প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের ১৮ তারিখে পালিত হয় সংখ্যালঘু অধিকার দিবস। ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রসংঘ সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করতে এই বিশেষ দিনটিকে স্বীকৃতি দেয়। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশ নিজের ভূখণ্ডের সীমার মধ্যে ধর্মীয়, ভাষাগত, জনগোষ্ঠীগত, সংস্কৃতিগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থকে রক্ষা করবে এবং তাদের পরিচিতির প্রকাশ ও উন্নয়ন ঘটাতে উৎসাহ দান করবে। রাষ্ট্রসংঘ তার মানবাধিকার সনদের ৩০ নম্বর ধারায় এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তির ২৭ নম্বর ধারায় ধর্মীয়, ভাষাগত, জাতিগোষ্ঠীগত ও সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘু জনগণের অধিকারের বিষয়টিকে নিশ্চিত করার কথা বলেছে।
আরও পড়ুন-তিনটি ছোটদের পত্রিকা
রাষ্ট্রসংঘের এমন ঘোষণায় সংখ্যালঘুদের জীবনের চালচিত্রে কোনও পরিবর্তন আসেনি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র ভারত। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও নৃতাত্ত্বিক বিভিন্নতায় বিশ্বে এ-দেশ অন্যন্য। স্মরণাতীতকাল থেকে এমন বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যকে যেভাবে ভারত ধরে রেখেছিল তা সত্যিই চর্চার বিষয়। যারা বাইরে থেকে এসেছিল তারাও এই মাটির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিল। সে-কারণেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
এসো হে আর্য, এসো অনার্য,
হিন্দু মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,
এসো এসো খৃস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মন
ধরো হাত সবাকার,
এসো হে পতিত করো অপনীত
সব অপমানভার।
আরও পড়ুন-আপনারাই ঠিক করুন প্রার্থী : অভিষেক
ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ লিখেছেন, মহাত্মা গান্ধী ১৯৪৮ সালের ১৪ জানুয়ারি ‘গুজরাতিদের উদ্দেশ্যে’ একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে ছিল— ‘সকল হিন্দু, মুসলিম, শিখ, পার্সি, খ্রিস্টান এবং ইহুদি যারা এই দেশের মানুষ, তাদের প্রত্যেকের সমান অধিকার আছে। কেউ বলতে পারবে না যে এই দেশ শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠদের। কেউ বলতে পারে না এখানে সংখ্যালঘুদের অসম্মান করা উচিত।’
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে। ধুমধাম করে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন হচ্ছে একদিকে, অন্যদিকে অস্তিত্বের সংকটে ভুগতে হচ্ছে দেশের বহু সংখ্যালঘুকে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তো বটেই সংখ্যাগুরু আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি। যা ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক। জোর করে ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দিলে তার ফল যে কী মারাত্মক হতে পারে, তা আমাদের পড়শি বাংলাদেশের দিকে তাকালেই স্পষ্ট। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের ধর্ম এক ছিল। কিন্তু পৃথক ছিল ভাষা ও সংস্কৃতি। পাকিস্তানে মুসলিমরা সংখ্যাগুরু। তারপরও সেখানে শিয়া, হাজেরা ও আহমদিয়াদের ওপর অত্যাচার নতুন ঘটনা নয়। অথচ প্রত্যেকেই নিজেদের মুসলিম বলেই পরিচয় দেয়। ধর্ম এখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ।
আরও পড়ুন-ব্যবস্থাপনায় খুশি শাহ, মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে দফতরে
এদেশেও একটা ‘হিন্দি ও হিন্দু’ নির্ভর সংখ্যাগরিষ্ঠ সুপ্রিমেসি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। ‘হিন্দি, হিন্দু ও হিন্দুস্তানকে’ সামনে রেখে গেরুয়া আস্ফালন বাড়ছে দিন দিন। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছাড়াও সমস্ত সংখ্যালঘু কেন্দ্রীয় শাসক দলের মেশিনারির কাছে দিন দিন অসহায় বোধ করছে। কোণঠাসা হচ্ছে দেশপ্রেমের ধারণা। পরিকল্পিতভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদ-নির্ভর রাজনীতি হচ্ছে। শাসক দলের কোনও নেতার মন্তব্যের বিরোধিতাকেও দেশদ্রোহ বলে প্রচার করেছে গদি মিডিয়া। সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলতে পারা মিডিয়াগুলোও দিন দিন সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে। তাদের ওপরও চলছে আগ্রাসন। প্রথমে ধমকি, তারপর প্রলোভন, তা না হলে জোর করে অধিগ্রহণ। তাই আজকের দিনে সংখ্যালঘু অধিকার দিবসে ভাষাগত, জনগোষ্ঠীগত, সংস্কৃতিগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি নির্ভিক ও সৎ মিডিয়ারও স্বার্থ সুরক্ষিত করার সময় এসেছে। আজকের দিনে তাদের অস্তিত্ব দলিত ও আদিবাসীদের মতোই বিপন্ন। মুসলিমদের মতোই অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে তারা।
ভারতে মহিলা, সংখ্যালঘু মুসলিম, নিম্নবর্ণের হিন্দু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন চাকরির বাজারে মারাত্মক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। একই অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পুরুষের তুলনায় কম বেতন পান মহিলারা। একইভাবে কম বেতন পান মুসলিম ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষজন। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফামের প্রতিবেদনে এমন তথ্য সামনে এসেছে।
