স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারত কোন পথে চলবে, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কম হয়নি। অবশেষে আধুনিক ভারত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই গ্রহণ করে। এতে ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকেও গুরুত্ব দেওয়া হল বেশ খানিকটা।
আরও পড়ুন-‘মীযান’ পত্রিকার ৫০ বছর
সেই সময় চার্চিল যা বলেছিলেন তার অর্থ ছিল, জাত-পাত, ধর্ম ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত এবং লেখাপড়া জানা মানুষের সংখ্যা এত কম, সেই আদিম মানুষের দেশে গণতন্ত্রের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। ভারতীয় গণতন্ত্রপন্থীরা চার্চিলের এই ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করে গণতান্ত্রিক ভারতের প্রতিষ্ঠা করেন। আগে গণতন্ত্রের জন্য বাস্তবে যোগ্য হতে হবে তারপর গণতন্ত্র আসবে— কিন্তু ভারতের বিপুল দারিদ্র্য এবং অশিক্ষিত জনগণ— ঠিক করেছিলেন তাঁরা গণতন্ত্রের মধ্যদিয়েই বস্তুগত যোগ্যতা অর্জন করবেন।
আরও পড়ুন-দুটি অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ভারতের নয়া প্রজাতন্ত্র তার সীমান্ত সমস্যার সমাধান করে সাফল্যের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে ভারত বলে চিহ্নিত করে। এরই সঙ্গে প্রস্তুত করে উল্লেখযোগ্য এক লিখিত সংবিধান। ভারতীয় প্রজাতন্ত্র দেশভাগের ঝড় ও তার নরকযন্ত্রণা সহ্য করেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। নতুন লিখিত সংবিধান গ্রহণ করা হয় ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর। সংবিধান তৈরির ক্ষেত্রে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল দলিত সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতা বাবাসাহেব আম্বেদকরের। এই আম্বেদকরের ‘উই দ্য পিপল অব ইন্ডিয়া’ দিয়ে এই সংবিধানের শুরু।
আরও পড়ুন-ফের বিজেপির নোংরা চক্রান্ত, তোপ মহুয়ার
সংবিধানের জন্যই, সংবিধানের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ভারতীয় গণতন্ত্র ৭৩ বছর ধরে কাজ করছে। সংসদ যখন এর ত্রুটি খুঁজে পায়, তখন সংবিধান সংশোধন করে সংসদ। এখনও পর্যন্ত ১০৬টি সংবিধান সংশোধনী আইন তৈরি হয়েছে। জরুরি অবস্থা কার্যকর হওয়ার সময় সংবিধান একটি সরাসরি এবং গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। সংবিধান পরোক্ষে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার দৃষ্টান্তও অনেক রয়েছে : আহত হয়েও টিকে গিয়েছে সংবিধান। যখন এই ধরনের ঘটনাগুলিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে জড়ানো হয়েছে, আদালত হয়তো হোঁচট খেয়েছে, কিন্তু নিজেকে পুনরুদ্ধার করেছে যথাসময়ে।
আরও পড়ুন-ব্যর্থ কেন্দ্র উদ্ধার বিশ বাঁও জলে
আদালত প্রমাণ করেছে যে ভুল স্বীকার করার ক্ষমতা আছে তাদের। আদালতের হোঁচট খেয়েছে— এ কে গোপালন, আই সি গোলোক নাথ এবং এডিএম জবলপুর মামলায়। নিজেকে সংশোধনের মাধ্যমে, আদালতের তরফে একটি উদার গণতান্ত্রিক সংবিধানের মৌলিক নীতির উপর গুরুত্ব আরোপের ঘটনা ঘটেছে মানেকা গান্ধী, এসআর বোম্মাই, কেশবানন্দ ভারতী এবং কেএস পুত্তাস্বামী মামলায়।
কিন্তু সম্প্রতি সংবিধানের ওপর একের পর এক পরোক্ষ আক্রমণ নেমে এসেছে।
আরও পড়ুন-ভোট মিটল মরুরাজ্যে
প্রস্তাবনা হল সংবিধান প্রণেতাদের মনোরাজ্যের চাবিকাঠি। সংবিধানের কোনও বিশেষ অংশ অস্পষ্টতার কারণে বোধগম্য না হলে সেটিকে প্রস্তাবনার আলোয় ব্যাখ্যা করা হয়। এখানেই প্রস্তাবনার গুরুত্ব। সেই প্রস্তাবনার একটি শব্দকে সবসময় চাঁদমারি করেছেন সংবিধানের ধ্বংস চাওয়া শক্তি। এই শব্দটি হল, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। সংবিধানের প্রস্তাবনায়, একেবারে ‘সার্বভৌম’র সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেষি করে শব্দটি দাঁড়িয়ে, ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর সৌজন্যে। কয়েক বছর আগেকার কথা। সন ২০১৫। তদানীন্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ দেশব্যাপী বিতর্কের ডাক দেন। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ওই শব্দটি থাকার আদৌ কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা, সেটা ঠিক করার জন্য। ২০২০-তে বিজেপি সাংসদ রাকেশ সিংহ রাজ্যসভায় শব্দটিকে প্রস্তাবনা অংশ থেকে ছেঁটে ফেলার প্রস্তাব আনেন।
আরও পড়ুন-কাশ্মীরে ধৃত ২ জঙ্গিই মোদির দলের সদস্য!
