অ-রূপোকথা

এক যে ছিল গ্রাম। গ্রামের নাম ফুরফুরা। তার পাশে ছিল এক নদী। নদীর নাম কাপাস। ভূগোল বইয়ে এই নদীর নাম আলাদা থাকতে পারে।

Must read

জয়ন্ত দে: এক যে ছিল গ্রাম। গ্রামের নাম ফুরফুরা। তার পাশে ছিল এক নদী। নদীর নাম কাপাস। ভূগোল বইয়ে এই নদীর নাম আলাদা থাকতে পারে। কী তার নাম আমি জানি না। কিন্তু এ তল্লাটের সবাই নদীটিকে ভালবেসে এই নামেই ডাকে। কাপাস! কাপাস! নতুন লোকজন কাপাস নাম শুনে কপাল কোঁচকায়। বিড়বিড় করে— কাপাস তো তুলো। ঠিক বলেছে, ঠিক যেন তুলো!

আরও পড়ুন-অষ্টমীতে বেলুড় মঠের আকর্ষণ কুমারী পুজো, রীতি মেনে চলছে পুজো

এই নদীর জল সাদা। জোয়ায়-ভাটায় ঘোলা হয় না। সমস্ত ঢেউ সমস্ত স্রোত সাদা সাদা গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে ফুরফুর করে ওড়ে। যেন তুলো। এ নদীতে চিৎ-সাঁতার দিতে দিতে অনেকে নাকি একটু আধটু ঘুমিয়েও নেয়। নদীর জল এত নরম, আর এতই প্রশান্ত।
সবাই ভালবাসে নদীকে। সবাই ভালবাসে তাদের এই গ্রামকে। গ্রামের নাম ফুরফুরা। নদীর নাম কাপাস।
এই গ্রামেই বাস করে দুই ভাই। কাবু আর হাবু। কাবু হল কালীপদ। হাবু হল হলধর। তবে ভাল নাম আছে খাতায়। আর আছে সার্টিফিকেট, রেশনকার্ড, আধারকার্ড, ভোটার কার্ডে। সেখানে থাকুক। আমরা কাবু আর হাবু বলব।

আরও পড়ুন-মহাষ্টমীর সকালে ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল দিল্লি

কাবু আর হাবু দুই ভাই। এক মায়ের পেটের ভাই না। খুড়তুতো জেঠতুতো ভাই। কিছুদিন আগেও অনেকে জানত না ওর খুড়তুতো জেঠতুতো। সবাই জানত ওরা নিজের ভাই। ওরা একসঙ্গে স্কুলে পড়েছে। কলেজে গেছে। তখন ওদের একটাই সাইকেল ছিল। একজন চালাত, অন্যজন পিছনে বসত। ব্যাপারটা ভাগাভাগি ছিল না, যে যখন ইচ্ছে করত সে চালাত। যার ইচ্ছে করত না সে পিছনে বসত। ওরা একটা ডিম ভাগ করে খেত। সুতো দিয়ে, ছুরি দিয়ে কাটাকাটি করত না। আজ এর সাদা, ওর কুসুম। কাল ওর কুসুম, এর সাদা। ডাবও তাই এর জল, ওর শাঁস। ওর জল, এর শাঁস।

আরও পড়ুন-রামমোহন সম্মিলনীর মণ্ডপে অষ্টমীর অঞ্জলি দিলেন সি ভি আনন্দ বোস

বড় হয়ে যে যার বাবার ব্যবসায় যুতে গেল। কাবুর বাবা কেরোসিন তেলের ডিলার। হাবুর বাবার দুধ-দই-ছানার ব্যবসা। ওদের বাবারা অসৎ ছিলেন না। তাই ওরা সৎ ভাবেই ব্যবসা করে। আয় মোটামুটি আয়। হাসি গানে দিন চলে যায়।
ক্রমে দু’জনের বিয়ের বয়েস হল। তারপর তাদের বিয়ে হল। কাবুর বউ লক্ষ্মী আর হাবুর বউ সরস্বতী।
দুই ছেলের বাবারা খুব খুশি। তাদের মধ্যে ভাব আছে। দুই মা, মানে হাবুর মা আর কাবুর মায়েরও খুব ভাব। দুই ছেলের মধ্যেও খুব ভাব। এবার লক্ষ্মী আর সরস্বতী এসেছে, নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এদেরও খুব ভাব হবে। একজন উত্তরের, একজন দক্ষিণের।
কিন্তু অচিরেই দেখা গেল সে গুড়ে বালি! দুই বউয়ের বনিবনা হল না। কেন হল না? তা সে সবের কারণ জানা যায় না। তবে যা শোনা যায়। তাহল, হাবুর বউ সরস্বতী নাকি কেরোসিনের গ্যাসে মূর্ছা যায়।

