রাজকৃষ্ণ রায় : বাংলার প্রথম প্রফেশনাল সাহিত্যিক

কবি রাজকৃষ্ণ রায়ের সৃষ্টি ছিল বহুমুখী, বৈচিত্রময়। অভিনয় করেছেন। প্রকাশ করেছেন পত্রিকা। লিখেছেন কবিতা, নাটক, গান। তাঁর লেখায় দেখা যায় প্রেম এবং ভক্তির মহাসম্মিলন। সম্ভবত তিনিই প্রথম বাংলা সাহিত্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। গতকাল ছিল তাঁর প্রয়াণদিবস। স্মরণ করলেন মহারাজা মণীন্দ্র চন্দ্র কলেজের সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দাস

Must read

মাত্র একুশ বছর বয়সের একটি ছেলে এসে দাঁড়াল অ্যালবার্ট প্রেস ছাপাখানার দরজায়। চেহারাতে বুদ্ধির ছাপ। চোখে কাব্যের গভীরতা। কিন্তু স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। ১২ টাকা মাইনের চাকরি। সেদিনের শেষে এই চাকরি জুটল রাজকৃষ্ণের ভাগ্যে। অভাবের সংসারে কিছুটা আশার আলো দেখলেন তিনি। নিউ বেঙ্গল প্রেসে যোগ দিয়ে প্রথম অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। শুরু করলেন উপার্জন।
আপনারে আপনি চিনি নে…

আরও পড়ুন-বিয়ের স্বীকৃতি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে চার সমলিঙ্গ দম্পতি

ছোটবেলায় মাকে হারানোর পরে ওই একরত্তি ছেলেকে নিয়ে পূর্ব বর্ধমানের রামচন্দ্রপুর থেকে কলকাতায় চলে আসেন বাবা। রামচন্দ্রপুরের সবুজ ধানখেত, মেঠোপথ, মেঘ-ভাঙা আকাশের ছবি এখন ধোঁয়াশার মতো আবছা। এখন আর বাবার কথাও মনে নেই রাজকৃষ্ণের। আট বছর বয়সে বাবা রাম দাসকেও হারিয়েছেন। তাই তাঁর স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করা আর হয়ে ওঠেনি। নিজে বই জোগাড় করে হয়ে উঠেছেন স্ব-শিক্ষিত। নিজের শিক্ষক নিজেই। রবীন্দ্রনাথের অনেক আগেই রাজকৃষ্ণ না-স্কুলের ছাত্র। নিজেই হয়ে উঠলেন নিজের ফ্রেন্ড, ফিলোজ়ফার অ্যান্ড গাইড।

আরও পড়ুন-ইডির পর এবার সিবিআইয়ের তলব তেজস্বীকে

মাগো বীণাপাণি আমার…
অ্যালবার্ট প্রেস থেকে ১২৮৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশ করেন ‘বীণা’। এই মাসিক পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর কবিতা-নাটক প্রকাশ করতে থাকেন। কাব্য-প্রধান মাসিক পত্রিকা ‘বীণা’ জনপ্রিয় হওয়ায় ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে ১২৮৭ বঙ্গাব্দে তৈরি করলেন নিজের ছাপাখানা ‘বীণাযন্ত্র’। ধারাবাহিক লোকসানের ফলে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলেন ‘বীণাযন্ত্র’।
জীবন-নাটকের নাট্যশালায়
নাট্যমঞ্চের সঙ্গে রাজকৃষ্ণের যোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। তিনি অভিনেতা হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর ‘প্রহ্লাদ চরিত’ নাটকের অভিনয়ে বাংলা থিয়েটার লাভের মুখ দেখেছিল। কিন্তু সেই লাভের অংশ তিনি পাচ্ছিলেন না। এবার ক্ষোভে তৈরি করলেন বাংলার নাট্যশালা ‘বীণারঙ্গভূমি’। ১২৯৪ বঙ্গাব্দে ঠনঠনিয়াতে। এখানেই অভিনয় শুরু হয় রাজকৃষ্ণের নিজের লেখা পৌরাণিক নাটক ‘চন্দ্রহাস’। কিন্তু বাণিজ্যিক সাফল্য না পাওয়ায় ১২৯৭ সালে ঋণের দায়ে বেচে দিলেন ‘বীণারঙ্গভূমি’। এতেই তিনি ঋণগ্রস্ত এবং সর্বস্বান্ত হন। অবশেষে স্টার থিয়েটার কর্তৃপক্ষ এবং গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের অনুগ্রহে কিছুটা অবস্থার উন্নতি হলেও তাঁর অকালমৃত্যু ঠেকানো যায়নি। মাত্র ৪৫ বছরে থেমে যায় কবি রাজকৃষ্ণ রায়ের কলম। সেদিন ছিল ১১ মার্চ, ১৮৯৪।

