ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে জোড়াফুলের জয় হওয়ারই ছিল, হয়েছেও। তাতে বিষাদ বাজার পত্রিকা ও তার পৃষ্ঠপোষক দৃশ্যশ্রাব্য কুমন মাধ্যম বড়ই হতাশ। একই রকম হতাশা মিউ মিউ পরিবেশিত টক-শো, চ্যাঁচাও বাংলা-সহ একাধিক টিআরপি শিকারি চ্যানেলে। ময়দানে হাজির রাজভবনের ক্রুসেড যোদ্ধাও। নানাভাবে, পরিকল্পিত উপায়ে এঁরা সবাই লোডশেডিং অধিকারীর নাকানি-চোবানিকে আড়াল করে, জনগণের রায়ে গ্রাম-বাংলায় জোড়াফুলের পুনর্বিকাশকে কলুষিত ও অপদস্থ করতে ব্যস্ত।
আরও পড়ুন-গণদেবতার জয় : অভিষেক
আসল সত্যিটা এরা কেউ বলছে না, দেখাচ্ছে না, কিংবা বলতে বা দেখাতে চাইছে না।
তাই, তাই-ই, এবারের পঞ্চায়েতের ফলাফল থেকে উঠে আসা প্রকৃত উপাত্তের উপস্থাপনার দায় আমরাই নিলাম। বিশ্লেষণাত্মক এই আলোচনার বিষয়বস্তু কারও কারও শিরঃপীড়া, হৃদবৈকল্য এবং মানসিক অবসাদের কারণ হতে পারে। হওয়ার সম্ভাবনাই সমধিক। তজ্জন্য এই কলমচি এবং ‘জাগোবাংলা’ দায়ী নয়, সেটা গোড়াতেই বলে নেওয়া ভাল।
ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করলে তিনটি সত্য জলবৎ স্পষ্ট হয়ে যায়।
আরও পড়ুন-ফের খুচরো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি
এক, রাজ্যভাগের জন্য লাগাতার উসকানি দিয়ে চলেছে গেরুয়া শিবির। এজন্য তারা ক্রমাগত পশ্চিমবঙ্গ বিভাজনের বিষবীজ বপন করে চলছিল উত্তরবঙ্গে। কিন্তু গ্রাম- বাংলার রায়ে স্পষ্ট, তথাকথিত গেরুয়া গড়েও রাজ্যভাগের নোংরা রাজনীতি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য হিসেবে ঘোষণার জিগির তুলে গত লোকসভা, এমনকী বিধানসভা ভোটেও ফায়দা তুলেছিল বিজেপি। পঞ্চায়েত ভোটের রায় দেখিয়ে দিল, তাদের সেই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করেছেন উত্তরবঙ্গের মানুষ। তাঁরা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবকদের। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, উত্তর দিনাজপুর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে গত বিধানসভা ভোটের নিরিখে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার এক ধাক্কায় অনেকটা কমেছে। কোচবিহার জেলা পরিষদের ৩৪টির মধ্যে ৩২টি আসনে এবং দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলা পরিষদের সবক’টি আসনে জয়ী জোড়াফুল। ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে মা-মাটি-মানুষের দল। অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গে বঙ্গ বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার মোটামুটি ২৩ শতাংশের আশপাশে। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই অঞ্চলে বিজেপি প্রায় ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।
আরও পড়ুন-চরম অবনতি দিল্লির আইনশৃঙ্খলার, রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে মহিলার দেহাংশ
এই ফলাফল সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে উত্তরবঙ্গের মানুষ বিজেপির বাংলা ভাগের পরিকল্পনা রূপায়ণে অনাগ্রহী। রাজ্য ভাঙার ষড়যন্ত্র প্রত্যাখ্যান করেছে উত্তরবঙ্গ।
দুই, আদিবাসী অধ্যুষিত জঙ্গলমহলও মুখ ফিরিয়েছে পদ্মফুলের থেকে। তারও পছন্দ জোড়াফুল। পদ্মফুলের ওপর জঙ্গলমহলের মানুষের বিরক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের পালে বাতাস আনতে তৎপর হয়েছিল হাত-হাতুড়ি-কাস্তে তারার জগাই-মাধাইরা। তাদেরও কুপোকাত করে ছেড়েছেন জঙ্গলমহলের আদিবাসী সমাজ। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ঝাড়গ্রাম জেলার লালগড় গ্রাম পঞ্চায়েতের ৮৪ নম্বর আসনে এক দাপুটে সিপিএম নেতার বউমা কাস্তে হাতুড়ি তারার প্রার্থী ছিলেন। ৮ জুলাই, ভোটের দিনও এলাকার সিপিএমের তরফে জানানো হয়, নির্বাচন সেখানে শান্তিপূর্ণ হয়েছে এবং জয়ের বাপারে তারা আশাবাদী। আর ভোটের ফলে দেখা গেল জঙ্গলমহল ঢেকেছে ঘাসফুলে। এখন সিপিএমের নবীন-প্রবীণ সব কর্মীই, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে ডহরেশ্বর সেন, সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন, কোনও হিংসা, হানাহানি বা সন্ত্রাসের কাছে নয়, তাঁরা হেরেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মমতাময় স্পর্শের কাছে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার আর বিনামূল্যে গরিবগুর্বোদের চাল দেওয়ার মতো সরকারি প্রকল্পের কাছে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরে, একদা অতিবামদের গড়েও এবার সবুজ ঝড়। ২০১৮-তে কিন্তু ওইসব জায়গায় জোড়াফুল ফোটেনি। পদ্মচাষ হয়েছিল।
