মাহেশের রথ
১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরের কাছে মাহেশে শুরু হয়েছিল রথযাত্রা। বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্যের সেই রথযাত্রাকে ঘিরে উন্মাদনার শেষ নেই। ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং বাংলার প্রাচীনতম এই রথযাত্রা আয়োজিত হয় কলকাতার অদূরেই শ্রীরামপুরের মাহেশে। বহু মানুষ আসেন রথযাত্রার সময়। গ্রামের স্নানপিঁড়ি ময়দানে এক মাস ধরে রথযাত্রা উপলক্ষে মেলা বসে।
আরও পড়ুন-বনস্পতির ছায়া দিলেন
কলকাতার রথযাত্রা
ব্রিটিশ আমল থেকেই কলকাতা শহরে ধুমধাম করে রথযাত্রা উৎসব হত। অতীতে বৈঠকখানা বাজার, বউবাজার, লালদিঘি, পোস্তা, জানবাজার এলাকাতেই রথযাত্রা হত। কলকাতার কিছু বনেদি বাড়ির রথযাত্রার উৎসব আজও বিখ্যাত৷ উত্তর কলকাতার তারক প্রামাণিক রোডের প্রামাণিক বাড়ির পিতলের রথটি আনুমানিক ২৫০ বছরের বেশি পুরনো৷ তারক প্রামাণিকের বাবা গুরুচরণ প্রামাণিকের আমলে এই রথ হুগলির ব্যান্ডেলে পারিবারিক কাঁসা-পিতলের কারখানাতে নির্মিত হয়েছিল। ১৪ ফুট উচ্চতার পিতলের এই রথ, যার ওজন প্রায় ২২ টন৷ সেদিনের কারখানা থেকে রথকে টেনেই নিয়ে আসা হয়েছিল কলকাতায়৷ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাকে টানা হয় বাড়ির উঠোনেই৷ বউবাজারের রথওলা ধরেদের বাড়ি। ১৮২১ সালে স্বরূপচন্দ্র ধর প্রতিষ্ঠা করেন নিমকাঠের তৈরি আটচালার তিনতলা রথ৷ বিগ্রহটি প্রায় তিনশো বছরের পুরনো৷ বউবাজার অঞ্চলেরই আর এক ঐতিহ্যবাহী রথ হল পঞ্চাননতলা লেনের শান্তি শীলের ঠাকুরবাড়ির রথ। এখানকার রথ বিপিন শীলের রথ নামেই খ্যাত৷ এই অঞ্চলেই হিদারাম ব্যানার্জি লেনের নীলমণি দে-র ঠাকুরবাড়িতেও হয় রথ৷ এখানকার রথ আর জগন্নাথের কাঠের বিগ্রহ প্রায় ১১৭ বছরের পুরনো৷ মন্দিরের ঠাকুরদালানেই রথ টানা হয়৷ শশীভূষণ দে স্ট্রিটের গৌরাঙ্গ মন্দিরের রথ, ৭৫ বছরের পুরনো৷ পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে টিকিয়ে রাখা হয়েছে রথের পুজো৷
আরও পড়ুন-মণিপুরে সারারাত গুলিবর্ষণ, থানা ও বিজেপি বিধায়কের বাড়িতে জনতার হামলা
কলকাতার ইসকনের রথযাত্রা
এলগিন রোডের ইসকন মন্দিরের উদ্যোগে এই রথযাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে। রথের দিন এই শোভাযাত্রা শুরু হয় এলগিন রোডের ইসকনের রাধাগোবিন্দ মন্দির থেকে। ১৯৭২ সালে দুপুর আড়াইটে নাগাদ জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে নিয়ে প্রথম রথযাত্রার সময় যে যে পথ দিয়ে রথ এগিয়েছিল, আজও সেভাবেই রথ এগোয়। এই রথ যায় মহাত্মা গান্ধী রোডের মল্লিকদের ঠাকুরবাড়িতে। এক সপ্তাহ সেখানেই রাখা থাকে।
পুরুলিয়ার রথযাত্রা
