সৈকত মুখোপাধ্যায়: শুক্লা জানে এই পেশেন্ট আর বেশিদিন বাঁচবে না। নার্স হিসেবে তার যা কর্তব্য সে করে যায়। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মেনে ওষুধ দেয়, ব্লাড টেনে ল্যাবরেটরিতে পাঠায়। ডানহাতের চ্যানেল ব্লক হয়ে এলে বাঁ-হাতে নতুন করে চ্যানেল করে। এক অ্যান্টিবায়োটিক পালটে আরও জোরালো একটা অ্যান্টিবায়োটিক চালু করে। রক্তের সংক্রমণ একদিন একটু কমে আসে। পরেরদিনই আবার জীবাণুরা দ্বিগুণ উদ্যমে লোকটার শরীরে থাবা বসায়।
আরও পড়ুন-অ-রূপোকথা
এরকমই হবার কথা। এরকমই হয়। মফসসলের এই নার্সিংহোমে শুক্লার অনেকদিন চাকরি হয়ে গেল। অভিজ্ঞতা কম হল না। সে জানে, বয়সটা একটা বড় ফ্যাক্টর। তিরাশি-বছর বয়সে শরীরের নিজস্ব রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রায় শূন্যে গিয়ে দাঁড়ায়, তাই কোনও ওষুধই আর কাজ করে না।
পেশেন্ট বললে পেশেন্ট। আবার নীতুকাকা বললে নীতুকাকা।
শুক্লা তো এই শহরেরই মেয়ে। এখানে যারা চিকিৎসার জন্যে আসে তাদের প্রায় সবাই তার মুখচেনা। অনেকের নামও জানে। পরিচয়ও থাকে অনেকের সঙ্গে। কেউ তার স্কুলের প্রাক্তন হেডমিস্ট্রেস, কেউ একসময় পথসভায় দাপুটে গলায় বক্তৃতা দিতেন। খুব ছোটবেলায় যে তরতাজা যুবককে গাঢ় সবুজ বর্ডার দেওয়া ভি-কলারের ঘিয়ে রঙের সোয়েটার আর সাদা শার্ট-প্যান্ট পরে পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলতে দেখেছে, তাকে হুইল-চেয়ারে বসিয়ে এক্সরে ইউনিটের দিকে নিয়ে যেতে-যেতে শুক্লা মনে-মনে ভাবে, দিন কীভাবে বদলায়! সময় কীভাবে মানুষের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেয়!
নীতুকাকার কাছ থেকে অবশ্য ওর শারীরিক সুস্থতা ছাড়া কেড়ে নেওয়ার মতন আর বেশি কিছু ছিল না।
প্রতিটি মফসসল শহরে কিছু পাগল থাকে, কিছু গায়ক। দুয়েকজন ধর্মের লাইনে চলে যায়। কয়েকজন কবিতার কাগজ বার করে। সেরকমই কয়েকজন ব্যাচেলরও থাকে, যারা একটা বয়স অবধি বেশ অ্যাকটিভ লাইফ কাটায়। নতুন করে একটা দুর্গাপুজো শুরু করে, লাইব্রেরিতে বসে সারা সন্ধে বই ইস্যু করে, বাচ্চাদের গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে সাঁতার শেখায়।
নীতুকাকা ছিল এরকমই এক ব্যাচেলর। এরকমই এক সোশ্যাল-ওয়ার্কার। কিন্তু এরা একটা সময়ের পর থেকে বড় একলা, বড় নিঃসঙ্গ হতে শুরু করে দেয়।
শুক্লা ছোটবেলায় নীতুকাকার সঙ্গে সাঁতার শিখতে গেছে। নীতুকাকার ঘরে বসে গরমের ছুটিতে সারা দুপুর ধরে বাঁধানো ইন্দ্রজাল কমিকস পড়েছে। পাড়ার পুজোয় নীতুকাকাকে ধুতির ওপরে নতুন গামছা জড়িয়ে ভোগের খিচুড়ি রাঁধতে দেখেছে বলেও যেন আবছা মনে পড়ে তার।
তবে এসব অনেক বছর আগের স্মৃতি। শুক্লার বয়স হল এখন পঁয়ত্রিশ। তার মানে নিশ্চয়ই পঁচিশ বছরের পুরনো স্মৃতি এগুলো। নীতুকাকার সাম্প্রতিক ছবিগুলো কিন্তু দারিদ্র আর বার্ধক্যের। বাড়ির রোয়াকে দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে নীতুকাকার বসে থাকার ছবি। একটা ঢোলা পাজামা, গায়ে একটাই নীলরঙের পুরনো ফতুয়া। তখন সামনে দিয়ে যে-ই যেত, নীতুকাকা তাকেই ডাকাডাকি করত। শুক্লাকেও ডাকত। কোথায় যাচ্ছিস বুড়িমা? দাদা-বউদি কেমন আছে রে? বিয়ে করবি কবে?
