শতবর্ষে নারায়ণ সান্যাল

একটা সময়ে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন। লিখেছেন বিভিন্ন বিষয়ে। বড়দের পাশাপাশি কলম ধরেছেন ছোটদের জন্যও। অনূদিত হয়েছে তাঁর বহু লেখা। সাহিত্যচর্চার জন্য পেয়েছেন বেশকিছু পুরস্কার। কর্মজীবনে ছিলেন সফল বাস্তুকার। ঘুরেছেন নানান জায়গায়। অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। লিখেছেন। তিনি সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল। ২৬ এপ্রিল নীরবে পেরিয়ে গেল তাঁর জন্মশতবর্ষ। স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

সাহিত্যিক হিসেবে ছিলেন বিচিত্রমুখী। সর্বত্রগামী। বহুপঠিত। তাঁর প্রায় প্রতিটি বই হাসি ফুটিয়েছে প্রকাশকদের মুখে। চেহারার মধ্যে ছিল আভিজাত্যের ছাপ। তাঁর নিন্দাবাদ হয়েছে বলে খুব একটা জানা যায় না। তবে এটা ঠিক, সাহিত্য-সমাবেশে তাঁর নাম তেমনভাবে উচ্চারিত হয় না। যদিও তাঁকে অস্বীকার করার উপায় নেই। লিখেছেন প্রচুর। প্রায় দেড়শো বই। কখনও নিজেকে রিপিট করেননি। বরাবরই পাঠকের দরবারে হাজির হয়েছেন নতুন নতুন বিষয় নিয়ে। তাঁর বেশ কিছু রচনা বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে। অসংখ্য মৌলিক সাহিত্যও পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। তিনি নারায়ণ সান্যাল। জন্মেছিলেন একশো বছর আগে। ১৯২৪ সালের ২৬ এপ্রিল। কলকাতায়। প্রকৃত নাম নারায়ণদাস সান্যাল। বেড়ে ওঠেন কৃষ্ণনগরে। সেই কারণে নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘কৃষ্ণকলি’ হিসেবে। পড়াশোনা কলকাতায়। ১৯৪৮ সালে হাওড়ার শিবপুর বিই কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। যোগ দেন সরকারি পিডব্লুডি বিভাগে। কর্মজীবনে ছিলেন এক সফল বাস্তুকার। পেয়েছেন ‘ফেলো অফ দি ইনস্টিটিউশান অফ ইঞ্জিনিয়ারস’ আর ‘ফেলো অফ দি অ্যাসোসিয়েশন অফ ইঞ্জিনিয়ার্স’-এর মতো সম্মান।

আরও পড়ুন-একমাত্র আমাদের মুখ্যমন্ত্রীই পারেন এনআরসি আটকাতে

কর্মসূত্রে ঘুরেছেন নানান জায়গায়। অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ছিন্নমূল শরণার্থীদের সমস্যা দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তাঁর সংবেদনশীল মন ব্যথিত হয়ে উঠেছে। ১৯৫৫ সালে লিখেছেন ‘বকুলতলা পিএল ক্যাম্প’। গল্পের নায়ক ঋতব্রত। তিনি বকুলতলা ক্যাম্পের দায়িত্ব পান। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সদ্য যোগ দেন চাকুরিতে। একদল উদ্ভ্রান্ত উদ্বাস্তু, যাঁরা নিজেদের জীবনের কাছে আর কোনও আশা করেন না। সেই উদ্বাস্তুপুনর্বাসনকে ঘিরে একদল মানুষ। দু-চারজন বাদে বাকিরা স্বার্থপর। একদল অসহায় মানুষকে পুঁজি করে নিজেদের আখের গোছাবার ধান্দায় থাকে সর্বক্ষণ। সেই চরিত্রে আছে ঠিকাদার রামশরণ, অসাধু ডাক্তার সাধুচরণ, কুচক্রী ভৈরবচন্দ্র। কিছু ভালমানুষও আছেন সেখানে। যেমন ঋতব্রত। মনে করা হয়, এই চরিত্রে লেগে রয়েছে লেখকের ছায়া। ‘দণ্ডকশর্বরী’ ও ‘নৈমিষারণ্যের রূপকথা’ উপন্যাসেও ফুটে উঠেছে উদ্বাস্তু সমস্যার কথা।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর জোড়া সভা হাবিবপুর ও সুজাপুরে

