পদ্ম গোখরো

ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে দাঁড়াল এরিনা। সব কিছু একই রকম আছে,তা নয়। একই রকম থাকে না। তবু, এই গ্রামের গন্ধ বুকে নিয়েই তো রোজ ঘুমোতে যায়

Must read

সাগরিকা রায়
ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে দাঁড়াল এরিনা। সব কিছু একই রকম আছে,তা নয়। একই রকম থাকে না। তবু, এই গ্রামের গন্ধ বুকে নিয়েই তো রোজ ঘুমোতে যায়। নইলে বিদেশ বিভুঁইয়ে কে আর আপন ওর?
বছরে দুবার আসত আগে। গত দুটো বছর ধরে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় বছরে একবার আসতে পারে বাড়িতে। মা অনুযোগ করে অবশ্য। এই অনুযোগই এরিনার কাছে আদরের সমতুল্য।
এক বছরে সোনাছায়া গ্রাম অনেকটা বদলেছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয়েছে। কলেজ হবে বলে শুনেছিল গতবছর। হয়তো এদ্দিনে কাজ এগিয়েছে অনেকটা।
হলেই বা! প্রাইমারি ডিঙিয়ে পাশের গ্রামের স্কুলেই যেতে পেরেছে এরিনা? নেহাত হরিকাকা ওদের দুর্দশা দেখে একটা কাজের জোগাড় করে দিয়েছিল কলকাতায়। বড়লোকের বাড়ি। সাফসুতরো করে রাখতে হবে। বছরে দুবার বাড়ি আসতে পারবে।
সেখান থেকে সোজা দিল্লিতে। যাঁর বাড়িতে কাজে ঢুকেছিল,তাঁদের বোনের বাড়ি দিল্লিতে। তাঁদের বড্ড পছন্দ হল এরিনার কাজকর্ম। দ্রুত প্রমোশন পেয়ে দিল্লিতে কাজে জয়েন করল এরিনা। এখন, বছরে একবার ছুটি পায়। হাতে টাকা আসছে। মাইনেপত্র ভাল। ছোটখাটো টিপস মেলে। ভালই তো!
এরিনা গ্রামের সবুজের দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে গন্ধ নিল। কতদিন পরেই না এল! ওকে কি অশ্বত্থতলা ভুলে গিয়েছে? এখন গ্রামে অনেক রকম লোক ঢুকেছে। ধাবা হয়েছে গ্রামের খানিক দূরের মেইন রোডের ধারে। নিত্যনতুন লোকের যাতায়াত চলে। গ্রামের স্বভাবও পালটে যাবে আস্তে আস্তে!
পা বাড়িয়ে পশ্চিমের রাস্তা ধরল এরিনা। এখন স্টেশন থেকে রিকশ পাওয়া যায়। কিন্তু হেঁটে গেলে গ্রামকে একটু তো দেখতে পাবে! সমস্ত ছেলেবেলা হইহই করে ওঠে ওকে দেখলে। বুনো কুলের ঝোপ থেকে টুনটুনি পাখি ডেকে বলে, ‘এলি?’
এরিনা পাখিটাকে বাঁচিয়েছিল বেড়ালের হাত থেকে। সে কবেকার কথা! তখন এরিনা ছয়। অথচ এই যে রাস্তাটা ধানখেতের পাশ দিয়ে গিয়ে রাস্তায় উঠে একটা কুলগাছের বংশের আওতায় পড়ে, সেখানেই নন্দীদের বেড়াল পাতলু টুনটুনিকে ধরেছিল। এরিনা বেড়ালের মুখ থেকে বাঁচিয়েছিল পাখিটিকে। এখনও টুনটুনি এরিনাকে দেখলেই ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে কুশল জিজ্ঞাসা করে।
এরিনা কি জানে না যে সেই ছয় এখন তেইশে দাঁড়িয়েছে? টুনটুনি কি এতদিন বেঁচে থাকে? কিন্তু, মনের ভিতরে যে ছবি সাজানো থাকে, সেখানে তুমি ছাড়া আর কেউ তাকে মেরে ফেলতে পারে না। তাই আজও টুনটুনি বুকের ভিতরের সেই ৬ বছর আগের কুলঝোপ থেকে বেরিয়ে আসে!