শুক্লা মুচকি হেসে চলে যেত। সকলেই চলে যেত। কারই বা বুড়োমানুষের সঙ্গে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে গল্প করার সময় থাকে আজকাল? কিছুদিন বাদে ডাকাডাকি থেমে গেল। পিঠ সোজা রেখে বসার ভঙ্গিটাও বদলে গেল নীতুকাকার। ভাঁজকরা হাঁটুদুটো উঠে এল বুকের কাছে, মাথা ঝুঁকে পড়ল নীচে। এমনকী শীতকালেও মাথায় একটা মাঙ্কিক্যাপ আর গায়ে চাদর জড়িয়ে রাত প্রায় আটটা-ন’টা অবধি ওইভাবে ওই রোয়াকেই চুপ করে বসে থাকত নীতুকাকা।
বেডপ্যানটা পাল্টে দিতে-দিতে শুক্লা মনে করার চেষ্টা করল, ঠিক কতদিন আগে নীতুকাকার ভাইপো বাবলা ওদের ওই রোয়াক আর সামনের ঘরটাকে ভেঙে কোচিং-সেন্টার চালু করল। পাঁচবছর? হ্যাঁ, পাঁচবছর তো হবেই। তখন থেকেই নীতুকাকাকে ও আর দেখতে পায়নি। ছিল নিশ্চয়ই কোনও ভেতরের ঘরে পড়ে। আজ শেষ অবস্থা বলে ওর ভাইপো এখানে ভর্তি করে দিয়ে গেছে। সেইজন্যেই নীতুকাকাকে আবার ও দেখতে পাচ্ছে।
নীতুকাকা বললে নীতুকাকা। পেশেন্ট বললে পেশেন্ট।
পাড়ার লোকেরা যখন ‘পেশেন্ট-পার্টি’ হয়ে যায় তখন তাদের যেভাবে দাঁতনখ বেরিয়ে আসে, তা স্বচক্ষে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। শুক্লা সেইজন্যে ইচ্ছে করেই ডিউটির সময় মুখটা পাথরের মতন করে রাখে। সে যে কাউকে চিনতে পেরেছে পারতপক্ষে এরকম ভাব দেখায় না।
তবু গত কয়েকদিনে তার সেই পাথুরে মুখোশ বারবার কেন যেন খসে পড়তে চাইছে। এই যে লম্বা রোগা জীর্ণ শরীরটা বিছানার সঙ্গে মিশে আছে, এই যে তার গায়ের রংটা ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে, গালের দাড়ি, আঙুলের নখ বনবন করে বেড়ে চলেছে, এই পেশেন্টের বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালেই তার পা দুটো মাটিতে গেঁথে যাচ্ছে। নড়তে ইচ্ছে করছে না। এই লোকটার কাছ থেকে বালিকাবয়সে শুক্লা যত আদর পেয়েছিল সব তার মনে পড়ে যাচ্ছে।
দু’দিন আগে অবধিও নীতুকাকার কিছুটা চেতনা ছিল। ওর ভাইপো বাবলাকে খুঁজছিল। জিজ্ঞেস করছিল ও কোথায়।
প্রশ্নটা তো শুক্লারও। বাবলা বা ওর বউ কাকাকে দেখতে আসছে না কেন? গত তিনদিনে নীতুকাকার জন্যে একটিও ভিজিটর আসেনি, এটা কেমন কথা! তাই চতুর্থদিন সকালে নাইট ডিউটির শেষে বাড়ি ফেরার সময় শুক্লা একবার দোতলায় পেমেন্ট-কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল ব্যাপারটা কী।
শ্রাবণী নামে মেয়েটা তখন ডিউটিতে ছিল। শুক্লার প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসে বলল, সিঙ্গাপুর না মালয়েশিয়া কোথায় যেন ঘুরতে গেছে। বেড়ানোটা যাতে মাটি না হয়, সেইজন্যেই জ্বর এসেছে বুঝতে পেরেই কাকাকে এখানে ভর্তি করে দিয়ে গেছে। ফোনে যোগাযোগ রাখছে। যখন যেমন বিল হচ্ছে পেমেন্টও করে দিচ্ছে অনলাইনে। আমাদের আর কীসের অসুবিধে?
