‘পটমঞ্জরী’ নিছক উপন্যাস নয়

বইয়ের নাম ‘পটমঞ্জরী’। লেখক অভীক সরকার। প্রচ্ছদ শিল্পী সুব্রত মাজি। প্রকাশক পত্রভারতী। মুদ্রিত মূল্য ৩৯৯ টাকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৭৫।

Must read

দেবু পণ্ডিত: বইয়ের নাম ‘পটমঞ্জরী’। লেখক অভীক সরকার। প্রচ্ছদ শিল্পী সুব্রত মাজি। প্রকাশক পত্রভারতী। মুদ্রিত মূল্য ৩৯৯ টাকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৭৫।
সব মিলিয়ে সুমুদ্রিত, সুনির্মিত, সুচারুভাবে অলংকৃত, সুবৃহৎ একটি গ্রন্থ।
‘পটমঞ্জরী’র পটভূমি ৭০০ খ্রিস্টাব্দ-উত্তর বাংলা। অর্থাৎ, চালচিত্রটি ইতিহাসের। কিন্তু ‘পটমঞ্জরী’ নিছক ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়।
‘পটমঞ্জরী’র প্রসৃতি জুড়ে রয়েছে রহস্য রোমাঞ্চ মাখানো শিহরন। ঘটনার ঘনঘটা। বুনোটে বুনোটে রৌশন রিরংসা। পরতে পরতে জিওল জিঘাংসা। তবু ‘পটমঞ্জরী’ নিছক থ্রিলার নয়।
‘পটমঞ্জরী’কে জাপটে রয়েছে প্রেম। ‘পটমঞ্জরী’তে লেপটে রয়েছে যৌনতা। শিথিল শীৎকার ছড়িয়ে ছিটিয়ে ‘পটমঞ্জরী’তে। তৎসত্ত্বেও ‘পটমঞ্জরী’ কোনও রগরগে প্রেমের কাহিনি নয়।

আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামের ভেটুরিয়ায় আহত কর্মীদের দেখে কর্মসূচি ঘোষণা কুণাল ঘোষের

‘পটমঞ্জরী’ তবে কী?
খানিকটা বুঝে নেওয়া যাক, ছিন্ন আখ্যানের আস্বাদে।
‘পটমঞ্জরী’তে বিধৃত ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দের এক বিচিত্র কাহিনি। পাটলিপুত্রের নালান্দা মহাবিহারে আয়োজিত হয়েছে এক গোপন সভা। মহাযোগী লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ সেই সভার আহ্ববায়ক। তাঁর কথার সুতো ধরে জানতে পারি সমকালের বঙ্গদেশে চলছে নৈরাজ্যের নর্তন, অনাচারের আখুটি। সেই নষ্টপ্রহর রচনা করেছেন এক উন্মাদ ও কামলোলুপ রানি ও তাঁর মন্ত্রণাদাতা ঐন্দ্রজালিক প্রকাশচন্দ্র। প্রতি পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় সেই রানির একটি করে নতুন যুবক চাই কামতৃষ্ণা চরিতার্থ করার জন্য। রাজ্যে ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে, যে যুবক পুরো একটা গোটা রাত রানির শরীরের চাহিদা মেটাতে পারবে, সে-ই হবে বাংলার পরবর্তী সম্রাট। রানিকে এবং সমগ্র রাজ্যটাকে একসঙ্গে পাওয়ার লোভে যুবকেরা দলে দলে রানির রাতবিলাসের সঙ্গী হতে এগিয়ে আসে। আর পরদিন সকালে রানির রাতসঙ্গী যুবকটির প্রাণহীন দেহ পাওয়া যায় রাজপ্রাসাদের পাঁচিলের বাইরে।

আরও পড়ুন-রাজ্যকে নিশানা করতে গিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে বিপাকে দিলীপ ঘোষ

আর প্রকাশচন্দ্র? ভারতের বৌদ্ধ ধর্মের বাড়বাড়ন্ত যাঁদের সহ্য হয় না, সেইসব তিব্বতী সামন্তদের সঙ্গে তাঁর দহরম মহরম। তিনি নিজে পিশাচসিদ্ধ পুরুষ। বয়স একশো পেরোলেও দেখে তাঁকে চল্লিশ-পঞ্চাশের বেশি বলে মনে হয় না। রানি স্বয়ং তাঁর পিশাচ সাধনার সঙ্গিনী, ভৈরবী। তিব্বতের পোন ধর্মের যাবতীয় অশ্লীল শরীরী সাধনপদ্ধতি তিনি সনাতন বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। বৌদ্ধধর্মের বিশুদ্ধ ধারায় তান্ত্রিক আচারের চোরস্রোত বইয়ে দিতে সমর্থ হয়েছেন। এমন এক শাস্ত্রাচার চালু করেছেন তিনি, যার বহিরঙ্গে মহাযান পন্থার কথা, অন্তরঙ্গে পোন ধর্মের নোংরামি ব্যভিচারী সংস্কার। এভাবে তিনি নষ্ট করে দিচ্ছেন বৌদ্ধ ধর্মের শুদ্ধ সত্তা, ঘুণ ধরিয়ে দিচ্ছেন বুদ্ধের প্রচারিত সদ্ধর্মের ভিতে। চারিত্রিক নির্মলতাকে আশ্রয় করে বিকশিত ধর্মকে ছেয়ে দিতে চাইছেন নষ্টামির আগাছা দিয়ে।