এরিনা ধানখেতের মাটির বড় বড় ঢেলাগুলোকে দেখে পা ফেলছিল। বেখেয়ালেই ছিল খানিকটা। তাই, সাপটা ইলিবিলি কেটে কেটে ওর খানিক দূরত্বে যে যাচ্ছে, দেখেনি। সব দেখা যায় না। এরিনা জানে। সব দেখতে গেলে মা খেতে পাবে না। ওদের ছোট্ট বাড়িতে ইলেক্ট্রিক আসত না। খুব গরমের দিনে মাথার ওপরে দামি ফ্যানের বাতাস পেত না ভাই। আর টুরটুরি? সে পড়াশোনা করছে। বয়ফ্রেন্ডও আছে। সে নাকি একদিন বকখালি বেড়াতে নিয়ে যাবে টুরটুরিকে।
আরও পড়ুন-অ-রূপোকথা
সুখী মুখে ক্রিম ঘষে যখন হাসে টুরটুরি, এরিনার মন ভাল হয়ে যায়। ভুলে যায় অনেক কথা। দুঃখ বড় খারাপ জিনিস। তাকে পাত্তা দেওয়ার বিশেষ কিছু নেই।
শরৎ শেষ হয়ে হেমন্তের বাতাসের হিম হিম ভাব টের পাচ্ছে এরিনা। এবারে পুজো বড্ড দেরিতে। আজ ষষ্ঠী। এবারেও কি গ্রামে দুটো পুজোই হবে? পুজো এলেই জামাকাপড় কেনে এরিনা। ভাই-বোনকে নিয়ে দোকানে যায়। আসার সময় বিরিয়ানি নিয়ে আসে। মা নতুন শাড়ি পেয়ে হাসে। কতকাল আগে ইটভাটায় কাজ করতে যাওয়া বাবা নবীন মণ্ডলের নিরুদ্দেশ হওয়ার কষ্ট খানিকটা ভুলে যায় সেদিন মা।
 পা বাড়াতে যেতেই সাপটাকে দেখে ফেলল এরিনা। সরু সাপ। পিঠে খয়েরি লম্বা দাগ। মাথা ঘুরিয়ে এরিনাকে দেখে থেমে গেল। এক জায়গায় গুটিয়ে রইল। কিন্তু কালো কুচকুচে বড় বড়  চোখ এরিনার দিকে আটকে রইল। ভাবটা এমন যেন, ‘তোকে কিন্তু ছাড়ছি না!’
এরিনার ভয় করছিল। সাপটা কি এরিনাকে কামড়ে দেবে বলে অপেক্ষা করে আছে? কী চায়?
 পা বাড়াতে ভয় করছে এরিনার। কেউ এদিকে আসছে না কেন! সেদিন বেড়ালের হাত থেকে টুনটুনিকে না বাঁচালে টুনটুনিও এরকম ভয় পাচ্ছিল! নিজেকে দিয়ে অন্যের অনুভূতি টের পাওয়ার ক্ষণ অনেক পরে আসে হয়তো!
‘এরিনা, না?’
চমকে উঠেছে এরিনা। এখানে ‘এরিনা’ বলে কে ডাকছে ওকে? নামটা ওর গায়ের কামিজের মতো আটকে আছে বলে নিজেও ভুলে যায় এই নাম ওর নয়।  এটা ওকে দেওয়া হয়েছে। গ্রামে কে জেনে ফেলেছে ‘এরিনা’ নামটা? দিল্লির পরিচয় এখানে কী করে এসে পৌঁছল?
সাপটা এখনও এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। এরিনা নড়তে পারছিল না। কিন্তু ধানখেতের মাটি কাঁপছে কার পায়ের শব্দে। সে এসে হেসে বলল, ‘তুমি এখানে? নতুন কাস্টমার নিয়ে এসেছে নাকি?’
এরিনা দেখল, লম্বা, রোগা, গাল চুপসে যাওয়া, প্রিন্টেড সিন্থেটিক গেঞ্জি পরা লোকটির মুখে অশ্লীল হাসি, ‘এখানে কোথায়? ধাবায়?’
এরিনা বুঝতে পারছে, আজ সব দেওয়াল ভেঙে পড়বে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুজোর ঢাক থেমে যাবে। এরিনার ভাই, বোন, মা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকবে। টুরটুরির বয়ফ্রেন্ড খুব জোরে হেঁটে চলে যাবে অন্য কারও সঙ্গে বকখালি দেখতে!
