‘না’-এর ভূগোল ক্রমপ্রসারিত হচ্ছে। ভারতের আমজনতা এমনই অভাগা যে তারা যেদিকে তাকাচ্ছে সেদিকেই সাগর শুকিয়ে যাচ্ছে। নেতির প্রসৃতি আচ্ছন্ন করছে আমাদের পেট ও পকেট, খাদ্য ও অর্থ, এমনকী বহুকালাগত পরম্পরাও। লিখছেন আকসা আসিফ
‘‘ওরা বিরাট এক নৈরাজ্যের, এক নেই-রাজ্যের বাসিন্দে।/ ওদের কিছু নেই/ থিত নেই ভিত নেই, রীতি নেই নীতি নেই/ আইন নেই কানুন নেই বিনয় নেই ভদ্রতা নেই/ শ্লীলতা-শালীনতা নেই।”
আরও পড়ুন-জব চার্নককে দেখার অপেক্ষায় সিটি অফ জয়
এর পরের পঙ্ক্তিতে কবির সতর্কবাণী, ‘‘ঘেঁষবেন না ওদের কাছে’। কারণটাও খুব স্পষ্ট করে বলা, ‘‘কোথ্থেকে আসছে সেই অতীতের স্মৃতি নেই/ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সেই বর্তমানে গতি নেই/ কোথায় চলেছে নেই সেই ভবিষ্যতের ঠিকানা।”
কবিতাটির রচয়িতা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। বহুদিন আগে লেখা। কিন্তু প্রাসঙ্গিকতা এতটুকু হারায়নি লাইনগুলো। বরং, আরও বেশি প্রসঙ্গিক হয়ে উঠছে প্রতিদিন।
সংবিধান বলছে, ভারত একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে এখানে কেউ বিশেষ সুবিধা ভোগ করে না কিংবা কোনও বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় না। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে ততই যেন এই কথাগুলো ক্লিশে হয়ে যাওয়া স্তোকবাক্য হতে হতে এক ভয়ানক মিথ্যা হয়ে ফুটে উঠছে। মোদি-জমানার বোধহয় এটাই সব চেয়ে ভয়ংকর বিশেষত্ব।
আরও পড়ুন-পুজোয় রাতভর মেট্রো-পরিষেবা
কয়েকমাস আগেই প্রকাশিত হয়েছে ‘ইনইকোয়ালিটি কিলস’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট। প্রকাশক অক্সফাম। আর দিন কয়েক আগে প্রকাশিত হয়েছে ওই সংস্থারই আর একটা রিপোর্ট। শিরোনাম ‘ইন্ডিয়া ডিসক্রিমিনেশন রিপোর্ট ২০২২’।
এই রিপোর্ট বলছে, কাজের ব্যাপারে দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা এক হলেও তফসিলি ও আদিবাসী সম্প্রদায় সমাজের অন্যান্য অংশের থেকে ৩৩ শতাংশ কম আয় করেন। অমুসলমানরা মুসলমানদের চেয়ে ৪৯ শতাংশ আয় বেশি করেন। তফসিলি জাতি উপজাতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ তালিকার বাইরে যাঁরা আছেন তাঁদের চেয়ে গড়ে মাসে সাত হাজার টাকা কম আয় করেন।
আরও পড়ুন-পুজোয় রাতভর মেট্রো-পরিষেবা
১৫ বছরের বেশি নিয়মিত বেতনের চাকরি করেন এমন মুসলমানের হার হল ১৫.৬ শতাংশ। অমুসলমান জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এই হার বেশ খানিকটা বেশি, ২৩.৩ শতাংশ।
এর আগে অক্সফাম জানিয়েছিল, অতিমারির ফলে ২০২১-এ এদেশে ৮৪ শতাংশ মানুষের আয় কমে গিয়েছে। আর ওই একই সময়ে ধনবানদের সংখ্যা ১০২ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪২ হয়েছে। তাদের আয় ২৩.১৪ লক্ষ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৩.১৬ লক্ষ কোটি টাকা হয়েছে। আর এই কালপর্বেই ৪.৬ কোটি পরিবার কাজ হারিয়ে চরম দারিদ্র্যসীমার অতলে তলিয়ে গিয়েছেন।
এই অতিমারি পর্বে গ্রামবাসী মুসলমানদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়েছে ১৭ শতাংশ হারে। অন্যান্য গ্রামবাসীর আয় কমেছে ১৩ শতাংশ হারে। মোট মুসলমান জনগোষ্ঠীর ৫৯.৩ শতাংশ কম মজুরিতে কাজ করতেন ২০০৪-’০৫-তে। ২০১৯-’২০-তে এই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ৬৮ শতাংশে। শহুরে নিয়মিত বেতনের চাকরিতে অমুসলমানদের প্রাপ্ত মাসিক বেতন গড়ে ২০ হাজার ৩৪৬ টাকা। মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই অঙ্কটা মেরেকেটে ১৩ হাজার ৬৭২ টাকা। অর্থাৎ, নিয়মিত বেতনের চাকরিতে অমুসলমানদের মুসলমানদের চেয়ে ৪৯ শতাংশ বেশি আয় করেন। এমনকী স্বনিযুক্তি প্রকল্পে অমুসলমানদের আয়ের এক-তৃতীয়াংশ আয় মুসলমানদের।
