ফিশফ্রাই অন্য একদিন
মেয়েটি আঠেরো, ছেলেটি কুড়ি। দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়। শিয়ালদহ থেকে মেট্রোয় বইমেলায়। একটি অভিজাত স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে। নিচু স্বরে কথা। তার আগে ঘণ্টা তিনেক ঘোরাঘুরি। এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত। বই কেনা হয়েছে প্রচুর। গল্প, উপন্যাস, কবিতা। মেয়েটিকে ছেলেটি কথা দিয়েছে, ‘কেনাকাটার শেষে ফিশফ্রাই।’ হঠাৎ ছেলেটির পছন্দ হয়ে যায় একটি দুষ্প্রাপ্য বই। পকেটে হাত। দেখে, যা আছে, বইটা কেনার পর থাকবে গাড়িভাড়াটুকু। ফিশফ্রাই হবে না। পরিস্থিতি বোঝে মেয়েটি। বলে, ‘রেয়ার বই। কিনে নাও। ফিশফ্রাই অন্য একদিন।’ উজ্জ্বল হয় ছেলেটির মুখ। মেয়েটির পরিণত সিদ্ধান্ত তৃপ্তি দেয়। ভরসা দেয়। সময় পরিবর্তনশীল। তবু চাই ওরা এইভাবেই বছরের পর বছর বইমেলায় আসুক।
আরও পড়ুন-স্বামীর মা-বাবাকে সেবা করা স্ত্রীরও দায়িত্ব : হাইকোর্ট
ইংলিশ মিডিয়াম ছেলে
বাংলাদেশ প্যাভেলিয়ন লাগোয়া ফুডপার্ক। ফুডপার্ক লাগোয়া কয়েকটি ছোট ছোট স্টল। একটি স্টলে ‘আবোল তাবোল’। সন্ধের দিকে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাবা-মা। ছেলেটি ইংলিশ মিডিয়াম। কৌতূহলবশত হাতে নেয় বইটি। রে রে করে ওঠে মা, ‘রেখে দাও। বাংলা বই। একলাইনও পড়তে পারবে না।’ বিক্রেতা বলেন, ‘আপনি পড়ে শোনাবেন। নিয়ে যান।’ বইটির শতবর্ষ চলছে জানেন না ওঁরা। পাতায় পাতায় কতটা আনন্দ, সেটাও হয়তো অজানা। তবু তাঁরা নিলেন। বাবার উৎসাহে। ক্লাস ফাইভের ছেলেটি, যে আগে হয়তো কোনওদিন বাংলা কবিতা পড়েনি বা শোনেনি, বইমেলায় তার হাতে পৌঁছে গেলেন সুকুমার রায়।
মফস্সলের বালিকা
এসবিআই অডিটোরিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে খ্যাতনামা লেখক। অবাক চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে মফস্সলের বালিকা। সঙ্গে মা। প্রিয় লেখককে প্রথমবার সামনে দেখে বালিকা আনন্দে আত্মহারা। যদিও বাহ্যিক প্রকাশ নেই, স্রোত বইছে মনের গভীরে। টেলিভিশন, খবরের কাগজ, বইয়ে ছাপা ছবি দেখে চিনেছে লেখককে। লাজুক বালিকা মাকে কিছু একটা বলল। মা এগিয়ে গেলেন লেখকের দিকে, ‘আমার মেয়ে আপনার লেখার ভক্ত। ও আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চায়।’ লেখক সম্মত। তোলা হল ছবি। বালিকার ব্যাগে তখন সদ্য-কেনা ওই লেখকের নতুন বই। সুবাস ছড়াল। উঠল সুর। একটি সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী থাকল কলকাতা বইমেলা।
আরও পড়ুন-এআই যেন নতুন আঙ্গিকের এক কবিতা
অভ্যেস হয়ে গেছে
সুসজ্জিত লিটল ম্যাগাজিন প্যাভেলিয়ন। দুটো সারির মাঝে প্রচুর স্পেশ। হাঁটাচলার সুবিধা। পত্রপত্রিকার সম্ভার সাজিয়ে বসেছেন সম্পাদকরা। আগ্রহীরা নেড়েচেড়ে দেখছেন। কেউ কেউ কিনছেন। সত্তরোর্ধ্ব এক সম্পাদক বসেছেন পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যা নিয়ে। বিক্রিবাটা আহামরি হচ্ছে না। তবু হতাশ নন। কথায় কথায় জানালেন, প্রায় তিরিশ বছর মেলায় আসছি। লিটল ম্যাগাজিন টেবিলে বসছি। অভ্যেস হয়ে গেছে। গভীর টান অনুভব করি। তাই না এসে পারি না। ভাবি না বিক্রি নিয়েও। যতদিন বাঁচব, আসব। এঁদের মতো মানুষ আছেন বলেই বইমেলা আছে।
ঘুরে ঘুরে বিক্রি
স্টল নেই তাঁর। টেবিলও নেই। মেলায় ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি করেন যুবক। প্রতিদিন আসেন। এটা তাঁর বহু বছরের অভ্যেস। নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়। ভাল লাগে। ‘আপনি লেখেন?’ প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, ‘না। আমার বাবা লেখেন। এইসব বই তাঁরই। আমি পৌঁছে দিই পাঠকদের কাছে।’ তিনি আরও বললেন, ‘আমি পড়তে ভালবাসি। বিক্রির টাকায় বই কিনি। আমার জন্য, বাবার জন্য।’ আলো জ্বলে উঠল বইমেলায়।
আরও পড়ুন-দরিদ্র-মেধাবীদের ১৫০০ কোটির বৃত্তি রাজ্যের
পড়েন না, কেনেন
বইমেলায় খাবারের দোকান ভদ্রলোকের। প্রতিদিন ভিড় সামলাতে কালঘাম ছোটে। তাঁর কাস্টমার যেমন পাঠক পাঠিকা, তেমন কবি, লেখক, সম্পাদক। তবে কবি, লেখকদের খুব একটা চেনেন না। কারণ তিনি বই পড়েন না। তবে বইমেলা শেষ হয়ে গেলে মনখারাপ দানা বাঁধে। তাঁর কথায়, অন্য কোনও মেলায় এতটা উন্মাদনা দেখি না। নিজে না পড়লেও, প্রতি বছর তিনি বই কেনেন। বাড়িতে আছে ছেলে-মেয়ে। তারা গল্পের বই পড়তে ভালবাসে। তাদের জন্য কিনতে হয় ভূত, গোয়েন্দা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইনিও বইমেলার আপনজন। পরম বন্ধু।