নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ তখন লখনউ থেকে বিতাড়িত। জাঁকিয়ে বসেছেন কলকাতার মেটিয়াবুরুজে। তিনি ছিলেন রসিক মানুষ। সমঝদার ছিলেন সংগীত ও নৃত্যকলার। নিয়মিত বসাতেন মেহফিল। আসতেন কলকাতার বাবুরা। আসর মাতিয়ে রাখতেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিল্পীরা।
এই শিল্পীদের দলেই ছিলেন মালকা জান। ধর্মান্তরিত মুসলমান। আগে ছিলেন খ্রিস্টান। নাম ছিল ভিক্টোরিয়া। বিবাহ হয় আমেরিকান ইহুদি উইলিয়াম ইওয়ার্ডের সঙ্গে। বেশিদিন টেকেনি সম্পর্ক। সংসার ছেড়েছুড়ে ভিক্টোরিয়া চলে আসেন বারাণসীতে। আশ্রয় নেন এক মুসলমান পরিবারে। তখনই ধর্ম পরিবর্তন। নাম হয় মালকা জান। পেট চালানোর জন্য পেশা হয় সংগীত ও নৃত্য। বছর দুই বারাণসীতে থাকার পর চলে আসেন দেশের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায়। যোগ দেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের সভাশিল্পী হিসেবে। মালকা জানের ছিল এক কন্যা। আসল নাম অ্যাঞ্জেলিনা ইওয়ার্ড। পরবর্তী সময়ে সেই মেয়েটিই সারা দেশে পরিচিত হন গওহর জান নামে।
আরও পড়ুন-উনিশ শতকে সাহিত্যের অঙ্গনে মহিলারা
ছোটবেলা থেকেই গওহর ছিলেন মায়ের ছায়া। মায়ের কাছে শিখেছেন সংগীত ও নৃত্যকলার খুঁটিনাটি। মা যখন নবাবের মেহফিলে নাচ-গান করতেন, মাঝেমধ্যে সঙ্গত করতেন ছোট্ট গওহর। পরে গওহর শিক্ষা লাভ করেন বহু গুণী শিল্পীর কাছে। যেমন, পাতিয়ালা ঘরানার কালু খান, আলি বক্স জার্নেল, কত্থকশিল্পী বৃন্দদিন মহারাজ, ধ্রুপদ শ্রীজনবাই, বাংলা কীর্তন চরণ দাস। শেখেন লেখাপড়াও। ফুলের সুবাসের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গওহরের রূপ ও গুণের কথা। আমন্ত্রণ আসতে থাকে বহু বিখ্যাত মহারাজ ও নবাবের দরবার থেকে।
১৮৮৭। গওহর তখন সদ্য কিশোরী। প্রথম অনুষ্ঠান করেন বিহারের দ্বারভাঙা মহারাজের আসরে। তাঁর পরিবেশনায় মুগ্ধ হন সবাই। যেমন গানের গলা, তেমন নাচ। মহারাজ তাঁকে সভাশিল্পীর সম্মান দেন। তবে খুব বেশিদিন সেখানে থাকলেন না গওহর। ফিরে এলেন প্রাণের শহর কলকাতায়। শুরু করলেন স্বাধীন অনুষ্ঠান। সেইসময় তাঁর পারিশ্রমিক ছিল প্রায় হাজার টাকা বা তারও বেশি। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের গজল, দাদরা ও ঠুমরি গোত্রের গানের এক বিরল শিল্পী। তাঁকে বলা হয় ভারতের প্রথম মহিলা সুপারস্টার।
আরও পড়ুন-শিশু পড়ুয়াদের বিকাশে সক্রিয় পুলিশ কর্মীর পাঠশালা