চতুর্থদিন থেকেই নীতুকাকা স্টুপরে চলে গেল, মানে ইনফেকশনের ঘোর। পেশেন্টের পাশে বসার সময় থাকে না শুক্লার। তবু মাঝেমাঝে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সে শুনবার চেষ্টা করে ঘোরের মধ্যে কী বলে নীতুকাকা। একসময় তো অনেক রকমের অ্যাক্টিভিটিই ছিল মানুষটার। এই-শহরের ছোট-বড় অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তাদের কারুর কথা কি বলবে এখন? মনে পড়বে কি গঙ্গায় সাঁতারের কথা, লাইব্রেরির কথা?
শুক্লাকে যে চিনতে পারছে না, সেটা শুক্লা প্রথমদিনেই বুঝে গেছে। কিন্তু অন্য কারুর কথা? তিরাশি বছরের দীর্ঘ একটা জীবনকে বিদায় জানিয়ে চলে যাওয়ার সময় কারুর মুখ মনে পড়বে না?
না, মানুষ নয়। ঘোরের মধ্যে নীতুকাকা বারবার একটা বাড়ির কথাই বলে যায়। বলে আমার বাড়িটা শেষ হল না। হ্যাঁ, একটা বাড়ির কথাই বারবার বলে যায় নীতুকাকা। নীতুকাকার স্বপ্নের মধ্যে একটা ছোট একতলা বাড়ি তৈরি হচ্ছে, দেখতে পায় শুক্লা।
সেই বাড়ির নাকি সামনে গ্রিলে-ঘেরা বারান্দা, পেছনে পুকুর। পুকুরের ঘাটে নাকি কাঁসা-পেতলের থালা বাসন ডুবিয়ে রাখা আছে। নিস্তব্ধ দুপুরে এঁটো ভাত তরকারি খুঁটে খেতে আসে পুঁটিমাছের ঝাঁক। পাড়ের তেঁতুলগাছের ডালে বসে খরদৃষ্টিতে তাদের লক্ষ্য করে এক মাছরাঙা। মাঝেমাঝে ঝুপ করে ডানা মুড়ে ছোঁ মারে মাছের ঝাঁকের মাঝখানে। জলের বলয় প্রসারিত হয়। জলের বলয় সঙ্কুচিত হয়ে আবার লুকিয়ে পড়ে নাকফুলের বনে।
কলমিবনে ডাহুক ডাকে। বাঁশের বেড়ার নীচে গোলাপি নাক তুলে ঘুরে বেড়ায় বেজিদের পরিবার। ওরা আছে বলেই নাকি নীতুকাকার বাড়িতে সাপের ভয় নেই।
আরও পড়ুন-গঙ্গাসাগরেই এবার কেদারনাথ দর্শন
আর কী বলে নীতুকাকা?
বলে সামনের সেই রেলিং-ঘেরা বারান্দায় দুটো-তিনটে শ্রীনিকেতনের মোড়া পাতা আছে। কিন্তু বৃষ্টি আসছে। মোড়াগুলো এইবেলা ঘরে তুলে না রাখলে বৃষ্টির ছাটে ভিজে যাবে। শুক্লা আশা করে, এইবার নিশ্চয় নীতুকাকা তেমন কাউকে নাম ধরে ডাকবে। বলবে মোড়াগুলো তুলে রাখো। কিন্তু কোনও ডাক ওঠে না নীতুকাকার গলায়। না ওঠারই তো কথা। বাড়ি তো ছিল না বাস্তবে। ঘর ছিল না, ঘরনিও নয়। তাহলে কাকে ডেকে বলবে, বৃষ্টি আসছে, জামাকাপড় তুলে রাখো।
কিন্তু তাহলে বাড়িটাই বা কেমন করে এল? অনেক বছর ধরে নীতুকাকার স্বপ্নের মধ্যেই ছিল নাকি বাড়িটা?
