একটা কণ্ঠস্বরে কী অপার শান্তি নিহিত থাকতে পারে তার সন্ধান পেতে হলে পান্নালাল ভট্টাচার্যের শরণাপন্ন হতে হয়। শুধু কি শান্তি? একটা কণ্ঠেই কীভাবে একাকার হয়ে থাকতে পারে সংকট ও সংকটমোচনের আলো-আঁধার, বিপুল বিপন্নতার আকুল আর্তি ও অন্তর্দাহের অপরূপ অভিব্যক্তি, সেই খোঁজ পেতে গেলেও পান্নালাল ছাড়া বাঙালির গতি নেই।
বাংলা ভক্তিগীতির জগতে, বিশেষ করে শ্যামাসংগীতের এক প্রবাদপ্রতিম কণ্ঠশিল্পী ছিলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। তাঁর গাওয়া বেশিরভাগ শ্যামাসংগীতের গীতিকার হলেন বাংলার শাক্তকবি রামপ্রসাদ সেন এবং কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। বাংলা গানের স্বর্ণযুগের আরেক স্বনামধন্য শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের অনুজ ছিলেন শিল্পী পান্নালাল।
আরও পড়ুন-বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় কোচবিহারে সূচনা রাস্তাশ্রী প্রকল্পের, জেলার উন্নয়নে জুড়বে ৩৭০ রাস্তা
ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের হাওড়া জেলার অন্তর্গত বালি-তে ১৯৩০ সালের ৫ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন পান্নালাল। অন্য ধারার বাংলা গান কয়েকটি গাইলেও মূলত শ্যামাসংগীতের সঙ্গেই তাঁর নাম প্রায় সমার্থক হয়ে আছে। তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র বছর ছত্রিশ। এই সামান্য আয়ুষ্কালে গাওয়া তাঁর অসামান্য শ্যামাসংগীতগুলি বাংলা গানের ইতিহাসে তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। এক শাক্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পান্নালাল। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য পান্নালালের জন্মের আগেই মারা যান। মা অন্নপূর্ণাদেবী খুব ভাল গান গাইতেন। এগারো জন ভাইবোনের মধ্যে পান্নালাল ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
পান্নালালের ইচ্ছে ছিল চলচ্চিত্রের নেপথ্য গায়ক হয়ে আধুনিক গান গাইবেন। কিন্তু সে-সময় বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগের খ্যাতিমান শিল্পীরা সকলেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তাই তাঁর বড় দাদা প্রফুল্ল ভট্টাচার্যের উদ্যোগে এইচএমভি থেকে পান্নালালের প্রথম যে গানটি প্রকাশিত হয় সেটি হল, ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলই ফুরায়ে যায় মা’।
আরও পড়ুন-ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডে ঋণ দিতে রাজি একাধিক ব্যাঙ্ক
এই গানটিই কালক্রমে মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে এবং জনপ্রিয়তার শিখর ছোঁয়। এরপর পান্নালাল তাঁর আরেক দাদা শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের পরামর্শ মেনে ভক্তিরসের গানে, বিশেষ করে শ্যামাসংগীতে মনোনিবেশ করেন এবং দিনে দিনে সাধক-গায়ক হয়ে ওঠেন।
তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ৩৬টি আধুনিক গান সমেত ১৮টি রেকর্ড, তিনটি বাংলা ছায়াছবির গান এবং ৪০টি শ্যামাসংগীতের রেকর্ড করেছেন। এ-ছাড়া ‘শ্রীঅভয়’ নাম দিয়ে তাঁর লেখা ও সুরে বেশ কিছু শ্যামাসংগীত আছে। ‘সাধক রামপ্রসাদ’ চলচ্চিত্রেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। তাঁর জনপ্রিয় শ্যামাসংগীতগুলি হল : ‘আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা’, ‘আমি মন্ত্র তন্ত্র কিছুই জানি নে মা’, ‘আমি সকল কাজের পাই হে সময়’, ‘অপার সংসার নাহি পারাবার’, ‘মাগো আনন্দময়ী’, ‘ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়’, ‘চাই না মাগো রাজা হতে’, ‘আমার কালো মায়ের পায়ের তলায়’, ‘আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন’, ‘তুই নাকি মা দয়াময়ী’, ‘আমায় দে মা পাগল করে’, ‘মনেরই বাসনা শ্যামা’, ‘সকলই তোমারই ইচ্ছা’, ‘বসন পরো মা’, ‘দোষ কারো নয় গো মা’, ‘জেনেছি জেনেছি তারা’ ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-স্বাস্থ্যে নতুন দিগন্ত রাজ্যে