১৮৯৬ সালে কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে ফার্স্ট ড্যান্সিং গার্ল হিসাবে পরিচিতি পান। কেউ কেউ তাঁকে বলতেন বাইজি, মেহফিল জমানো তবায়েফ। তবে আর পাঁচজন সাধারণ তবায়েফের মতো ছিলেন না গওহর। তিনি ছিলেন জাত শিল্পী, দূর আকাশের তারা। সহজে তাঁর দর্শন পাওয়া যেত না। রক্ষা করতেন শুধুমাত্র বড় বড় মহারাজা, নবাবের নিমন্ত্রণ। মোটা নজরানার বিনিময়ে। ফিরিয়ে দিতেন ছোটখাটো রাজাদের।
একবার এক রাজার মেহফিলের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন গওহর। কিন্তু নাছোড়বান্দা মহারাজ। বাধ্য হয়ে গওহর আবদার করেন, যাব মেহফিলে। মোটা নজরানা দিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের নিয়ে যেতে হবে আস্ত একটা ট্রেন ভাড়া করে৷
এককথায় রাজি হয়েছিলেন মহারাজ। সেই ট্রেনে গওহরের সঙ্গে বাজনদাররা ছাড়াও গিয়েছিলেন নিজস্ব রাঁধুনি‚ রাঁধুনির সহকারী‚ হাকিম‚ ধোপা‚ নাপিত, চাকর-বাকর।
সেই সময় গ্রামাফোন কোম্পানি গওহরকে দিয়ে রেকর্ড করায় বেশকিছু গান। তিনিই প্রথম ভারতীয় শিল্পী, যাঁর গান রেকর্ড করেছিল গ্রামোফোন কোম্পানি৷ প্রত্যেকটি গানের জন্য তিনি নিতেন মোটা পারিশ্রমিক। জানা যায়, তখনকার দিনে প্রায় তিন হাজার টাকার মতো। তাঁর রেকর্ডের পরেই এই দেশে বিখ্যাত হয়ে ওঠে গ্রামোফোন কোম্পানি৷ ১৯০২ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত ১০টি ভাষায় গওহরের প্রায় ৬০০টি গান রেকর্ড হয়েছে৷ গেয়েছেন হিন্দি‚ বাংলা, গুজরাতি‚ তামিল‚ মারাঠি‚ আরবি‚ পার্সি, পাশতু‚ ফরাসি‚ ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায়। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর কলের গান। ছড়িয়ে পড়ে দেশের বাইরেও। রেকর্ডের শেষে তিনি বলতেন‚ ‘মাই নেম ইজ গওহর জান’৷
আরও পড়ুন-বাংলাদেশে বন্যায় মৃত্যু বেড়ে ৪২, ভিটেমাটি ছাড়া ৪৫ লক্ষ মানুষ
গওহর ছিলেন কবি। নিজে গান লিখতেন, সুর দিতেন। ‘রসকে ভরে তোরে নয়ন’ ঠুমরিটি তাঁরই লেখা। শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি বিভিন্ন আসরে গাইতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান।
দেশ জুড়ে তখন চলছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। মহাত্মা গান্ধী সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন দেশবাসীদের কাছে। সাড়া দিয়েছিলেন গওহর। মহাত্মা গান্ধীর প্রতিনিধির হাতে তুলে দিয়েছিলেন মোটা অঙ্কের টাকা।
১৯১১ সালে ব্রিটিশ রাজ পঞ্চম জর্জের সম্মানে দিল্লির দরবারে এলাহাবাদের জানকী বাইয়ের সঙ্গে গান গেয়েছিলেন গওহর। রাজা পঞ্চম জর্জ খুশি হয়ে দু’জনকেই এক হাজার গিনি উপহার দিয়েছিলেন।
উপার্জন যেমন করেছেন, তেমন দু’হাতে খরচ করেছেন গওহর। যাপন করতেন খামখেয়ালি জীবন। শোনা যায়‚ বিশ শতকের গোড়ায় পোষা বিড়ালের বিয়ের জন্য জলের মতো টাকা খরচ করেছিলেন। সেইসময় প্রায় বারোশো টাকা৷ বিড়ালটি যখন মা হয়, গওহর খরচ করেন দুই হাজার টাকা৷