আরও পড়ুন-জেনারেল সেক্রেটারি কাপ ঘিরে তুমুল উদ্দীপনা নয়াগ্রামে, লোকসভা ভোটে ঝাড়গ্রাম জয়ের বার্তা

অপচীয়মান ধর্মধারা। সমান্তরালে প্রবহমান ক্ষীয়মাণ আর্থ–সামাজিক স্রোত। দরিদ্র কৃষক আর অন্ত্যজ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন। বুভুক্ষাকে জীবনের অনিবার্য পরিণতি বলে স্বীকার করে নিয়েছে তারা। আর যারা অপেক্ষাকৃত ধনী, তাদেরও যে নিশ্চিন্ত যাপন, এমনটাও নয়। তারা প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছে, জোর যার, মুলুক তার। যে যখন পারছে অন্যের সম্পত্তি গ্রাস করে নিচ্ছে। পরস্বাপহারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে।
বঙ্গলোকে এই মাৎস্যন্যায় অধ্যায় রচনার শুরুতে প্রতিরোধ প্রতিবাদের প্রাচীর গড়তে চেয়েছিলেন দয়িতবিষ্ণু। বিশুদ্ধ পণ্ডিত। তাঁকে অসতীভর্তা অপবাদ দিয়ে নিজরাজ্য থেকে বিতাড়িত করেছিলেন সম্রাট বলভট, এই প্রকাশচন্দ্রেরই প্ররোচনায়। আসলে, দয়িতবিষ্ণু বলভটের পিতা রাজভটের ঔরসে এক কৈবর্ত রমণীর গর্ভজাত সন্তান বপ্যটকে বড় করে তুলেছিলেন নিজের সন্তানের পরিচয়ে। কানীন সন্তান বপ্যট নিজের শিকড়ের খোঁজে বেরিয়ে শেষ পর্যন্ত জায়গা পান মৎস্যেন্দ্রনাথের বৃত্তে। এই বপ্যটের পুত্র গোপালদেবকেই বঙ্গদেশের মুখ্য সামন্তপ্রভুরা তাঁদের রাজা নির্বাচিত করেছিলেন। বাংলা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত এক শাসকের সন্ধান পেয়েছিল দেবী চুন্দা বা চণ্ডীর আশীর্বাদে।

আরও পড়ুন-চাপ আমার সেরা খেলা বের করে আনে : শ্রেয়স

এই গোপালের উত্তরপুরুষ ধর্মপাল। তাঁর আমলে রচিত হয়েছিল খলিমপুরের তাম্রলিপি। সেই তাম্রলিপির অনুবাদ করেছেন ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখছেন, “খলিমপুর তাম্রশাসন আমাদের জানাইতেছে মাৎস্যন্যায় দূর করিবার অভিপ্রায়ে, প্রকৃতিপুঞ্জ যাঁহাকে রাজলক্ষ্মীর করগ্রহণ করাইয়াছিল, পূর্ণিমা রজনীর জ্যোৎস্নারাশির অতিমাত্র ধবলতাই যাঁহার স্থায়ী যশোরাশির অনুকরণ করিতে পারিত, নরকুল-চূড়ামণি গোপাল নামক সেই প্রসিদ্ধ বপ্যট হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।” এখানে ‘প্রকৃতিপুঞ্জ’ বলতে ‘জনসাধারণ’কে বোঝানো হয়েছে।
মৎস্যেন্দ্রনাথ যে কাহিনি শুনিয়েছেন উপন্যাসের পরিধিতে সেটা আসলে শুনিয়েছিলেন লামা তারানাথ। বঙ্গবক্ষে বিরাজমান জনশ্রুতি ‘পটমঞ্জরী’র পৃষ্ঠায় উদীরিত অনন্য বিভায়।
এখানে মেঘান্দ নদীতে পুণ্যস্নানদৃশ্যের বর্ণনায় উঠে এসেছে সেসময়ের সমাজচিত্র, বিচিত্র গরিমায়। সেই দৃশ্য বর্ণনার শুরুতে বলে নেওয়া হয়েছে একটি অনবদ্য বচন। তাতে বলে হয়েছে, কোনও দেশকে জানতে, বুঝতে ও চিনতে গেলে যেতে হবে দুটি স্থানে। এক, তীর্থস্থানে; দুই, শুঁড়িখানায়।