বাঙালির কাছে কালীপুজো বা শ্যামাপুজোর মূল অর্ঘ্য যেন পান্নালালের গান। তাঁর গানের মধ্যে দিয়েই যেন নিবেদিত হয় হৃদয়ের সমস্ত আকুতি। তাই তাঁর গানের চাহিদা বরাবরই আকাশছোঁয়া।
পান্নালালের গান নিয়ে বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞদের বিশ্লেষণ থেকে তাঁর গানের স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট ধারাটি পরিস্ফুট হয়। কয়েকটি কালজয়ী মন্তব্য এইরকম—
‘আমরা গান শোনাই শ্রোতাদের। কিন্তু পান্নালাল গান শোনান স্বয়ং শ্যামা মা-কে।’
‘‘ওই আকুল করা ‘মা’ ডাক আর কারো কণ্ঠে আসা অসম্ভব।’’
আরও পড়ুন-
‘শুধুমাত্র কণ্ঠ, আবেগ, ভক্তি বা আধ্যাত্মিকতা নয়, সমগ্র অস্তিত্বের নিঃশর্ত সমর্পণ ছাড়া এমন গান গাওয়া সম্ভব নয়।’
‘ছিল পান্নালালের শান্ত মিঠে গলায় বুকে বাস্তুভিটে শান্তি পেত।’
এমন একজন বিরল কণ্ঠ মহাপ্রতিভার অকালপ্রয়াণ ঘটে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে।
এই মরমী শিল্পী বিবাহ করেছিলেন এবং স্ত্রী ও কন্যাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। প্রভাব প্রতিপত্তি অর্থ যশ ও খ্যাতি সবই পর্যাপ্ত ছিল তাঁর ভাণ্ডারে। তবু নিজের জীবদ্দশায় তিনি বারবার শ্মশানে যেতেন কিছু একটা খুঁজতে। একটা সময় পর্যন্ত ঘোরতর সংসারী পান্নালাল হঠাৎ করেই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন তা আজও এক রহস্য। কী খুঁজতে বারবার শ্মশানে যেতে হত তাঁকে?
আরও পড়ুন-ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডে ঋণ দিতে রাজি একাধিক ব্যাঙ্ক
অমৃতকণ্ঠী এই শিল্পী স্বেচ্ছায় পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ১৯৬৬ সালের ২৭ মার্চ। কথিত আছে দুটি শ্যামাসংগীত রেকর্ড করার কথা ছিল পান্নালালের। একটি রামপ্রসাদ সেনের লেখা, ‘অপার সংসার নাহি পারাপার’ এবং অন্যটি অসিতকুমার বসুর লেখা ‘ওদের মতো বলবো না মা আমায় তুমি করো পার’। তখন পান্নালাল খুব ‘মা মা’ করতেন। ঘনঘন শ্মশানে যান। তাঁর জীবনে তখন ঘটে চলেছে অলৌকিক সব ঘটনা। ঘরে বসে গান দুটি তোলাচ্ছেন দাদা ধনঞ্জয়। গানের একটা ছোট্ট জায়গা বারবার ভুল করছিলেন পান্নালাল। ব্যাস, এতেই চটে গিয়ে সাংঘাতিক বকাবকি শুরু করেন দাদা ধনঞ্জয়। চেঁচামেচি শুনে বাড়ির সকলে ছুটে এলেও কোনও লাভ হল না। পান্নালালের কাছে দাদা ধনঞ্জয় ছিলেন বাবার মতোই। তিনি অগ্রজের তিরস্কার মাথা পেতে নীরবে সহ্য করতেন। দাদাও তাঁকে ভীষণ ভালবাসতেন যে!
আরও পড়ুন-ইসির হ্যাটট্রিক, ফাইনালে মুম্বই
এর মাত্র কয়েকদিন পরের ঘটনা। ২৭ মার্চ, ১৯৬৬ সালের এক রবিবার। কাঁকুলিয়া রোডের বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিলেন পান্নালাল। মৃত্যুর কারণ জানা যায় না স্পষ্ট। এই ঘটনায় বাড়ির সকলেই ভেঙে পড়েন। শোকে পাথর হয়ে যান সবাই। গোটা বাংলা শোকস্তব্ধ হয়ে যায় মর্মান্তিক এই খবরে।
পান্নালাল কোনওদিন নিজের গান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে মা ভবতারিণী তাঁর দাদা ধনঞ্জয়কে দর্শন দেন অথচ তাঁকে দেখা দেন না। দেবীদর্শন করতে না পারার অবসাদেই হয়তো তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে তিনি কাটাতেন তাঁর শেষ দিনগুলি। মা তাঁর কাছে না এলে তিনি নিজেই মায়ের কাছে পৌঁছে যাবেন বলে মনে মনে হয়তো তেমন প্রস্তুতি নিতেই শুরু করেছিলেন।
আরও পড়ুন-নেত্রীর নেতৃত্বে জোট বাঁধছে বিরোধীশক্তি
মহিষাসুরমর্দিনী যেমন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে অমর করে রেখেছে, ঠিক তেমনই বাঙালির কালীপুজো বা শ্যামাপুজোর দিনে সাধক-গায়ক পান্নালাল ভট্টাচার্যের অবিস্মরণীয় গানগুলি ছাড়া মায়ের পুজো যেন সম্পূর্ণ হয় না।
পান্নালালের গাওয়া প্রায় সব ক’টি গানই দারুণ জনপ্রিয়। কিন্তু মাইলফলক ‘আমার সাধ না মিটিল’। যে গান প্রসঙ্গে সংগীতবেত্তা সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘গড় বাঙালির সবচেয়ে আন্তরিক মর্মগাথা’।