লোকটি বলল, ‘তুমি আমাকে চিনতে পারনি? চারদিন গিয়েছি। মোটা টিপস দিয়েছি। এরই মধ্যে ভুলে গেলে চলবে না! ধাবা থেকে একদিন ফুড়ুত করে বেরিয়ে আমার সঙ্গে চল। ট্রাক নিয়ে যাচ্ছি ডায়মন্ড। দুদিন হোটেলে থাকব আর মস্তি।’
এরিনা জানে, আর কিছুটা সময়। তারপরে এই গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে ওর। পুজোর আলো, নারকেল নাড়ু পাক দেওয়া, মা, বোনের হাসি…সব হারিয়ে যাবে। থাকবে শুধু নিকষ অন্ধকারে এক চামুণ্ডা। তার কেউ নেই। আলো নেই। ভালবাসা নেই। অতল অন্ধকারে ঠেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ওরা ওকে। ওদের ইচ্ছের কাছে বারবার হেরে ভূত হয়ে যাচ্ছে কুসুম। এরিনা এসে কেন হারিয়ে দিচ্ছে কুসুমকে! কে চেয়েছিল বড়লোকের বাড়ির চাকরি! কে দিল্লিতে গিয়ে পাপ ব্যবসায় নামতে চেয়েছে? কে ওকে এরিনা নাম দিয়েছে? ওরা! চাকরির টোপ ফেলে নীল ছবি করিয়েছে। বিজনেসের সুবিধের জন্য পার্টির কাছে পাঠিয়েছে! কলকাতার বড়লোক, তার বোন, সকলের একই চেইন। এরিনা সেখানে জাস্ট ঢোঁড়া সাপ! বিষ নেই।
এরিনা খেতের কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকা সাপটিকে দেখল। সাপ চোখের পাতা ফেলল। এরিনা এই অবস্থাতেও অবাক হয়ে গেল। সাপের চোখে পাতা আছে? মানে, সাপেরও হায়া লজ্জা আছে? অথচ এই লোকগুলো সবকিছু পুড়িয়ে কালো করে দেয় কী করে? এদের চোখে তো পাতা দেখা যাচ্ছে!
মুহূর্ত ভেবেছে এরিনা।  সব যখন পুড়ে একরাশ ছাই হতেই যাচ্ছে, আর ভয় কীসের? ও ঝুঁকে পড়ে সাপটিকে তুলে নিল এক ঝটকায়। তুলেই ছুঁড়ে দিল লোকটির গায়ের ওপরে। লোকটি চমকে ত্রাসে চেঁচাতে গিয়ে হ্যাহ হ্যাহ করে হাসতে লাগল, ‘শালা, ভয় দেখাও? ভয় পেয়েছিস,তাই না? ঢোঁড়া কি আমাকে কামড়ে দেবে? মাগীবাজি করিস, জানিস না ঢোঁড়ার বিষ নেই?’
এরিনা চোখ বন্ধ করেনি। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, ঢোঁড়া আস্তে আস্তে গলা জড়িয়ে ধরেছে পরম আদরে। পিষ্ট করছে। লোকটি বিস্ফারিত চোখে এরিনাকে দেখছে। কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।
আস্তে আস্তে ধানের খেতে লোকটির নিস্পন্দ শরীরটিকে শুইয়ে দিয়েছে কুসুম। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে চারপাশ দেখে হাঁটতে যাচ্ছে, সাপটি পাশে পাশে যাচ্ছিল। সিলিক সিলিক করে সে, ‘আর যাসনে। এখানেই থেকে যা কুসুম হয়ে। অনেক তো হল রে! কখন বেড়াল আসে, কখন টুনটুনি মরে যায়, তার ঠিক আছে কিছু? কে বাঁচায়, বল দেখি?’
কুসুম পুকুরের পাড়ে গিয়ে জলে নামে। সাপ জলে নেমে শরীর ভিজিয়ে পাপ ধুয়ে নিচ্ছে। ভেজা শরীর বিকেলের বাতাসে শিরশির করে। হেমন্তের ধান হেঁকে বলে, ‘যাও গো মেয়ে, বেলা গেল। দুটো মুখে দাও।’
ভেজা পোশাকে বাড়িতে ঢুকছে কুসুম। মা বলল, ‘এই দেখ, অসময়ে কেউ নাইতে নামে? শুকনো পোশাক পরে নে। আগের জামাকাপড়গুলো দেখ, গোছানোই আছে।’
পুরনো কুসুম মাকে জড়িয়ে রাতে ঘুমোতে যায়। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, ‘এবারে কতদিন থাকবি? টুরটুরির বিয়েটা দেব। টাকা পয়সা জোগাড় করতে হবে,মনে রাখিস।’
ঢোঁড়াটা বারবার ওকে জাপটে ধরতে চাইছিল, কিন্তু কুসুম জোর করে সরিয়ে দিল ঢোঁড়াকে, ‘চাকরি ছেড়ে দিয়েছি মা। এখানেই  একটা স্টেশনারি দোকান দেব। ওতেই হবে সব।’
মা অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ত্রাসে কেঁপে উঠেছে, কিন্তু কুসুম সপ্তমীর ঢাক শুনতে পাচ্ছে যে! ঢোঁড়ার মাথায় পদ্মর ছাপ দেখা দিয়েছে। ঢোঁড়া মুচকি হাসে, ‘পদ্মগোখরো হয়েছি। এসে দেখ।’
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article