আরও পড়ুন-আর্থিক মন্দার কারণে দেউলিয়া, বন্ধ হল আমেরিকার সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক

কিন্তু নাটক ছিল তাঁর কলমের প্রথম সখী। ভালবাসার অবলম্বন। উপার্জনের পথ। তাই ১২৯৮-এ যোগ দিলেন স্টার থিয়েটারে। একজন বেতনভোগী নাট্যকার হিসেবে। লিখলেন একের পর এক নাটক।
স্বদেশ আমার জননী আমার
ছেলেবেলা থেকেই কবিতায় প্রতি তাঁর ছিল অনুরাগ। তাঁর লেখা বহু কবিতা ‘সন্ধ্যা’য় প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্রুপাত্মক কবিতার সাহায্যে বাঙালি জাতির বোধ ও চেতনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ‘ভূতলে বাঙালি অধম জাতি’ এই শিরোনামেও কবিতা লিখেছেন। ‘ভারত গান’ কবিতামালার প্রত্যেকটি ছত্রে দেশপ্রেমের কথা বলেছেন। আবার অন্যদিকে বাঙালি সম্বন্ধে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন।
সম্ভবত রাজকৃষ্ণ রায়ই প্রথম বাংলা সাহিত্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সেই অর্থে তিনি প্রথম ‘প্রফেশনাল’ সাহিত্যিক। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে ‘হরধনুভঙ্গ’ নাটকে প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার করেন। আবার ‘বর্ষার মেঘ’ কবিতা এবং ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা ‘রাজা বিক্রমাদিত্য’ নাটকে লিখলেন গদ্য কবিতা। ‘বঙ্গ ভূষণ’ (১৮৭৪) কাব্যগ্রন্থ দিয়ে লেখা শুরু করে শেষ করলেন ‘বেনজীর বদ রেসুনীর’ (১৮৯৩)-এ। এই উনিশ বছরে তাঁর কলম জন্ম দিয়েছে বহু কাব্য, নাটক, আখ্যান এবং প্রহসনের।

আরও পড়ুন-আর কত দেখব! ডিএ প্রাপ্তি সাংবিধানিক অধিকার হল কবে?

বাঙালির গান বাঙালির প্রাণ
‘বাঙালির গান’-এর সঙ্কলক ও সাহিত্যিক দুর্গাদাস লাহিড়ী বলতেন— … রাজকৃষ্ণ যত গ্রন্থ লিখিয়াছেন বাংলা ভাষায়, এত গ্রন্থ আর কেহই লেখেন নাই। দুর্গাদাস যখন এ কথা বলছেন, তখনও অবশ্য রবীন্দ্রনাথের কলম চলছে সাবলীল। সৃষ্টির মাঝ-আকাশে। তারপরেও রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন আরও প্রায় ৩৪ বছর।
দেশের প্রতি ভালবাসা, পরাধীনতার বিদ্বেষ-গ্লানি, প্রেম-ভক্তি-ভালবাসা রাজকৃষ্ণের কবিতার মূল ভাবনা। ১৮৭৬-এর এক সন্ধ্যায় ‘অবসর সরোজিনী’ কাব্য প্রকাশ করেন তিনি। সেখানেই দেখা হয় বাংলার গ্যারিক কবি ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে। অনুপ্রাণিত হয়ে লিখতে শুরু করেন নাটক। ‘অনলে বিজলী’ (১৮৭৮), ‘দ্বাদশ গোপাল’ (১৮৭৮), ‘লৌহ কারাগার’ (১৮৮০), ‘হরধনুভঙ্গ’ (১৮৮২)— এগুলো ছিল তাঁর পৌরাণিক নাটক। ‘রাজা বিক্রমাদিত্য’ (১৮৮৪), ‘মীরাবাই’ (১৮৮৯) লিখলেন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে।
‘বেলুনে বাঙালি বিবি’ (১৮৯০), ‘আর লোভেদ্র গবেন্দ্র’ (১৮৯০), সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রহসন। গীতিনাট্যে মুনশিয়ানার ছাপ রাখলেন ‘লায়লা মজনু’ (১৮৯১) ও ‘ঋষ শৃঙ্গ’ (১৮৯২)-এ।

আরও পড়ুন-হংকং ফ্লু নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে সতর্কবার্তা কেন্দ্রের