আরও পড়ুন-আমেরিকায় প্রবল তুষারঝড়ের শঙ্কা, বাতিল হল চার হাজার উড়ান

তীর্থস্থানে ভিড়ের বর্ণনায় ধরা পড়েছেন মানুষজন। তাঁদের মধ্যে আছেন যোগী উড়ুম্বর। এই মহাযানী বৌদ্ধ আচার্যের আর্থিক সঙ্গতি বড় বড় শ্রেষ্ঠীকে লজ্জায় ফেলতে পারে। আছেন শ্রেষ্ঠী দিব্যদাস। তাঁর গা মুছিয়ে দিচ্ছেন তাঁরই বিধবা সুন্দরী পুত্রবধূ। আছেন কুমার সিদ্ধার্থশর্মা। তিনি শালিবন বিহারের অন্যতম উজ্জ্বল মেধারত্ন। রয়েছেন দেবী মঞ্জরী। এক বৃদ্ধা, দেহের চামড়া ঝুলে পড়েছে। কিন্তু চৌষট্টি কলায় পারঙ্গম তিনি। সেবিষয়ে তাঁর মান্যতা প্রশ্নাতীত। আছে সহজলিঙ্গ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা। খাদ্যাখাদ্য বিচার নেই, তবে ভয়ানক উগ্র স্বভাবের। ভিড়ের মধ্যে আছেন একদল পৃথুলা রমণী। এঁরা গৃহবধূ। তবে, ব্যস্ত গৃহস্বামীদের কাছ থেকে এঁরা প্রেম কিংবা সময়, কোনওটাই পান না। স্বামীদের অগোচরে এঁরা বাড়ির ভৃত্য ও দেবরস্থানীয়দের শরীর দান করতে কুণ্ঠিত হন না। আবার গৃহদেবতার সেবাতেও এঁদের কোনও ফাঁকি নেই। এই ভিড়ের মধ্যেই আছেন রাজগুরু বিশুদ্ধকীর্তি, মহা দণ্ডনায়ক জিতসেন, রাজসেবকবাহিনীর প্রধান গিরিকিশোর। এঁরা প্রত্যেকেই অত্যাচারী, লম্পট, নিষ্ঠুর। তবে সেই ভিড়ে নেই প্রকাশচন্দ্র ও বাংলার রানি। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তাঁরা রীতি অনুযায়ী সেবারের মহাস্নানের উদ্বোধনে অনুপস্থিত।

আরও পড়ুন-বন্ধুর টানে মেসির বাড়িতে সুয়ারেজ

এই মহাস্নানের আবহ থেকেই সহজিয়া বৌদ্ধ সাধক, শৈব সন্ন্যাসী আর আম–জনতা মিলেমিশে বিদ্রোহের বারুদে দেওয়ার আগুন খুঁজতে থাকে।
সেই উপপ্লব পরিণতি পায় যখন বঙ্গদেশের একচ্ছত্রধিপ রানির শরীর আগুনে পুড়ে যায়। আর একটা ষাঁড়ের পিঠে চেপে পালিয়ে যায় প্রকাশচন্দ্র।
বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন গোপালদেব। রানির আসনে দেদ্দদেবী। অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন বাংলার তাবৎ জনতা, সামন্ত থেকে আচার্য, বণিক থেকে কৃষক, সন্ন্যাসী থেকে সৈন্য, কৃষক থেকে কর্মকার, কুম্ভকার থেকে শুঁড়ি, শবর থেকে কিরাত, জালিক থেকে কৈবর্ত— সব্বাই।

আরও পড়ুন-চাপ আমার সেরা খেলা বের করে আনে : শ্রেয়স

সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিতে গোপালদেব উচ্চারণ করেন শপথ বাক্য, ‘… আজীবন সত্য, ন্যায় এবং ধর্মের পথে থেকে গৌড়বঙ্গের সেবা করব।’ বলেন, তিনি মনে রাখবেন, ‘দেশের মাটির থেকে বড় মন্দির নেই, দেশের মানুষের থেকে বড় ঈশ্বর নেই, দেশসেবার থেকে বড় ধর্ম নেই’।
উপন্যাসের শেষ বাক্য থিতু হয়ে মন্দর্ভা আর পদ্মসম্ভবের প্রগাঢ় চুম্বনে।
সেই প্রেম আর হিংসার, আগুনের আর জলের, নৈরাশ্যের আর শান্তির বৈপরীত্য সমবায়ে গড়ে ওঠা প্রতিবেশে পাঠকের মনন স্থিরলগ্ন হয় এই প্রত্যয়ে, বাংলার ইতিহাসের অনালোচিতপ্রায় এক প্রকোষ্ঠে দীপশিখার প্রজ্বালিত মুহূর্ত সৃজন করে যে গ্রন্থ, সেটি ঐতিহাসিক উপন্যাস না ইতিহাসের পটভূমিতে রচিত রোমহর্ষক কাহিনি, সেটা জানা বোঝা নির্ণয় করাটা গৌণ বিষয়। আসলে যেটা জরুরি সেটা হল বইটা পড়ে ফেলা।
এই বোধেই ‘পটমঞ্জরী’র অনন্য সার্থকতা।

আরও পড়ুন-বাম বঞ্চনার জবাব মিলেছে

জনপ্রিয় মার্কিন ঔপন্যাসিক জেওয়েল পার্কার রোডস কী আর সাধে বলেছেন, “I love historical fiction because there’s a literal truth, and there’s an emotional truth, and what the fiction writer tries to create is that emotional truth.”
এই উপলব্ধি ‘পটমঞ্জরী’র প্রত্যেক পাঠকের হতে বাধ্য।

Latest article