আরও পড়ুন-টালা ব্রিজে ভারী যান চলবে না
সিএমআইআই-এর রিপোর্ট বলছে, গত অগাস্ট মাসে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৮.৩ শতাংশ। এক বছরের মধ্যে দেশে এত বেশি বেকারত্ব দেখা যায়নি। ১৫ থেকে ২৪ বছরের যুবক-যুবতীদের ৩৪ শতাংশ কর্মহীন, বেকার।
শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনের হার বাড়ছিল গত বছর ডিসেম্বর থেকে। কিন্তু জুলাই মাসে তা নেমে আসে ২.৪ শতাংশে। আর এই উৎসের মরশুমে তা একেবারে তলানিতে।
এক দিকে উৎপাদন কমছে, অন্যদিকে দাম বাড়ছে। মানুুষের কাজ নেই, আয় নেই, ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে ঠেকেছে, অথচ জিনিসের দাম বাড়ছে হু-হু করে। মন্দাস্ফীতির লক্ষণ একেবারে স্পষ্ট।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম, ডেঙ্গু রোধে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসা চান
বিগত ১৭ মাস ধরে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার দু অঙ্কে বাঁধা। ২০২১-এর অগাস্টে এই মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ১১.৬৪ শতাংশ। এ-বছর অগাস্টে তা বেড়ে হয়েছে ১২.৪১ শতাংশে। এই তথ্য খোদ কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের। খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হারের দশাও তথৈবচ। অগাস্ট ২০২২-এ তা ছিল ৭ শতাংশ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পূর্বাভাস জানাচ্ছে তা নেমে বড়জোর ৬.৭ শতাংশ হবে। তার নিচে নামবে না।
২০২২-এর অগাস্টে পাইকারি বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ১২.৩৭ শতাংশ হারে। সবজির দাম বেড়েছে ২২.২৯ শতাংশ হারে। গমের দাম বেড়েছে প্রায় ১৭.৩৫ শতাংশ। অথচ গত বছর অবস্থাটা এরকম ছিল না। গত বছর এই সময়ে সবজির দাম ছিল (-) ১২.৩৪ শতাংশ। গমের দাম তখন ছিল (-) ০.১৯ শতাংশ। এই কালপর্বে চালের দামও বেড়েছে হু-হু করে। বৃদ্ধির হার ৪.৩৩ শতাংশ। আলুর দাম বেড়েছে ৪৩ শতাংশ হারে। ফলের দাম বেড়েছে ৩১ শতাংশ হারে, মাছ, মাংস, ডিমের দাম পাইকারি বাজারে বেড়েছে ৭.৮৮ শতাংশ হারে। ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৩৩.৬৭ শতাংশ হারে। পেট্রোলের দাম বেড়েছে ৩৮.৬৮ শতাংশ হারে। রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯ শতাংশ হারে।
এরই মধ্যে জ্যঁ দ্রেজে ও ঋত্বিকা খেরা দেখিয়েছেন, গণবণ্টনের সুবিধা পাওয়ার কথা ১৩৭ কোটি ভারতবাসীর মধ্যে ৯২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের। কিন্তু সরকারি হিসাব বলছে, পিডিএস বা গণবণ্টন বা সাদাকথায় রেশন ভোগী ভারতবাসীর সংখ্যা এর চেয়ে অনেক কম। ৮০ কোটির কাছাকাছি।
আরও পড়ুন-হাওড়ায় শিল্পের জোয়ার মুখ্যমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা
এই পরিস্থিতিতে মোদি সরকারের পদক্ষেপে উৎপাদন বৃদ্ধি বা দাম কমার বদলে উৎপাদন কমে এবং দাম বেড়ে পুঁজিপতিদের মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে বেকারত্ব, আয়-বৈষম্য।
এরকম সরকার আর নেই দরকার।
ভারত এখন সত্যিই ‘সেচহীন ক্ষেত / মণিহীন চোখ, / চোখহীন মুখ / একটা স্ফুলিঙ্গহীন ভিজে বারুদের স্তূপ’।