চন্দ্রাবলী চাঁদ আমার…
গৌড়ের জঙ্গলে শিকার ও ডাকাতির প্রেক্ষাপটে লিখলেন অদ্ভুত ঘটনা অবলম্বনে নাটক ‘চমৎকার’। সামটি গ্রামের জমিদার ধনেশ্বর সিংহ রায় এবং ডাকাত সর্দার ভীমভামকে নিয়ে লেখা এই নাটক এক উদ্ভট কল্পনার প্রকাশ। নাটকের মধ্যে রাজকৃষ্ণ বৌ-এর গান ব্যবহার করেছেন— ‘কাঁচা সোনা, চাঁদের পানা, বউটি তোমার দেখতে হবে। মুখটি বউয়ের আঁচল কোলে, ফুলটি যেন ফুটে রবে।’ পৌরাণিক আবহে কৌতুক-এর মধ্য দিয়ে ‘চন্দ্রাবলী’কে জনপ্রিয় করলেন। কৃষ্ণকে দিয়ে বলালেন— ‘কালো অঙ্গ হোকগে কালো, লাগুক ধুলো বোয়ে গেল, বাঁশির ছেদা বাজুক, তাই।’ আবার চন্দ্রাবলীকে খুশি করে কৃষ্ণ গাইলেন— ‘মেঘের কোলে লুকিয়ে ছিল চাঁদ আমার। মেঘ সরিয়ে দেখা দিলে চাঁদ আমার। দেখা দিয়ে, তাপিত হিয়ে, জুড়িয়ে দিলে চাঁদ আমার। বিরহ জ্বালা নিবিয়ে দিলে, রূপের সুধায় চাঁদ আমার। যমুনা তটে, উঠিল ফুটে, চন্দ্রাবলী চাঁদ আমার।’ ধর্মকেন্দ্রিক ঐতিহাসিক নাটক লিখলেন ‘মীরাবাই’। মীরাকে দিয়ে গাওয়ালেন— ‘তমাল ডালে কোকিল বঁধু, বধূর পানে চেয়ে আছে। বঁধু আবার সোহাগ মধু, ঢালছে বধূর কানের কাছে। কি এক ভাবের ছুটছে ধারা, বঁধু বধূ মাতোয়ারা। প্রেম শেখেনি আজো যারা, যাক না তারা ওদের কাছে।’
প্রেম যদি সই শিখতে হয়…

আরও পড়ুন-মধ্যপ্রদেশেও বুলডোজারের শাসন!

গীতিকার হিসেবে স্বদেশ ভাবনায় বাগেশ্রী রাগে লিখলেন গান— ‘কোথা সে অযোধ্যাপুর, মথুরা এখন, কোথা সে কুরুক্ষেত্র সমর প্রাঙ্গণ।’ আবার গৌরী দাদরা রাগে লিখলেন— ‘প্রেম যদি সই শিখতে হয়, মানুষের কাছে নয়। সাঁঝের রবি, প্রেমের ছবি, প্রেমের আলো আকাশময়।’ তিনিই আবার ভানুসিংহর আগেই লিখলেন ব্রজবুলিতে— ‘সহি রে আওল শাওন, ঘন ঘন গরজন, ঝম ঝম বরিখণ ঘন জলধারা। কহো কব আওবো কান্ত হামারা।’
কবি রাজকৃষ্ণের লেখায় আছে প্রেম, আছে ভক্তি। তিনিই লিখতে পারেন— ‘লয়লা কী খেলা এ যে নতুন খেলা। নাইকো ছেলে খেলা, এখন প্রেমে এলা।’ বিরহের পদেও সাবলীল রাজকৃষ্ণ— ‘কাঁদে গো পরান আজি তোমা সবে ছাড়িতে। বিধি জানে কবে পাবো তোমা সবে হেরিতে।’
প্রাণ ভরিয়ে বলো হরি হরি…

আরও পড়ুন-কোচিতে ফের লকডাউন!

‘দুই শিকারী’ (১৮৮২), ‘অদ্ভুত ডাকাত’ (১৮৮৯), ‘জ্যোতির্ময়ী’ (১৮৮৯) উপন্যাসে রাজকৃষ্ণ বহুমুখিনতার পরিচয় দেন। অনুবাদ সাহিত্যের দক্ষতা ফুটিয়ে তোলেন রামায়ণ (১৮৭৭-৮৫) ও মহাভারত (১৮৮৬-’৯৩)-এর বাংলা অনুবাদ করে। ১৮৮০-’৯২ সালের মধ্যে লিখলেন তিন খণ্ডের ‘ভারতকোষ’। গল্প বলার ঢঙে লিখলেন গল্প সংকলন ‘খোসগল্প’।
সৃষ্টির প্রগলভতায় তাঁর খ্যাতি ছিল সীমাবদ্ধ। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি ছিল বহুমুখী ও বৈচিত্রময়। ভক্তি আর ভালবাসাকে তিনি মিলিয়ে দিলেন আপন রঙে-রতন-আসনে রতন-ভূষণে যুগল রতন রাজে। চরণে নূপুর, আহা কি মধুর রুনুঝুনুঝুনু বাজে। সবে আঁখি ভরে হেরিয়ে মাধুরী, প্রাণ ভরিয়ে বলো হরি হরি, সুমধুর টানে হরিগুণ গানে নাচিল মধুর সাজে।

Latest article