃথিবীতে শান্তি ও ভালবাসার বাণী শুনিয়েছিল, তাই মা মেরিকে ‘ঈশ্বরের মা’ বলা হয়ে থাকে।
নিউ টেস্টামেন্ট-এ মেরির জন্ম, মৃত্যু, চেহারা বা বয়স সম্পর্কে কিছুই নেই। যিশুর জন্মের বিবরণের বাইরে যা শুধুমাত্র ম্যাথিউ এবং লুকের গসপেলগুলিতে পাওয়া যায়। খ্রিস্টধর্মে মা মেরির ঐতিহাসিক ভূমিকাকে কখনও অস্বীকার করা হয়নি। ম্যাথিউয়ের সুসমাচার থেকে জানা যায় যে, মেরি ও যোশেফ সহবাস করার আগেই মেরি গর্ভবতী ছিলেন। তাই তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘উইথ চাইল্ড ফ্রম দ্য হোলি স্পিরিট’ (with child from the holy spirit)। ম্যাথিউ ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি ভবিষ্যদ্বাণী উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘একজন কুমারী গর্ভধারণ করবে এবং একটি পুত্রের জন্ম দেবে এবং তাকে ইমানুয়েল বলা হবে’। খ্রিস্ট মতে, মেরি যিশুর জন্মের সময় এবং পরেও কুমারী ছিলেন। তাই ঈশ্বরের ধারক বা ঈশ্বরের মা হিসেবে তাঁকে আখ্যায়িত করা হয়। খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যের প্রথম শতাব্দী মেরির মৃত্যুতে নীরব ছিল। কিন্তু সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে মেরি স্বর্গারোহণ করেন। মরিয়ম, মারিয়া বা মা মেরির জন্মতারিখ অজানা। ঐতিহ্যগতভাবে ৮ সেপ্টেম্বর, ১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ধরা হয়। স্থান নাজরত, গালিল, রোমীয় যিহুদিয়া প্রদেশ (রোমান সাম্রাজ্য)। তাঁর মৃত্যুর তারিখও অজানা, আনুমানিক ৩০ বা ৩৩ খ্রিস্টাব্দের পর। বলা হয়ে থাকে মেরি ছিলেন নাজারেথের প্রথম শতাব্দীর একজন জুডিয়ান মহিলা। কিছু অপ্রাসঙ্গিক লেখা অনুসারে বলা হয় তাঁর পিতার নাম জোয়াকিম এবং মাতার নাম অ্যান।
আরও পড়ুন-শিলিগুড়িতে ভেঙে দেওয়া হল ২২ অবৈধ নির্মাণ
রবীন্দ্রনাথ জার্মানিতে গিয়ে ‘প্যাশান প্লে’ দেখে লিখেছিলেন, ‘মা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তাঁর শিশু, ঊষার কোলে যেন শুকতারা।’ কবি নজরুলের ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় ‘মা অহল্যা’ ও ‘মা মেরি’— দুই মা যেন মাতৃত্বের মহিমায় সমান ও সমান্তরাল।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ ব্যাকুল হয়ে মা-কে বলেছিলেন, ‘মা, তোর খ্রিস্টান ভক্তেরা তোকে কী রূপে ডাকে দেখব, আমাকে নিয়ে চ’। আর তাঁর শিষ্য বিবেকানন্দ ২৪ ডিসেম্বর দীক্ষা নেওয়ার কালে যিশুর আত্মত্যাগের বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, প্রণত হয়েছিলেন মহীয়সী মাতা মেরির রাতুল চরণে। বাঙালির রসচেতনায় মা দুর্গার পরিবারের সঙ্গে মা মেরির কোলে শিশু যিশু যেন একাকার হয়ে গিয়েছে। মানবমুক্তির বৃহত্তর স্বার্থে মানবপুত্র যিশুর আত্মবলিদানের কথা উঠলেই ভেসে ওঠে সেই মমতাময়ী জননীর মুখ, যাঁর সারাজীবনব্যাপী আত্মত্যাগের ফলেই এই পৃথিবী পেয়েছে অমৃতের সন্তান। তাই মা মেরি শুধুমাত্র ঈশ্বরের মা নন, তিনি সারা বিশ্বের দুঃখী ও আর্ত জনগণের মা।