তিনি ক্রমাগত বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গেছেন। মুখ্যত অন্তরের তাগিদে। আর সেই তাগিদেই তিমি থেকে দেবদাসী, চিত্রকলা থেকে বিজ্ঞান, বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী পাঠককে নিজের পাঠক করে নিয়েছিলেন। বিজ্ঞান, শিল্প স্থাপত্য ভাস্কর্য, সামাজিক, ঐতিহাসিক উপন্যাস প্রচুর লিখেছেন। দান্তের দিভিনা কোম্মেদিয়া, লেওনার্দোর নোটবই, ডিজনিল্যান্ডের দরজা, চার্লস লিন্ডবার্গের অভিযান, রোঁদ্যার দ্য থিঙ্কার আর দ্য কিস-এর মতো ভাস্কর্য, ভ্যান গঘের চিত্রকলাকে নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে পাঠকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে লিখেছেন ‘আমি নেতাজীকে দেখেছি’, ‘আমি রাসবিহারীকে দেখেছি’, ‘নেতাজীর রহস্য সন্ধানে’-র মতো গবেষণামূলক বই। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি ছিল তাঁর গভীর সমর্থন। তাঁকে নিয়ে ১৯৯৮ সালে লিখেছেন ‘অগ্নিকন্যা মমতা’। ছোটদের জন্য তাঁর রচনার সংখ্যা কম নয়। লিখেছেন যুক্তাক্ষর বর্জিত ‘হাতি আর হাতি’। এছাড়াও লিখেছেন ‘কিশোর অমনিবাস’, ‘কিশোর সমগ্র’, ‘কিশোরী সমগ্র’, ‘কদু রায় ও খুকু মা’ প্রভৃতি। তাঁর কাঁটা সিরিজ পাঠকমহলে দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছিল। স্বল্প শিক্ষিতদের স্বাবলম্বি হওয়ার সুযোগ দিতে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শুরুতে তিনি লিখেছেন ‘গ্রাম্যবাস্তু’। পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়াসে লেখেন ‘পরিকল্পিত পরিবার’। সমাজ হিতার্থে লিখেছেন ‘দশে মিলি’। এই বইগুলো পরবর্তী সময়ে অনূদিত হয়েছে। তাঁর বহুপঠিত উপন্যাস ‘বিশ্বাসঘাতক’। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বইগুলো হল ‘হে হংসবলাকা’, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’, ‘হংসেশ্বরী’, ‘জাপান থেকে ফিরে’, ‘কালো কালো’, ‘খাণ্ডব দাহন’, ‘খোলা মনে’, ‘কনকাঞ্জলি’, ‘লা জবাব দিল্লি অপরূপা আগ্রা’, ‘লাডলী বেগম’, ‘লাল ত্রিকোণ’, ‘মান মানে কচু’, ‘মিলনান্তক’, ‘মহাকালের মন্দির’, ‘মনামি’ প্রভৃতি। ‘অজন্তা অপরূপা’র জন্য ১৯৬৯ সালে পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। ‘রূপমঞ্জরী’র জন্য ২০০০ সালে পেয়েছেন বঙ্কিম পুরস্কার। সাহিত্যচর্চা এবং চাকরি সমানতালে চালিয়ে নিয়ে গেছেন। দুটি স্রোতের কোনওটাকেই অবহেলা করেননি। নিজের চোখে দেখে গেছেন তাঁর বইয়ের জনপ্রিয়তা। সাফল্য উপভোগ করেছেন।

আরও পড়ুন-মোদি সরকার কৃষকদের স্বার্থ দেখে না,বিজেপিকে পরাস্ত করার ডাক দিল কিসান মোর্চা

২০০৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল। প্রায় দু-দশক হতে চলল তিনি নেই। তাঁর বিচিত্র সৃষ্টিকে অস্বীকার করা যাবে না কোনওভাবেই। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়, জন্মশতবর্ষে সাহিত্যমহলে তিনি যেন কিছুটা উপেক্ষিত। এই উপেক্ষা তাঁর মতো জনপ্রিয় সাহিত্যিকের হয়তো প্রাপ্য ছিল না। তাঁকে নিয়ে আরও বেশি চর্চা প্রয়োজন। তাঁকে আরও জানা প্রয়োজন। সেটা তাঁর জন্য নয়, আমাদের নিজেদের জন্য। না হলে বাংলা সাহিত্য অপরাধী থেকে যাবে সময়ের কাছে।

Latest article