আরও পড়ুন-নীতি আয়োগের কথা বলে আরতি কটন মিল বিক্রির চেষ্টা
অক্সফামের গবেষকরা জানিয়েছেন, প্রতি মাসে গড়ে পুরুষরা নারীদের তুলনায় চার হাজার টাকা বেশি আয় করেন। মুসলিমদের তুলনায় অমুসলিমরা সাত হাজার টাকা বেশি আয় করেন। নিম্নবর্ণ ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ অন্যদের তুলনায় পাঁচ হাজার টাকা কম আয় করেন। একই যোগ্যতা থাকলেও পরিচয় বা সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে কর্মীদের প্রতি ভিন্ন আচরণ করা হয়। অক্সফাম ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অমিতাভ বেহার অক্সফাম ইন্ডিয়াস ডিসক্রিমিনেশন রিপোর্ট ২০২২-এ নারীদের কম বেতনের জন্য সামাজিক পরিস্থিতি ও চাকরিদাতাদের মানসিকতাকে দায়ী করেছেন। ওই প্রতিবেদন আরও বলছে, চাকরির বাজারে অন্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
আরও পড়ুন-তাঁতশিল্পীদের নিয়ে অভিষেকের ভাবনা
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও তফসিলি জাতি ও উপজাতিরা রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরেই। সেখানে নতুন করে উচ্চবর্ণের আর্থিক দুর্বল শ্রেণির জন্য নিয়ে আসা হল সংরক্ষণ। কেন্দ্র চাইছিল উচ্চবর্ণকে খুশি করতে। মামলা গড়িয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। ২০২২-এর ৭ নভেম্বর, সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ ৩:২ সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে সংবিধানের ১০৩ তম সংশোধনীকে বজায় রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকাদের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। বিচারপতি মাহেশ্বরী, ত্রিবেদী ও পারদিওয়ালা তাঁদের পৃথক সহমত রায়ে জানিয়েছেন যে, এই সংশোধনী সাংবিধানিক ভাবে বৈধ। অন্য দিকে, বিচারপতি ভট্ট ও তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি ললিত এই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক মনে করেছেন— তাঁরা জানিয়েছেন যে, এই সংশোধনীটি বাতিল করা উচিত, কারণ তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে লঙ্ঘন করে। অনেকে বলেছেন যারা সংখ্যালঘু তোষণের বিরুদ্ধে গলা ফাটাতেন, তাঁরা সংখ্যাগুরু তোষণে নেমেছেন।
আরও পড়ুন-তারকেশ্বরে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মিসম্মেলনে ঘোষণা, প্রতি বুথের কর্মিদল ঘুরবে বাড়ি বাড়ি
দ্বিচারিতা দিয়ে দল চলতে পারে, দেশ চলে না। একদিকে গান্ধীর প্রচার, অন্যদিকে গোলওয়ালকারের নীতি রূপায়ণের যে কৌশল কেন্দ্রের শাসক দল নিয়েছে তা দেশের ঐক্যের জন্য চ্যালেঞ্জ সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে গরিষ্ঠ-লঘিষ্ঠ আপেক্ষিক শব্দ। গোবলয়-সহ উত্তর ভারতে যারা সংখ্যাগুরু তারাই উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশ কিছু রাজ্য ও কাশ্মীরে সংখ্যালঘু। ঘর ওয়াপসির আস্ফলন করে যারা ময়দানে নেমেছিল এখন তারাই ধর্মান্তরণ মামলায় খ্রিস্টান, মুসলিম ও বৌদ্ধদের ফাঁদে ফেলতে চাইছে। তাদের আইনি গেরোয় ফেলে সাজা দেওয়ার ছক কষছে। অথচ নিজের ধর্ম পালন, তার প্রচার ও প্রসারের অনুমতি দিয়েছে আমাদের সংবিধান।
আরও পড়ুন-লালনের শ্বশুরবাড়ি তদন্তে সিআইডি
দেশের বেশিরভাগ রাজনেতা ও নেত্রীরা আজকাল সংখ্যালঘুদের অধিকারের কথা বলতে চান না। যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলছে, তাতে গা ভাসতে চাইছে অনেক দল। ব্যতিক্রম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। মুসলিম হোক কিংবা খ্রিস্টান, শিখ হোক কিংবা বৌদ্ধ, জৈন হোক কিংবা হিন্দু— তিনি সকলের অধিকার রক্ষায় তৎপর। তিনি যেমন আজমিরে যান, তেমনই পুষ্করেও যান। এদেশের বৈচ্যিত্রের মধ্যে ঐক্যের মূল সুরটি ধরা পড়ে তাঁর রাজনীতিতে। আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় তিনি সদা তৎপর। তাই তো তিনি ‘জন দিদি’। কেবল বেদির উপর থেকে ভাষণ না দিয়ে ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়ান তিনি। মুসলিমদের পাশে যেমন দাঁড়িয়েছেন, তেমনই দাঁড়িয়েছেন আদিবাসীদের পাশে। তিনি বারবার বলেছেন ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। সকলের উৎসবে তিনি শরিক হয়ে এই বার্তা দিয়েছেন যে আমি তোমাদের বাড়ির মেয়ে। তাঁর এই রাজনৈতিক অভিব্যক্তি তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। বাংলার সংস্কৃতি রক্ষার জন্য তিনি যেমন সরব হয়েছেন, তেমনই সাম্প্রদায়িক অশান্তির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিয়েছেন।
আরও পড়ুন-জলঙ্গির কৃষক পাবেন বিনামূল্যে সেচের জল
নিজের সংস্কৃতি ও ভাষা ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার অধিকার সংখ্যালঘুদের আছে। সংবিধানের ২৯ নম্বর ধারায় ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারগুলি বর্ণিত রয়েছে। কিন্তু তারপরও বিচারের বাণী প্রায়ই নীরবে কাঁদে। মিলন ও ঐক্য ছাড়া এ দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
তাই তো জাতীয় সংগীতের যে অংশটি গাওয়া হয় না তাতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্ধু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা।
জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারত-ভাগ্য-বিধাতা
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে।