পরিশ্রম করেও যখন কোনও সফলতা মেলে না তখন বলি পরিশ্রমটাই ‘জলে’ গেল। কথাটা যত সহজ ‘জল’ কিন্তু তত সহজ নয়। এই নিয়ে গভীর সমস্যায় সংকটে গোটা বিশ্ব। আর পৃথিবীকে দূষণমক্ত সুপেয় জলের ভাবনায় আধুনিক গবেষণায় গোটা জীবন কাটিয়ে দিলেন আমেরিকান বিজ্ঞানী পিটার এইচ গ্লিক। তাঁর গোটা জীবনের জল গবেষণার বিষয়, জল-সম্পদ, জল ও জলবায়ু পরিবর্তন, উন্নয়ন এবং মানব স্বাস্থ্য নিয়ে জলের যে সংঘাত বর্তমান পৃথিবীতে। এই জলবিজ্ঞানীর সহ-উদ্যোগেই ১৯৮৭ সালে তৈরি হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসিফিক ইনস্টিটিউট। জলসম্পদ নিয়ে কাজের জন্যই ২০০৩ সালে এই বিজ্ঞানী ম্যাকআর্থার ফেলোশিপ লাভ করেন। তার পর এক বিস্তীর্ণ যাত্রা। জলবায়ু পরিবর্তনের আঞ্চলিক প্রভাব হিসেবে তাঁর গবেষণাপত্রই প্রথম দেখিয়েছিল পৃথিবীর মানুষ একদিন কী ভীষণ জলের সংকটের সম্মুখীন হবেন। বিভিন্ন লেখা ও গবেষণা পত্রে জানিয়েছেন ‘জল-যুদ্ধের’ আশঙ্কার কথা।
আরও পড়ুন-অগ্নিকাণ্ডে সর্বস্বান্ত, পাশে তৃণমূল নেতা
জল গবেষণার কারণেই ২০১১ সালে ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার রিসোর্সেস অ্যাসোসিয়েশন থেকে ‘ভেল তে চাউ অ্যাওয়ার্ড’ তুলে দেওয়া হয় তাঁর হাতে। তার আগে ২০০৬ সালে ইউ এস ন্যাশনাল অফ সায়েন্সের বড় সম্মানে সম্মানিত। প্যাসিফিক ইনস্টিটিউট প্রদত্ত প্রথম মার্কিন জল-পুরস্কার। ক্যালিফোর্নিয়া, ইয়েল প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে গেছেন জল ও মানবসম্পদ নিয়ে। একদিকে আমেরিকার ওয়াটার পলিসি নিয়ে যেমন বই লিখেছেন তেমনই অন্যদিকে গোটা বিশ্বকে সচেতন করতে নিজস্ব মতামত নিয়ে বক্তৃতা দিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। তিনিই প্রথম শুনিয়েছিলেন জলবায়ু পরিবর্তনে জলের ভূমিকার কথা। হাইড্রোক্লিমেটোলজির ওপর ফোকাস করেন। বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন মাটির আর্দ্রতাকে কীভাবে পরিবর্তন ঘটায়। প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কথা যখন আজ নানা সময়ে সংবাদে উঠে আসছে কোথাও প্রবল গরম তো কোথাও প্রবল বৃষ্টিপাত বা বন্যা। কীভাবে তৈরি হয় খাদ্য সংকট। সম্মুখীন হয় ‘গ্লোবাল ফুড প্রোডাকশন’।
আরও পড়ুন-জেতা আসন তৃণমূলেরই
বিজ্ঞানী গ্লিক শুনিয়েছেন বিশ্বের জল-চরিত্রের পরিবর্তনের কথা। দেশে দেশে জল সচেতনতা ও জল সম্পর্কিত ভাষণের পাশাপাশি লিখেছেন বেশ কয়েকটি বই। সম্পাদনা করেছেন ‘জল, জলবায়ু এবং নিরাপত্তা’ বিষয়ক পত্রিকা। আমেরিকার জলসম্পদ গবেষণার বোর্ডে কাজ যেমন করেছেন, তেমনই এক সময় গুস্তাফ অ্যাডলফাস কলেজের নোবেল পুরস্কারের প্রভাষক ছিলেন। ২০১৪ সালে গ্লিক আমেরিকান মেটিওরোলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে একটি অসাধারণ প্রবন্ধ লেখেন ‘ওয়েদার, ক্লাইমেট অ্যান্ড সোসাইটি’। যেখানে জলের জন্য পৃথিবীর দেশে দেশের সংঘাতের বার্তা দিয়েছিলেন। সিরিয়ার যুদ্ধের ছায়া নাকি ছিল জল। সারা বিশ্বে সেই প্রবন্ধ নিয়ে শোরগোল উঠেছিল। এক তথ্য জানাচ্ছে, ২০১৪ সালে সেই প্রবন্ধ সেই বছরে বিশ্বে সবথেকে বেশি পঠিত প্রবন্ধ। পেয়েছেন ‘ওয়াটার হিরোস অ্যাওয়ার্ড’।