আরও পড়ুন-সাংবিধানিক কাঠামো ও গণতন্ত্র রক্ষাই আমার অগ্রাধিকার: যশোবন্ত
মাঝেমধ্যেই গওহর চার ঘোড়ায় টানা বুগি গাড়িতে চড়ে হাওয়া খেতে যেতেন। একবার ভুল করে তাঁকে সেলাম ঠুকে দেন এক সাহেব। পরে বুঝতে পারেন এই মহিলা একজন গায়িকা। সেইসময় চার ঘোড়ায় টানা বুগি গাড়িতে চড়ার অধিকার ছিল একমাত্র ব্রিটিশ ও বাবুদের। গওহরকে অপরাধী চিহ্নিত করে ভাইসরয় জরিমানা করেন এক হাজার টাকা। পরের দিন আবার ঘটে একই ঘটনা। জানা যায়, এইভাবে টানা কুড়িদিন চার ঘোড়ায় টানা বুগি গাড়িতে চড়ে সরকার বাহাদুরকে জরিমানা দিয়েছিলেন গওহর। মেতে উঠেছিলেন নিয়ম ভাঙার খেলায়। নিয়মিত যেতেন রেসের মাঠে। রীতিমতো বাজি ধরতেন। মাঝেমধ্যে জিত, বেশিরভাগ সময় হার। এইভাবে খুইয়েছেন প্রচুর টাকা।
গওহর ছিলেন প্রচণ্ড অহংকারী, তখনকার দিনের কোটিপতি। তবে নিঃস্ব হতে সময় লাগেনি। সম্পর্কে জড়িয়েছেন, সম্পর্ক ভেঙেছেন। আলোর মধ্যেই ডুব দিয়েছেন অন্ধকারে। বুকের কষ্ট, চোখের জল লুকিয়ে রেখে মাতিয়েছেন মেহফিল।
আরও পড়ুন-ভূমিকম্পের পর প্রবল বন্যা শুরু, ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধারকাজ
জীবনে বহু পুরুষ এলেও, অমৃত কেশব নায়ক এবং সৈয়দ আব্বাস ছিলেন প্রাণের পুরুষ। অমৃত কেশব নায়কের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয়েছিল যথেষ্ট গভীর। ১৯০৭ সালে অমৃত পরলোক গমন করেন। টুকরো টুকরো হয়ে যান গওহর। বয়সে অনেক ছোট আব্বাস ছিলেন গওহরের তবলচি৷ বহু বছর পরে এই পুরুষকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন গওহর। কিন্তু দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। আব্বাস গোপনে আত্মসাৎ করে নেন গওহরের টাকা। বাধ্য হয়ে আদালতে যান গওহর। মামলায় জিতলেও উকিলদের টাকা মেটাতে গিয়ে ফতুর হয়ে যান। তখন তিনি মেহফিল থেকে বহুযোজন দূরে। চরম অর্থকষ্টে। ১৯২৮ সালের ১ অগাস্ট কলকাতা ছেড়ে চলে যান মহীশূর। সেখানেই তীব্র মনোকষ্টে ভুগে ১৯৩০-এর ১৭ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গওহর। তখন তাঁর বয়স ৫৭ বছর।
আরও পড়ুন-প্রকাশ্যে মন্ত্রীর নামে মিথ্যা অভিযোগ তোলার জবাবে বিজেপি সাংসদকে আইনি নোটিশ
কলকাতার চিৎপুরে থেকেছেন দীর্ঘদিন। বহু ইতিহাসের সাক্ষী তাঁর সেই বাড়িটি আজও বর্তমান।
১৮৭৩ সালের ২৬ জুন আজমগড়ে জন্মগ্রহণ করেন গওহর জান। আগামিকাল তাঁর জন্মদিন। সার্ধশতবর্ষের সূচনা। কিংবদন্তি শিল্পীকে স্মরণ করবেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য সংগীতপ্রেমী। যতদিন থাকবে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত, ততদিন থেকে যাবে তাঁর নাম।