জেনারেল-ওয়ার্ড থেকে নার্সিংহোমের একফালি বারান্দায় বেরিয়ে আসে শুক্লা। চোখ তুলে দেখে ভাদ্রের চামড়া-পোড়ানো রোদে জ্বলছে অনন্ত ফ্ল্যাটবাড়ির মাথা। চোখ নামিয়ে দেখে নার্সিংহোমের নীচের সরু রাস্তাটা ধরে অটো-টোটো-রিকশার গাদাগাদি ভিড়। এরমধ্যে কোথায় সেই মেঘলা আকাশের নীচে একতলা বাড়ি?
নীতুকাকা বলে, বাড়ির সামনে একটা লাল রঙ্গনের গাছ লাগিয়েছি। আর তারই সঙ্গে একটা কামিনী। বলে, বড় হলে দুজনে একসঙ্গে ফুল ফোটাবে।
বিকেলের দিকে ব্লাড-রিপোর্ট আসে। সন্ধের রাউন্ডে এসে সেই রিপোর্ট দেখে ডাক্তার সামন্ত হাত ওলটান। বলেন, বাড়ির লোকেদের খবর দিন সিস্টার। দি এন্ড ইজ নিয়ার।
শুক্লা বলে কফটা যদি তুলে দেওয়া যেত। বুকের ঘড়ঘড়ানিটা…।
ডাক্তারবাবু বলেন, লাভ নেই।
তবু রাতের দিকে শুক্লা নিজেই পাম্প দিয়ে নীতুকাকার বুকের কফ তুলে দেয়।
একবার… শেষবার নীতুকাকা বেশ পরিষ্কার গলায় বলে ওঠে, বাড়ি যাব। তারপর কয়েকটা হেঁচকি তুলে চুপ করে যায়। মাথাটা বালিশের পাশে গড়িয়ে পড়ে। শুক্লা হাত বুলিয়ে নীতুকাকার চোখের পাতাদুটো বুজিয়ে দেয়।
পরদিন সকালে ম্যানেজারবাবু বলেন, সিস্টার! ডেডবডিটা রেডি করে দিন। ওনার রিলেটিভরা বলেছেন, একদিন পিস হ্যাভেনে বডি রাখতে হবে। ওনারা পরশু ফিরবেন, তখন ক্রিমেশন হবে।
শুক্লা ভাবে, তার মানে নীতুকাকার আর বাড়ি যাওয়া হবে না। শ্মশানের লাগোয়াই তো পিস হ্যাভেন। এখান থেকেই সোজা সেই ঠান্ডা আলমারিতে গিয়ে শুয়ে পড়বে নীতুকাকা। আবার সেই আলমারি থেকেই পাশের ইলেকট্রিক চুল্লিতে।
শুক্লা কী ভেবে ওর বরকে ফোন করে। বলে একবার এসো তো।
কেন? জিজ্ঞেস করে ওর বর, তাপস।
শুক্লা উত্তর দেয়, পিস হ্যাভেনে একটা ডেডবডি নিয়ে যাচ্ছি। মাঝখানে একবার আমাদের বাড়িতে নামাব। কিছুক্ষণ শুইয়ে রাখব আমাদের বাগানে।
আরও পড়ুন-মা-কে খুন করে গ্রেফতার ছেলে
কেন? আরও অবাক গলায় প্রশ্ন করে তাপস।
শুক্লা বলতে চায়, কারণ, আমাদের গেট দিয়ে ঢুকে একটা কামিনী গাছ আছে। এখন ফুল ফুটছে গাছটায়। রঙ্গন গাছও আছে। অনেক বছর আগে নীতুকাকা ওই চারাদুটো আমাকে দিয়েছিল। আমি ওই গাছদুটোর ছায়ায় নীতুকাকাকে কিছুক্ষণ শুইয়ে রাখব। তারপর ওরা নিয়ে যাক যেখানে ইচ্ছে।
কিন্তু কান্নায় গলা বুজে আসে বলে বলতে পারে না।
অঙ্কন : শংকর বসাক