মোবাইলের সঙ্গে লড়াই ফটোগ্রাফারদের

তবে এখানে তাও কিছু রোজগারপাতি হয় বলে জানালেন বিজয় বর্মন। আগের সুদিন আর নেই। মনের জোরে পেশায় টিকে আছেন এঁরা।

Must read

মণীশ কীর্তনিয়া: জয় জগন্নাথ! ছবি তুলে দিই মা! বাবু, আপনি আর ছোট বাবু একসঙ্গে জলে বসুন, দারুণ ছবি উঠবে! সাদা জামা, কালো প্যান্ট, মাথায় টুপি, মুখে পান আর সযত্নে তোয়ালে মোড়া পুরনো ক্যামেরা হাতে নিয়ে পুরীর মন কেমন করা সমুদ্রের ধারে যাঁদের উদ্দেশ্যে ছবি তোলার কাতর অনুরোধ হল, সেই পরিবারের গিন্নি তখন প্রবল ব্যস্ত হাতে অত্যাধুনিক মোবাইল নিয়ে স্বামী আর সদ্য হাঁটতে শেখা টলমল পায়ে এক সমুদ্র ভবিষ্যৎ বুকে নিয়ে ক্রমাগত নোনা জলের ঝাপটা খেতে থাকা ছোটটার ছবি তুলতে গিয়ে নিজেও সমুদ্রের একের পর এক ঢেউয়ের ধাক্কায় কুপোকাত। তবুও হাতের মোবাইলে ছবি উঠছে টপাটপ।

আরও পড়ুন-উদ্বেগ বাড়িয়ে আক্রান্ত ৬ হাজার ছাড়াল

এর মধ্যেই হাতের ইশারায় এক বিচ ফটোগ্রাফারকে বুঝিয়ে দিলেন তাঁদের ওই ক্যামেরায় ছবি তোলার দরকার নেই। অসহায় ভাবে পরিবারটির দিকে তাকিয়ে সুদর্শন বেহেরা হাঁটা লাগালেন আর একটু দূরে একটি ৭-৮ জনের দল হুটোপুটি করছে সেখানে। ভাড়ায় দেওয়া রঙিন ছাতার নিচে চেয়ার পেতে বসে কয়েকজন। আর বাকিরা সমুদ্রের জলে বসে বালি নিয়ে এ ওর দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। সেখানেও ওই এক অনুরোধ। বাবু, আপনাদের ক’টা ভাল ছবি তুলে দিই! সপাট উত্তর এল, না না, লাগবে না। প্রত্যেকের হাতেই যে নানা ফিচারের নানা দামের মোবাইল ঘুরছে। সমুদ্রের পাড়ে বসে একের পর ছবি-ভিডিও উঠছে। তৎক্ষণাৎ সেসব ফেসবুক-ইনস্টা-ট্যুইটার-পডকাস্টে আপলোড হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে বাড়তি পাওনা ভিডিও কলে কাছের মানুষের সঙ্গে মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়ার ভার্চুয়াল সুবিধা।

আরও পড়ুন-সংবাদের সত্য-মিথ্যা যাচাই করবে পিআইবি, জানাল মোদি সরকার

এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে কে আর পুরনো ক্যামেরায় ছবি তুলে হোটেলের নাম, রুম নম্বর দিয়ে সেই কোন সন্ধ্যাবেলায় প্রিন্ট করা ছবি ডেলিভারি নেয়! সেসব দিন গিয়েছে। তার সঙ্গে গিয়েছে বিচ ফটোগ্রাফারদের রোজগার। রোদ-জল-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সেই কোন ভোর রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সূর্যোদয় থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সমুদ্রপাড়ে সমানে চরকি পাক খাওয়া দুটো পয়সা রোজগারের জন্য। কিন্তু প্রযুক্তি ওদের রোজগারে থাবা বসিয়েছে। সকাল থেকে ঠা ঠা রোদে পুড়ে একটাও ছবি তুলতে না পেরে হতোদ্যম হয়ে পড়া সুদর্শন বেহেরা-কানু বেহেরা-সলুই দাসরা প্রকাশের ডাবের দোকানের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন। একই অবস্থা দিঘাতেও। নিউদিঘা ফটোগ্রাফার ইউনিয়ন (এনডিপিএ) রয়েছে। সদস্য সংখ্যা ১২০০। ওল্ড দিঘাতে আবার আলাদা ইউনিয়ন। এঁদের অবস্থাও তথৈবচ।

আরও পড়ুন-নয়া পেনশন স্কিম খতিয়ে দেখতে ৪ সদস্যের কমিটি

তবে এখানে তাও কিছু রোজগারপাতি হয় বলে জানালেন বিজয় বর্মন। আগের সুদিন আর নেই। মনের জোরে পেশায় টিকে আছেন এঁরা। পুরীর ছবিওয়ালাদেরও একটা সংগঠন আছে। জয় মা হরচণ্ডী ফটোগ্রাফার আসোসিয়েশন। সব মিলিয়ে ৮০০ সদস্য এই সংগঠনের। এঁরা সকলেই রোজ সমুদ্রপাড়ে পড়ে থাকেন ক্যামেরা নিয়ে রোজগারের আশায়। কোনওদিন সামান্য কিছু হয়। কোনওদিন তাও নয়। তাই রোজ সূর্য ওঠার আগেই সমুদ্রপাড়ে এসে কপালে হাত ঠেকিয়ে ছবিওয়ালারা প্রার্থনা করেন, হে জগন্নাথ, আজ মুখ তুলে চেয়ো। তারপর ওঁরা হাঁক পাড়েন রোজকার মতো, ‘‘বাবু আপনার একটা ভাল ছবি তুলে দেব! দেখুন না, দারুণ তুলব।”

Latest article