ছোটদের ওবেসিটি

গবেষণা অনুযায়ী দু’বছর আগেও সারা বিশ্বে ৩ কোটি ৮০ লক্ষের বেশি শিশু ছিল যারা স্থূল স্বাস্থ্যের অধিকারী এবং তাদের বয়স ৫ বছরের কম। আর এই শিশুদের অর্ধেকের বসবাস আমাদের এশিয়া মহাদেশে। এই পরিসংখ্যান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চার ওজন পাঁচবছর পেরোলেই কমে যায়। কিন্তু যখন দেখা যায় কমছে না বরং বেড়ে চলেছে তখনই সেটা ওবেসিটি। কেন হয় শিশুর ওবেসিটি। এর সমাধান বা কী, এই বিষয়ে বললেন বিশিষ্ট ডায়েটেশিয়ান এবং ডায়াবেটিক এডুকেটর সোনালি ঘোষ। লিখেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

ওবেসিটি কেন
 শিশু মাতৃদুগ্ধ যতদিন খায় ততদিন শরীরে তেমন মেদ জমে না কিন্তু কৌটোর দুধে আলগা ফ্যাট থাকে এবং অতটা সুষম হয় না যার ফলে সেই দুধ শুরু হলে দিনে দিনে ওজন বাড়ে বাচ্চার। সেই মেদ কিন্তু অনেক বছর অবধি থেকে যায়।
 একটা জিনঘটিত বিষয়ও থাকে। বাবা-মার ওবেসিটি থাকলে বাচ্চার মধ্যে একটা প্রবণতা দেখা দেয়। তখনই শিশুর খাওয়াদাওয়া কন্ট্রোল করতে হয়। নচেৎ আরও ক্ষতি হয়ে যায়।

আরও পড়ুন-বিজেপি-সিপিএম সম্পর্কের অভিযোগ তুলল কংগ্রেস

 ছোটদের স্কুলের টিফিন ওবেসিটির অন্যতম প্রধান কারণ। সময়ের অভাবে মায়েরা দোকানের কেক, বিস্কুট, চিপস দেন আবার ভাল খাবে ভেবে লুচি, পরোটাও দেন। ময়দার তৈরি খাবার বেশি পছন্দ করে শিশুরা। এর ফলে সিম্পল সুগার শরীরে ঢোকে। দুধ, দই এগুলো চিনি ছাড়া ছোটদের খাওয়ানো যায় না, এতে অ্যাসিডিটি তৈরি হয়। বাড়ি ফিরে ইনস্ট্যান্ট নুডুলস বা কেক, পেস্ট্রি বা প্যাকেটজাত খাবার, স্যুপ খায় বেশিরভাগ। ফাস্ট ফুড এখন ছোটদের প্রধান আকর্ষণ যা খুব ক্ষতিকর।
 অনেকসময় যেসব বাচ্চা রোগা তাদের স্বাস্থ্য ভাল করতে কিছু ফুড সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয় যার ফলে তাদের চেহারায় একটা ফ্যাটি ভাব এসে যায় যা কমতে চায় না।

আরও পড়ুন-সেকেন্দ্রাবাদে পুড়ে ছাই গাড়ির শোরুম, মৃত ৮

 মোবাইলে আসক্তি ছোটদের ওজনবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। খাবার খেলে নার্ভ একটা সিগনাল পায় এবং খাদ্যরস নির্গত হয়। কাজেই কী খাচ্ছি সেটা না বুঝে খেলে সেই রস নিঃসরণ হয় না ফলে পরিপাক ঠিকমতো হয় না এবং ওবেসিটির শিকার হয়।
 আজকের প্রজন্ম মুড়ি, চিঁড়ে, ছাতু খেতে ভুলে গেছে। এগুলো ছোটরা তা কখনওই খেতে চায় না।
ওবেসিটি কখন
 কোনও বাচ্চার পাঁচবছরে ওজন হওয়া উচিত পনেরো-ষোলো কেজি। সেখানে যদি কুড়ি-বাইশ কেজি হয়ে যায় যা দশ বছরে গিয়ে হবার কথা তাহলে তা ওবেসিটি। তখন সতর্কতা জরুরি। সেটা না করলে সেই বাচ্চা যখন বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছয় তখন শারীরিক এবং মানসিক নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়।

আরও পড়ুন-ফের এজি হচ্ছেন রোহতগি

 চাইল্ড ওবেসিটির পরবর্তী কুফল এগারো বছর বয়স পেরোলেই পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম দেখা দিচ্ছে। মোটা হলে পিম্পল, অ্যাকনেও বেশি হয়। একটু বেশি দৌড়ঝাঁপে হাঁপাতে থাকে। কুড়ি পেরোলে ডায়াবেটিস দেখা দিচ্ছে। হার্টের সমস্যা, হাই প্রেশার দেখা দিচ্ছে এমনকী চেহারা নিয়ে হীনমন্যতা থেকে মানসিক অবসাদেও ভোগে।
কী জরুরি
 দরকার সুষম আহার সঙ্গে শারীরিক কসরত। খেলাধুলো খুব জরুরি। কারণ এখন এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির নামেও বাচ্চাদের প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। নাচ, গান, ক্যারাটে সবটাই যেন কিছু একটা করে দেখাতে হবে। এটা একদম উচিত নয়। দরকার বন্ধুদের সঙ্গে নির্ভেজাল খেলা।
 পরিবারের অন্য সদস্যরা যা খাচ্ছে বাচ্চাও তাই খাবে। আলাদা করে কিছু নয়। বাড়ির রান্না ঝাল বা খুব বেশি তেল-মশলা ছাড়া করতে হবে। সেটাই সবাই খেল। এতে করে বাড়ির খাবারে একটা অভ্যেস গড়ে উঠবে। পুষ্টিটাও পুরোপুরি পাবে।

আরও পড়ুন-যুদ্ধে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, মৃতের সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়েছে

কী খাবে কী খাবে না
 পাঁচ বছরের ঊর্ধ্বের যারা ওবেসিটির শিকার তাদের জন্য প্রপার ডায়েট চার্ট করে নিতে হবে। তাদের খাদ্যতালিকায় থাকবে সিরিয়ালস। সেটা হবে ফাইবার জাতীয় সিরিয়াল। সিম্পল সুগার ময়দা, মিষ্টি এগুলো কমিয়ে ফেলতে হবে।
 বাচ্চাদের আরও একটা আসক্তি থাকে চকোলেটের প্রতি। যেমন ডার্ক চকোলেট ছোটদের দেওয়া নিয়ম নয়। সপ্তাহে একদিন তাকে খুব সামান্য পরিমাণে মিল্ক চকোলেট, লজেন্স বা চিপস দেওয়া যেতে পারে।
 ওবেস বাচ্চাদের একদম সকালে শুধু একগ্লাস দুধ বিস্কুট দিন । তবে চকোলেট বিস্কুট কখনওই নয়। পরিবর্তে মারি, থিন অ্যারারুট, গ্লুকোজ বা মিল্ক বিস্কুট দেওয়া যেতে পারে।

আরও পড়ুন-রানির মৃত্যুর পর স্কটল্যান্ডে জোরালো স্বাধীনতার দাবি

 জলখাবারে ঘি বা মাখন ভাত নয়, পরিবর্তে সুজি বা ওটস উপমা, ওটসের চিল্লা, চিঁড়ের পোহা দেওয়া যেতে পারে। ব্রেড একটু অন্যরকম ভ্যারাইটি, যেমন গার্লিক ব্রেড, জিঞ্জার ব্রেড দেওয়া যেতে পারে। খেতেও ভাল পুষ্টিগুণও আছে। স্যান্ডুইচ করে দেওয়া যেতে পারে ডিমসেদ্ধ এবং সবজি দিয়ে। হোয়াইট ব্রেড না দেওয়াই ভাল।
 এগটোস্ট, স্ক্রাম্বলড এগ সঙ্গে টোস্ট, মাল্টিগ্রেন আটার রুটি সঙ্গে আলু ছাড়া অন্যান্য সবজি দিয়ে তরকারি খেতে পারে। লাইট বাটার সামান্য আধচামচ দেওয়া যেতে পারে তবে মার্জারিন একেবারে নয়।
 যে বাচ্চা অল্প ভাত খেয়ে স্কুলে যায় সে ভাতের সঙ্গে ডাল বা সবজি খেতে পারে, কোনও ভাজাভুজি নয়।
 রোজ একটা গোটা ফল চিবিয়ে খেলে খুব ভাল। ফলের রসের থেকে তাতে ফলের পুরো উপকারিতা পাওয়া যায়। ফল গোটা খেতে না চাইলে স্মুদি করে দেওয়া যেতে

আরও পড়ুন-ভিড় এড়িয়ে এক ক্লিকে পৌঁছন প্রতিমার সামনে

 দুপুরে টিফিনে রুটি বা মাল্টিগ্রেন আটার হালকা পরোটা, সবজি, একটা ডিমসেদ্ধ। সুজির বা আটার চিল্লা নিতে পারে টিফিনে।
 বাড়িতে থাকলে ভাত একদম মাপমতো খেতে হবে। সবরকম সবজি দিয়ে তরকারি। মাছ বা চিকেন দেওয়া যেতে পারে। এগুলোর পরিবর্তে সয়াবিন বা পনিরও দেওয়া যেতে পারে। তবে চিকেন রোজ নয়, সপ্তাহে দু’ থেকে তিনদিন দিন বরং ডিম আর দুধ রোজ রাখুন খাদ্যতালিকায়।
 বিকেলের দিকেও একবার দুধ। অবশ্যই টোনড মিল্ক দিলে খুব ভাল, সঙ্গে বিস্কুট। ছানা করে দেওয়া যেতে পারে। ফ্রুট কাস্টার্ড, টকদই এবং ফল দিয়ে স্মুদি করে দিন। কর্ন দিয়ে একটু হালকা মুখরোচক কর্ন চটপটা বা কর্ন স্যালাড দেওয়া যেতে পারে।
 বিকেলে কখনও-সখনও বাড়িতেই পিৎজা বানিয়ে দিন। ময়দার বদলে মাল্টিগ্রেন আটার পিৎজা ব্রেড তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে। খুব বেশি চিজ না দিয়ে হালকা সবজি, চিকেন সেদ্ধ দিয়ে বানিয়ে দিলে খেতে তো ভাল লাগবেই, ওজনও নিয়ন্ত্রিত হবে।

আরও পড়ুন-রেলের আশ্রয় থেকে পুলিশকে আক্রমণ বিজেপির

 রাতে ভাতের বদলে মাল্টিগ্রেন আটার রুটি দিলে ভাল ওজন কমাতে সাহায্য করবে। স্যুপ খেতে পারে রাতে। অনেকের রুটি সহ্য হয় না। তাদের খুব সামান্য পরিমাণে ভাত দিতে হবে। আনুষঙ্গিক পদ একটু বেশি রাখলে ভাল। মাছ, ডাল, চিকেন, পনির যে কোনও একটা প্রোটিন জাতীয় খাবার রাখতে হবে। টকদই নিয়মিত খেতে হবে নর্মাল তাপমাত্রায়।
 ওবেস বাচ্চারা শাক-সবজি বা ফাইবার জাতীয় খাবার কম খায় তাই কোষ্ঠকাঠিন্য হয়, পেটে গ্যাস, অম্লান আমাশা জাতীয় সমস্যাও হয়। এর থেকে লিভার থেকে শুরু করে নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।
 সুইমিং খুব ভাল ব্যায়াম ওবেসিটি কমাতে। সুইমিংয়ে ভর্তি করা যেতে পারে। কমদিনে উপকার মিলবে। এখন স্কুলগুলির পরিসংখ্যান বিচার করলে প্রায় চল্লিশ শতাংশ বাচ্চা ওবেসিটির শিকার। কাজেই এটা খুব বড় সমস্যা যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে দুর্বল করে তুলছে তাই এর প্রতিরোধ দরকার।

Latest article