আরও পড়ুন-গোটা বিশ্বেই বাড়বে দারিদ্র, স্কুলছুট, লিঙ্গবৈষম্য
সেখানে এই ফলাফল বুঝিয়ে দিচ্ছে সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচি আর নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্পের কার্যকারিতা। হাতির হানার ভয়ে যখন জঙ্গলে ঢোকা যায় না, জঙ্গল থেকে উপার্জন বন্ধ, বন্ধ নদীর পাড় থেকে বালি তোলাও, তখন জঙ্গলমহলের দরিদ্র জনগণ তাঁদের বেঁচে থাকার উপায় পেয়েছেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে, আস্থা রাখার উপকরণ পেয়েছেন ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচিতে। আর তারই অনিবার্য পরিণামে জঙ্গলমহলে ঝরে পড়েছে পদ্মের পাপড়ি, হাত-হাতুড়ি-কাস্তে-তারা সবাই একে একে খসে পড়েছে। জঙ্গলমহল এবার কেবলই ঘাসফুলময়।
আরও পড়ুন-লাল সতর্কতা জরি হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে
তিন, দক্ষিণবঙ্গে মতুয়ারা এবং উত্তরবঙ্গে রাজবংশীরা আশীর্বাদ করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসকে। বিজেপির প্রতি তাঁদের ক্ষোভ স্পষ্ট হয়েছে এবারের জনাদেশে। উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ, বাগদা, গাইঘাটা এবং স্বরূপনগরের মতো মতুয়া সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে তৃণমূল কংগ্রেস ৫৩টির মধ্যে ৪৯টি পঞ্চায়েতে জয়যুক্ত হয়েছে। শান্তনু ঠাকুর নিজে যে ইছাপুর পঞ্চায়েতের ভোটার, সেখানেও বিজেপি হেরেছে। নদিয়া জেলার মতুয়া সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাসমূহ, যেমন রানাঘাটের ১ ও ২ নং ব্লক, সেখানেও তৃণমূল কংগ্রেসকে কমপক্ষে ১৪৬টি পঞ্চায়েত আসনে আশীর্বাদ করেছেন মানুষ। একইভাবে উত্তরবঙ্গের অন্তত তিনটি জেলায় রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ গেরুয়া পক্ষের ভাঁওতাবাজি অনুধাবন করে তৃণমূল কংগ্রেসের ললাটে জয়টীকা এঁকে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন-তোপ দেগে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং’ হল ‘বিজেপির উস্কানি কমিটি’
কোচবিহারের ২,৫০৭টি পঞ্চায়েতের আসনে রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুুষের উপস্থিতি চােখে পড়ার মতো। সেই নয়টি ব্লকেই প্রায় ৪ হাজার আসনে জিতেছে তৃণমূল কংগ্রেস। পদ্মঝুলিতে মোটে ৩৫০-এর কাছাকাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের আসন। এসব এলাকায় কত কথাই না বলেছিলেন বিজেপি সাংসদরা। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন হাইওয়ের, বিমানবন্দরের, রেল যোগাযোগের। তাতে বিশ্বাস করে গত লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে পদ্মশিবিরে ভোট দিয়েছিলেন রাজবংশীরা। কিন্তু তৃণমূলস্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনমুখী প্রকল্প কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, রূপায়িতও হয়েছে। আর তাই, রাজবংশী ভোটও এবার জোড়াফুলে।
আরও পড়ুন-নতুন ক্লাবের জার্সিতে সেরাটাই দেব : মেসি
এক শতাংশেরও কম বুথে হিংসার ঘটনাকে মূলধন করে লাগাতার প্রচার, রাজভবন-রাজ্যপালের অতি সক্রিয়তা, রাষ্ট্রপতি শাসনের জুজু, বাংলাভাগের উসকানি, একজিট পোলের হিসাব, দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদপত্রের একাংশে লাগাতার কুৎসা, কিছুই যে কাজে এল না। পূর্ব মেদিনীপুরের একটি ব্লকের নেতা হয়ে রইলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। তাই রাগে-দুঃখে- অভিমানে লোডশেডিং অধিকারী ফোঁস ফোঁস করছেন। তাঁর অতৃপ্ত আত্মার শান্তি কামনা করি। এবং মনে করিয়ে দিই, ২০২৪-এর লোকসভার পথ কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছে গ্রাম বাংলা। জয় বাংলা।