ক্যানসার প্রতিরোধে স্বয়ং প্রকৃতি

প্রকৃতির অপার ভাণ্ডারের প্রায় সব উপাদানেই কম-বেশি লুকিয়ে রয়েছে ক্যানসার রোগের প্রতিরোধের রহস্য। মগজাস্ত্র নয় সেটি হল খাদ্যাস্ত্র। ক্যানসার আসলে কী। কীভাবে প্রকৃতি কাজ করে ক্যানসারের বিরুদ্ধে তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিলেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

আমরা যে প্রকৃতির কাছে কতটা ঋণী সেটা আর আলাদা করে বলার কোনও দরকারই পড়ে না। কারণ আমাদের বেঁচে থাকার ভিত্তি এই প্রকৃতি। আমরা প্রকৃতির রসদ সংগ্রহ করেই জীবনধারণ করি। বিজ্ঞানের হাত ধরে আমরা যতই উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাই না কেন, আজও প্রকৃতির সব রহস্য উন্মোচন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে প্রকৃতি এমন কিছু রসদের সন্ধান আমাদের দিয়েছে, যা বর্তমানে ক্যানসার (Cancer) নামক মারণরোগের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যথেষ্ট চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে।

কী এই ক্যানসার?
বর্তমানে এই ক্যানসার কথাটির সঙ্গে আমরা সকলেই সুপরিচিত। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটস (৪৬০-৩৭০ খ্রিঃ পূঃ) ‘কার্সিনোস’ ও ‘কার্সিনোমা’ এই দুটি শব্দের উল্লেখ করেন। গ্রিক ভাষায় যার অর্থ হল কাঁকড়া। এর পরবর্তীতে রোমান চিকিৎসক এই ক্যানসার নামটি দেন। ক্যানসার বলতে আমরা যা জানি সেটি হল কোনও কারণে যদি কোষ বিভাজন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে, তাহলে একটি কোষের বদলে কোষ-পিণ্ডের সৃষ্টি হয়। যাকে আমরা সাধারণ ভাষায় টিউমার বলে থাকি। আর এই টিউমারে থাকা কোষগুলি যদি আমাদের দেহের বিভিন্ন জায়গায় বা দেহের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে সেখানকার কার্যকারিতায় বিঘ্ন ঘটাতে শুরু করে তখনই সেটি ক্যানসারের রূপ নেয়। কোষের এই ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাটিকে বলা হয় ‘মেটাস্ট্যাসিস’। সাধারণত কোনও টিউমারের এই মেটাস্ট্যাটিক আচরণ দেখা দিলেই তখন ক্যানসার হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

কেন হয় ক্যানসার (Cancer)
এখনও ক্যানসারের কোনও একটি নির্দিষ্ট কারণ বিজ্ঞানীদের পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। যদিও কারণ হিসেবে আমাদের বেহিসেবি, অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারণকেই দায়ী করা হয়। যার মধ্যে আমাদের খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত ধূমপান একেবারে প্রথম সারিতে পড়ে। যদিও যাঁরা ধূমপান করেন না তাঁরা যে এর থেকে রেহাই পান তাও কিন্তু নয়। যত দিন যাচ্ছে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ততই বাড়ছে। আজ আমরা প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের কথা শুনে থাকি। প্রোস্টেট ক্যানসার, ব্রেস্ট ক্যানসার, কোলন ক্যানসার, লিম্ফোমা, সারকোমা, ব্লাড ক্যানসার ইত্যাদি এখন প্রায় ঘরে ঘরে দেখা যায়। যদিও ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্যানসার চিকিৎসাও যে উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে উঠছে তা আমরা একেবারেই অস্বীকার করতে পারি না।

ক্যানসার (Cancer) চিকিৎসার অগ্রগতি কতটা
বিভিন্ন উন্নত মানের ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে এর নিরাময় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা কেমোথেরাপি বলে থাকে। এ ছাড়াও রয়েছে রেডিয়েশন থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা হল এই ক্যানসার এক-এক জনের দেহে এক-এক রকমভাবে আচরণ করে তাই এর বিরুদ্ধে প্রযুক্ত ওষুধও সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে ক্রিয়াশীল না-ও থাকতে পারে। এর পাশাপাশি ক্যানসার রোগীদের ক্ষেত্রে যে-সমস্ত ওষুধ প্রয়োগ করা হয় সেই সমস্ত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এতটাই মারাত্মক হয় যে সেটাকে বহন করতে করতে রোগী আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই বলা যায় চিকিৎসাপদ্ধতি যতই উন্নত হোক না কেন এর সম্পূর্ণ নিরাময় আমাদের কাছে এখনও অধরা। তবে কি এর থেকে মুক্তি পাবার কোনও আশা নেই? কোনও রেহাই নেই এই মারণরোগের হাত থেকে? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে প্রকৃতির কাছে। যার কিছুটা সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