আরও পড়ুন-আসানসোল ও বনগাঁয় আজ দুই কেন্দ্রে উপনির্বাচন, আগাম অভিনন্দন সাংসদের
পিটার গ্লিক একজন বিজ্ঞানী যিনি বৈশ্বিক জলবায়ু এবং জল সমস্যা মোকাবিলা করছেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে প্যাসিফিক ইনস্টিটিউটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসিডেন্ট-এমেরিটাস এবং রটেন: ট্রাবলড ওয়াটারস (২০১৯), লাস্ট কল অ্যাট দ্য ওসিস (২০১১), আর্থ ২১০০ সহ বিস্তৃত পরিবেশগত তথ্যচিত্রে উপস্থিত হয়েছেন ২০০৯), রানিং ড্রাই (২০০৫), গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন অ্যাডভেঞ্চার (২০০৮), এবং পাম্পড ড্রাই: দ্য গ্লোবাল ডিপ্লেশন অফ গ্রাউন্ডওয়াটার (২০১৬)। তিনি একজন ম্যাকআর্থার ফেলো এবং ইউএস ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের সদস্য।
‘জল, জলবায়ু এবং নিরাপত্তা’ বিশ্বের কাছে আজ সবচেয়ে জরুরি বিষয়। জল নিয়ে শুধু গ্লিকই নন, তাঁর পথ ধরেই উঠে এসেছে নরম্যান মায়ার্স, জেসিকা টুচম্যান ম্যাথিউস, মাইকেল রেনাল সহ অসংখ্য নাম। জল নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। পৃথিবীর নতুন গ্রহে জলের সন্ধানের ছবি উপগ্রহে চিত্রে ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা বিশ্বে শুরু হয়ে গিয়েছে নতুন গ্রহে প্রাণের সন্ধানও।
আরও পড়ুন-আসানসোল ও বনগাঁয় আজ দুই কেন্দ্রে উপনির্বাচন, আগাম অভিনন্দন সাংসদের
জলের কাহিনি পৃথিবীর জন্মকাল থেকেই। আছে ইতিহাস। আছেন হেনরি ক্যাভেন্ডিস। পিছিয়ে যেতে হবে অনেকটাই। ইংরেজ প্রাকৃতিক দার্শনিক, পদার্থ ও রয়াসনবিদ। ১৭৩১ সালে ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া এই বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছিলেন হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সংমিশ্রনেই জল। এই জল বা ওয়াটার শব্দটি এসেছে ইংলিশ ওয়াটার থেকে। প্রোটে-জার্মানিক। প্রোটে–ইন্দোস থেকে। নানা শব্দ পেরিয়ে এসেছে জল। ‘অনাহিতা’ জলের আরেক নাম। ফার্সি জলদেবীকে বোঝায়। এ ছাড়াও আছে অ্যাকোয়া, কর্ডেলিয়া। জলপ্রপাত বা কলকন্যা। জল নিয়ে সিনেমা, গান-গল্প, ছবি,ডকুমেন্টারির অভাব নেই। ‘ডের ডার্স্টিজ প্ল্যানেট’, ‘ফ্লো: ফর লাভ অব ওয়াটার’ কত কী। রয়েছে বিভিন্ন ভাষায় অসংখ্য প্রবাদ। জলের আরেক নাম জীবন।
আরও পড়ুন-প্রকাশিত হল ‘কাছের মানুষ সুব্রত’
গ্লিক সহ বিজ্ঞানীরা সেই জলকে নিয়েই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ব্যবহারযোগ্য জলের সতর্কবার্তা দিয়েছেন। সারা বিশ্বই জলের সংকটের সম্মুখীন। জলসংকটে নাজেহাল বিশ্বের বিপুল সংখ্যক মানুষ। ভারতে মোট ৬ লক্ষ ৫৬ হাজার গ্রাম রয়েছে৷ সেখানে ১৯ কোটি ১৯ লক্ষ পরিবার বসবাস। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৬০ কোটি মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জলের কোনও বন্দোবস্ত নেই৷ গোটা দক্ষিণ ভারত জলসংকটে কাটায় বছরের বেশিরভাগ সময়। সংকটের সময়ে মহারাষ্ট্রের ঔরাঙ্গাবাদে ট্রেনে চেপে ১৪-১৫ কিলোমিটার দূরে পানীয় জল আনতে যেতে হয় মানুষকে৷