ভারতীয় উপমহাদেশের আর কোনও দেশের সংবিধানে এই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ থাকার অঙ্গীকার নেই। পাকিস্তান, বাংলাদেশ। আফগানিস্তান, সর্বত্রই রাষ্ট্রের একটি বিশেষ ধর্মে নিষ্ঠার কথা সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। ওই দেশগুলিতে সংখ্যালঘুদের অবস্থা সবারই জানা। ভারতের সংখ্যালঘু এবং সত্যিকার প্রগতিশীল কোনও নাগরিকই নিশ্চয় চাইবেন না এরকম অবস্থা এদেশেও দেখা দিক। এমনিতেই বিলকিস বানোর ধর্ষকদের সংবর্ধনা, বুলডোজারের দৌরাত্ম্য, গোরক্ষক বাহিনীর তাণ্ডব, নূহর দাঙ্গা, দাঙ্গা নিয়ে অভিযোগকারীর পুলিশি হেনস্থা ইত্যাদি প্রতিদিন ঘটে চলা বহুবিধ কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার ওপর সরাসরি ওই শব্দের অবলুপ্তি ভয়ঙ্করতম অশনি সংকেত, অন্তত তাদের কাছে। আর এটাকেই রোজ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা চলছে এদেশে। অনভিপ্রেত প্রয়াস, কিন্তু অব্যাহত তৎপরতা।
আরও পড়ুন-কৌশাম্বীতে নাবালিকা ধর্ষিতাকে কুঠার দিয়ে খুন, পুলিশের গুলিতে আহত অভিযুক্ত
বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, অহিংসা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি শব্দগুলি শুনতে বেশ লাগে। আরও ভাল লাগে তা উচ্চারণ করতে। কারণ ‘ভারতীয় ঐতিহ্য’র সঙ্গে শব্দগুলি নাকি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু মোদি জমানায় সবসময় মনে হচ্ছে ওই ভাললাগা শব্দগুলির সঙ্গে একেবারে হাত ধরাধরি করেই চলেছে সহিংসতা, সাম্প্রদায়িকতা, অস্পৃশ্যতা, পরমত অসহিষ্ণুতা ইত্যাদির মতো মন্দ শব্দগুলিও। যাদের অস্বীকার করবার জো নেই। যাদের কোনও নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতায় এড়িয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। বিভিন্ন রাজ্যে জাতপাতের কুৎসিত সংঘাত, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও অস্পৃশ্যতার এমন সব মর্মান্তিক বহিঃপ্রকাশ ঘটছে যে, নিজেকে এই দেশের নাগরিক ভাবতেও লজ্জাবোধ হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের হিসেব বলছে, ‘অনার কিলিং’ সারা পৃথিবীতে যত হয়, তার প্রতি পাঁচটির একটিই নাকি ঘটে ভারতে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যানেও ভারতে ‘অনার কিলিং’ বেড়েছে ৭৯৬ শতাংশ। আর এই সম্মানরক্ষার্থে হত্যা ঘটেছে গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ— এই তিন ডবল ইঞ্জিন-শাসিত রাজ্যে সব থেকে বেশি। অর্থাৎ স্বীকার করে নিতেই হচ্ছে যে, এই ‘অনার কিলিং’ও দেশের এক সনাতনী পরম্পরা যা, ভারতীয় সমাজে লালিত হচ্ছে বহু যুগ ধরে। যা সময়ের কালস্রোতে এতটুকুও ফিকে হয় যায়নি।
আরও পড়ুন-মরুরাজ্যে চলছে ভোট
তাই আশঙ্কা, ভারতের বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতা, অহিংসা ইত্যাদি মান্য শব্দগুলিকে কেবলই যেন ব্যঙ্গ করে চলেছে দেশের ওই ঘটমান অস্পৃশ্যতা, সহিংসতা, সাম্প্রদায়িকতা, অসহিষ্ণুতা’রা।
ভারতে আজ ধীরে ধীরে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে মেরে ফেলা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক সমাজবোধ ধ্বংস করা হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে। এই দুঃস্থ অবস্থার মধ্যে পড়ে গোটা দেশ আজ গণতন্ত্রের পুনর্জীবনের পথ চেয়ে অপেক্ষমাণ। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সেই মাহেন্দ্রক্ষণে এসে পৌঁছেছি আমরা। আর বিলম্বে ধ্বংস হবে দেশ। এই বোধ ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র। জনগণমনে ঝড় উঠুক। বর্তমান জামানাকে পর্যুদস্ত করে এগিয়ে চলুক ভারতভূমি।