প্রকৃতির রসদেই লুকিয়ে প্রতিকার
প্রকৃতির অপার ভাণ্ডারের প্রায় সকল উপাদানেই কম-বেশি লুকিয়ে রয়েছে ক্যানসার রোগ প্রতিরোধের রহস্য। তবে এই তালিকায় যারা প্রথম সারিতে জায়গা করে নিয়েছে, তারা হল— বেদানা, চা (মূলত গ্রিন টি), বিভিন্ন বেরি-জাতীয় ফল, আঙুর, হলুদ, মধু, ব্রকোলি, রসুন, গাজর, টম্যাটো, কাঁচালঙ্কা, বাঁধাকপি। এমনকী আমাদের সবথেকে প্রিয় আমেও লুকিয়ে আছে এই রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। বিভিন্ন নামী গবেষণাপত্রে যার প্রমাণও রয়েছে। এবার দেখে নেওয়া যাক এই সমস্ত সাধারণ খাদ্য কী করে ক্যানসার নামক এরকম একটি মারণাত্মক অসুখের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা পায়। এর পেছনে আসল রহস্যটাই বা কী?

আরও পড়ুন- হিন্দু না মুসলমান, কোরো না জিজ্ঞেস, সাম্প্রদায়িকতাকে করো নিকেশ

খাদ্যাস্ত্র
বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে, অঙ্কোজিন অর্থাৎ ক্যানসার সৃষ্টির জন্য দায়ী যে জিন, সেটি ছাড়াও ক্যানসার সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ হল ROS (Reactive Oxygen Species)-এর সৃষ্টি। এগুলি হল যথাক্রমে সুপার অক্সাইড, পারক্সাইড ইত্যাদি। অর্থাৎ সহজ করে বলতে গেলে তীব্র জারক পদার্থ অক্সিজেনের সৃষ্টি। যা তাদের তীব্র বিক্রিয়ক ক্ষমতায় শুধু দেহের স্বাভাবিক কোষের গঠনের পরিবর্তন ঘটায় তাই নয় এরা খুব দ্রুত DNA-র সজ্জাক্রমের পরিবর্তন ঘটায়, ফলে DNA তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। যার ফলস্বরূপ অনিয়ন্ত্রিত কোষবিভাজন দেখা যায়। এই ROS সুপ্ত অবস্থায় থাকা অঙ্কোজিনকে সক্রিয় করে তুলতে তথা ক্যানসার কোষগুচ্ছকে সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ প্রদানেও সাহায্য করে। তাহলে এবার প্রশ্ন হল এই ROS-এর সৃষ্টি হয় কীভাবে? এবং এর সঙ্গে প্রাকৃতিক উপাদনেরই বা কী সম্পর্ক? আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রার দ্রুতগতি বজায় রাখতে প্যাকেটজাত খাবারের প্রতি নির্ভরশীলতা, সবুজ শাক-সবজির তুলনায় কৃত্রিম ও প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ, যথেচ্ছ ধূমপান— এই সব জিনিস আমাদের দেহে ROS-এর জন্ম দেয়। আর এর বিরুদ্ধে কাজ করে প্রাকৃতিক উপাদান থেকে প্রাপ্ত ফাইটোকেমিক্যাল। এই সমস্ত প্রাকৃতিক খাদ্যে ‘পলিফেনল’ নামক একপ্রকার উপাদান উপস্থিত থাকে। যা এই ROS-এর সক্রিয়তাকে অবদমিত করে, একে নিষ্ক্রিয় করে দেয় অর্থাৎ এরা অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট হিসেবে কাজ করে। ফলে ROS কোনওভাবেই আর ক্যানসার কোষ সৃষ্টিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করার অবস্থায় থাকে না। গবেষণায় এ-ও দেখা গেছে যে এই পলিফেনল ক্যানসার কোষে প্রয়োগের দ্বারা এর আকার তথা বিস্তারের প্রবণতাকে অনেকাংশে আটকানো সম্ভব হয়েছে। যদিও শুধুমাত্র প্রাকৃতিক উপাদানের মাধ্যমে ক্যানসারের (Cancer) সম্পুর্ণ নিরাময় এখনও গবেষণা সাপেক্ষ।
তাই বলা যায়, আমরা যতই বিজ্ঞাননির্ভর আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠি না কেন আজও কোনও কঠিন সমস্যার সমধান খুঁজতে বারে বারে সেই প্রকৃতির কাছেই আসতে হয়। কারণ প্রাকৃতিক সমস্ত উপাদানেই রয়েছে অমৃতের রহস্য যা শুধু আমাদের জীবনধারণেই নয়, জীবন বাঁচাতেও সাহায্য করে।

Latest article