আরও পড়ুন-প্রয়াত ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ফুটবলার স্যার ববি চার্লটন

এই কথা শুনে কাবুর বউ লক্ষ্মী মারাত্মক রেগে গেল। বলল, ‘দুধ আমার সহ্য হয় না। দুগ্ধজাত কোনও খাবার খেলে পেটে গ্যাস হয়।’
সরস্বতী বলল, ‘ওদের সবার গায়ে কেরোসিনের গ্যাস।’
লক্ষ্মী বলল, ‘ওদের সবার গায়ে দুধ-গন্ধ। যেন ছেলেপুলে বমি করেছে!’
লাগ! লাগ! লাগ!
জোড়া শ্বশুর-শাশুড়ি জোড়া বউকে সামলাতে পারলেন না। কেন পারলেন না। কারণ, তাঁরা নির্বিবাদী মানুষ, তাঁদের ঝামেলা মেটানোর অভিজ্ঞতা নেই। তাই তাঁরা মান বাঁচাতে কাশীবাসী হলেন।

আরও পড়ুন-ফুচকার মণ্ডপ থেকে উধাও ফুচকা, ঘুম উড়ল উদ্যোক্তাদের

দুই ভাই বাড়ির চৌহদ্দিতে কথা বলে না। কিন্তু বউদের চোখের নাগাল টপকালেই হলায় গলায় ভাব। এখনও তারা ফাঁক পেলে এর সাদা ওর কুসুম। ওর জল, এর শাঁস। ডাব হাতেই নিয়েই তাদের ভাব। ওরা দুজনেই ঠিক করেছে তাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না। কিন্তু—
এই কিন্তুটা কিন্তু তাদের বাড়ি ঢুকলেই খ্যাঁচাকলে পড়তে হয়। আমি আগেই বলেছি। কাপাস নদীর মতো ফুরফুরে তাদের গ্রাম। ফুরফুরে গ্রামে আগে কোনওদিন ঝগড়াঝাঁটি, মামলা-মকদ্দমা, থানা পুলিস হয়নি। কেউ কারও গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরেনি। কেউ কাউকে ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে যায়নি। এখানে যে যাকে ‘শালা’ বলেছে, বুঝতে হবে সেটা গালাগালি নয়, মানুষটা নির্ঘাত তার শ্যালক। এমন গ্রামে এখন নিত্যদিন ধুন্ধুমার। এ ঝাঁটা দেখালে, ও জুতো দেখাচ্ছ। এ এঁটো-জল ছুঁড়লে, ও খোলপচার জল ছুঁড়ছে। ওদিকে গঞ্জের দোকানে গিয়ে দুই ভাই মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।

আরও পড়ুন-পুজো পরিক্রমা, যাত্রা হল শুরু

লক্ষ্মী বললে— হুমম, গোয়ালার আশি বছরে বুদ্ধি হয় না, আর উনি সবজান্তা দুধওয়ালা।
সরস্বতী বললে— হুম্ম উনি এক্কেবারে রাজার বেটা কেরোসিন তেলওয়ালা।
দুই ভাইয়ের মনে খুব কষ্ট। এতদিন তারা জানাত না, তারা দুধওয়ালা, তারা কেরোসিন তেলওয়ালা। তারা জানত, তারা ব্যবসায়ী।
এরমধ্যে একদিন গ্রামপঞ্চায়েত থেকে নোটিশ ধরাল, তোমাদের দুই পরিবারের ঝগড়ার জন্য আমরা ‘আদর্শ গ্রাম’ প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার মুখে। তাড়াতাড়ি ঝগড়া থামাও।
ঝগড়া থামবে কী করে?
প্রবীণ একজন বুদ্ধি দিলেন— বাড়ির মাঝখান থেকে পাঁচিল দাও। মুখ দেখাদেখি বন্ধ হলেই ঝগড়া থেমে যাবে।
হাবু আর কাবু দুই ভাই দুই বাড়ির মাঝে উঁচু পাঁচিল দিল। এত বড় পাঁচিল যে কেউ কারও আর মুখ দেখতে পাবে না। পাঁচিল শেষ হলে দু ভাই দু’দিকে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কষ্টও হল।

আরও পড়ুন-বিদ্যাধরীর তীরে পির গোরাচাঁদের মাজার শরিফে সম্প্রীতির দুর্গাপুজো

তারপরের দিনের ঘটনা :
কাবুদের উঠোনের পাঁচিল টপকে উড়ে এল পচা দইয়ের হাঁড়ি। সেটা বোমা ফাটার মতো দুম করে ফেটে ছড়িয়ে পড়ল।
আর হাবুদের উঠোনে এসে পড়ল, একটা মরা ছুঁচো। যে কেরোসিনের ড্রামে পড়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। তারপর বর্ডার পার হয়ে এদিকে।
সে এক তুলকালাম কাণ্ড। পঞ্চায়েতে খবর গেল।
দুই ভাই পঞ্চায়েত অফিসে মাথা নিচু করে গেল। দুই ভাই এক সুরে জানাল— কাল রাত বারোটার সময় প্রচণ্ড জোরে একটা দমকা হাওয়ায় এই কাণ্ড ঘটেছে। দোষ করাও নয়, দোষ হাওয়ার, দোষ বাতাসের…।
হাবু বলল, দমকা হাওয়ায় বারান্দায় রাখা পচা দইয়ের হাঁড়ি উড়ে গিয়ে পড়েছে কাবুদের বাড়ি। স্যরি।
কাবু বলল, দমকা হাওয়ায় ছুঁচোটা উড়ে এসে পড়ল কেরোসিনের ড্রামে। তারপর প্রাণ বাঁচাতে লাফ দিয়ে হাবুদের বাড়ি। স্যরি।
তারপর দুই ভাই ‘দোষ কারও নয় গো মা, আমি সখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যাম…’ রামপ্রসাদী গাইতে গাইতে বাড়ি এল।
পঞ্চায়েত বিচার করে রায় দিল, পাঁচিল আরও উঁচু করো। শুধু উচুঁ নয়, পাঁচিলের ওপর লোহার ত্রিশূল কাঁটা তারে জড়িয়ে বসবে। যাতে এদিককার জিনিস কোনও ভাবেই না ওদিকে না উড়ে যেতে পারে।

আরও পড়ুন-রবীন্দ্রনাথহীন বিশ্বভারতী, ধিক্কার-সমালোচনা সব মহলে

পাঁচিল খুব উঁচু হল। জেলখানার পাঁচিল যেন। পাঁচিলের ওপর ত্রিশূল আর কাঁটাতার।
গ্রামের সব লোক এখন বিকেল হলেই সেই পাঁচিল দেখতে আসে।
কাবু এই পাঁচিল দেখে চিনের পাঁচিল কেমন হতে পারে আন্দাজ করে।
হাবু দুই জার্মানির মাঝের পাঁচিল কেমন ছিল গালে হাত দিয়ে ভাবে।
এদিকে ফুরফুরে গ্রামের নামে বদনাম ছড়াচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, এবার আর ওদের ‘আদর্শ গ্রাম সম্মান’ পাওয়ার চান্স নেই। অনেক রিপোর্ট জমা পড়েছে। মামলা-মকদ্দমা হল বলে। তার আগে দেখো না থানা পুলিস হবেই হবে।
থানার ওসি বলল— এই বার বাছাধনদের পেয়েছি।
গঞ্জের উকিল বলল— যাবে কোথায়, লাইনে এসো বাবা।

আরও পড়ুন-মানবতার খাতিরে পণবন্দি মা-মেয়েকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, দাবি হামাসের

এদিকে হয়েছে কী নিজের ঘর সাজাবে বলে একটা কাক আয়না মুখ করে উড়ে যাচ্ছিল। বড্ড ভারী আয়না। কাকটি মাঝরাস্তায় বিশ্রামের জন্য থামল সেই উঁচু পাঁচিলের ওপর। কিন্তু সেই আয়না গেল কাঁটা তারে জড়িয়ে। কাকটি আর আয়নাকে টেনে তুলতে পারল না।
আর আয়নাটাও এমনভাবে সেট হল— এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি আর ও-বাড়ি থেকে এ-বাড়ি স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল।
দুই বউ এখন বাড়ির ঘরকন্নার কাজকর্ম ফেলে সেই আয়নার দিকে তাকিয়ে বসে থাকল।
দু’জনেই দেখে নদীর ওপারে কত সুখ। একে অন্যের সুখ দেখে তারা দিন দিন শুকিয়ে যায়। তাদের চুল উঠে যায়। তাদের চোখের কোণে কালি পড়ে যায়। খিদে নেই, ঘুম নেই, শান্তি নেই, নেই আর নেই।
দু’পক্ষের বাপের বাড়ির লোক খবর পেয়ে আসে। তারা এসে কী শোনে—
লক্ষ্মী বলল, দুধওয়ালার এত টাকা হবে কেন? ওদের ধ্বংস চাই।
সরস্বতী বলল, কেরোসিন তেলওয়ালার এত টাকা হবে কেন? ওদের নিকেশ করো।
যার যার বাপের বাড়ির লোক শহরে গেল। শহরে সব অভিজ্ঞ মানুষজন আছে। তাদের এক্সপার্ট বলে। তাদের নামের পাশে লম্বা ডিগ্রির লেজ। কী বাহার! তাদের পারিশ্রমিকও মোটা। তাদের সেই মোটা ফিজ দিল কাবু এবং হাবু।

আরও পড়ুন-মানবতার খাতিরে পণবন্দি মা-মেয়েকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, দাবি হামাসের

লক্ষ্মীর বাপের বাড়ির লোক এক্সপার্টদের বলল— হাবুদের শুধু ধ্বংস নয়, আমার মেয়ে-জামাইকে বড়লোক করে দিতে হবে।
সরস্বতীর বাপের বাড়ির লোকও তাদের এক্সপার্টদের বলল— কাবুদের শুধু ওদের নিকেশ নয়, আমার মেয়ে-জামাইকে ধনী করে দাও।
দু-দুটো সার্ভে টিম এলাকা সার্ভে করে গেল। তারপর তারা তাদের ফিজ গুনে নিয়ে রিপোর্ট দিল। এবং কী কী করতে হবে বলে দিল।
তারপর হাবু আর কাবু সব সোনাদানা জায়গা জমি ব্যবসাপত্র বিক্রি করে বুট কোট পরে শহরে ছুটল।
লক্ষ্মী সবাইকে বলল, তার স্বামী বুকপকেটে করে শহর নিয়ে আসবে।
সরস্বতী ঘোষণা করে দিল, তার স্বামীর হাত ধরে শহর এল বলে।
একদিন শহর থেকে ফিরল মিঃ কালিপদ বারুই।
সবাই জানল— কাবু শহরে থেকে প্যাকেট দুধের এজেন্সি নিয়ে এসেছে। আর কাউকে দুধের দোকানে যেতে হবে না। বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যাবে প্যাকেটে করা দুধ, দই, ছানা। ছানা নয় পনির।
একদিন শহর থেকে ফিরল মিঃ হলধর বারুই।

আরও পড়ুন-ঘোড়ানাশের জমিদার বাড়ি: পুজোর চারদিন গাছে বাঁধা থাকেন খেপি মা

সবাই জানল— হাবু শহরে গিয়ে রান্নার গ্যাসের লাইসেন্স নিয়ে এসেছে। আর কেরোসিনের দোকানে যেতে হবে না। বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যাবে রান্নার গ্যাস।
গ্রামের কিছু মানুষ সঙ্গে সঙ্গে প্যাকেট দুধে আর রান্নার গ্যাসে নাম লিখিয়ে ফেলল। তারপর…
তার আর পর নেই—
কাবু আর হাবু গালে হাত দিয়ে বসে থাকে।
লক্ষ্মী স্লোগান তুলল, দুধ খাও— শক্তি বাড়াও।
সরস্বতী স্লোগান তুলল, পরিবেশ বাঁচাও। এলপিজি লাগাও।
বাড়াও বটে, লাগাও বটে, কিন্তু হবে কী করে বটে?
মানুষের পকেটে টাকা নেই। তারা মুখে বুড়ো আঙুল দিয়ে দেখল আদর্শ গ্রামের দিকে শহর এগিয়ে আসছে। ওদিকে বেচারা কাকটা আয়না নিয়ে এখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article