পুরুলিয়াতে বিখ্যাত রথযাত্রা হল মণি বাইজির রথ। সূচনা করেন মণি বাইজি নিজেই। প্রায় দেড়শো বছর আগে লখনউ থেকে মুন্নি বাই নামে এক বাইজি পুরুলিয়ায় এসে পরবর্তীতে তিনি বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। তিনিই ‘মনমোহিনী বৈষ্ণবী’নামে খ্যাত হন। ১৮৯৮ সালে পুরুলিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্র চকবাজারে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দ জিউর বিগ্রহ অধিষ্ঠিত করিয়ে শুরু করেন রথযাত্রা। পিতলের রথটির দৈর্ঘ্যে এবং উচ্চতায় ছিল যথাক্রমে ১২ ফুট, ২২ ফুট। পরে কিছুটা কমিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে দশ চাকা থাকলেও পরে আটটি চাকা লাগানো হয় রথে। বর্তমনে নন্দলাল দত্ত কয়ালের পরিবার ১৯২২ সাল থেকে রথযাত্রার দায়িত্ব পালন করেন।
আরও পড়ুন-নির্দলদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের আবেদন, আগামী সপ্তাহে প্রচার শুরু
বাঁকুড়ার রথযাত্রা
বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের রথ প্রায় ৩৫০ বছরের প্রাচীন। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা বীরহাম্বির রানি শিরোমণি দেবীর ইচ্ছাতে মাধবগঞ্জে পাথরের পাঁচচূড়া মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের বিগ্রহ রাধামদন গোপাল জিউ। এই মন্দিরের অনুকরণে তৈরি হয় পিতলের রথ। মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুরে এই রথ উৎসবকে ঘিরে উন্মাদনায় মেতে ওঠে ভক্তেরা। এই রথে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা নয়! সওয়ার হন শ্রীশ্রী রাধামদন গোপাল জিউ।
হাওড়ার প্রাচীন রথযাত্রা
হাওড়া জেলায় বেশ কয়েকটি শতাব্দীপ্রাচীন রথ রয়েছে। গ্রামীণ হাওড়ার আমতা-২ ব্লকের অমরাগড়ি রায়বাড়ির ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা উৎসব ৩০৩ বছর পেরিয়ে ৩০৪ বছরে পড়ল। ১৪২ বছরের রথ হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরের বিধিচন্দ্রপুরের চট্টোপাধ্যায় পরিবারের। ১৮৭৩ সালে তিনকড়ি চট্টোপাধ্যায় এই রথ প্রতিষ্ঠা করেন। উচ্চতায় ২০ ফুট, চওড়ায় প্রায় ১০ ফুট। চাকার পরিধি ২ ফুট। পাঁচটি চূড়াবিশিষ্ট এই রথের মাঝের চূড়ায় রয়েছে পরি। তাকে ঘিরে চার চূড়ায় চার প্রহরী। রথের দু’টি অশ্বের লাগাম সারথির হাতে। জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল রথটি। গ্রামের মানুষের উদ্যোগে নতুন করে তৈরি হয় রথের কাঠামো। এই রথে জগন্নাথ নন পূজিত হন নারায়ণশিলা।
কোচবিহারের রথযাত্রা
কোচবিহার মদনমোহন মন্দির থেকেই প্রতিবছর রথের মেলার সময় রথযাত্রা আরম্ভ হয়। কোচবিহারের এই রথযাত্রার একটি অন্যতম ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। রাজ আমলে মদনমোহন মন্দিরের স্থাপনের সময় থেকেই কোচবিহারের রথে চড়েন কোচবিহারের সকলের প্রাণের ঠাকুর মদনমোহন। এটাই রীতি।
আরও পড়ুন-উধাও ৮৮ হাজার কোটির ৫০০ টাকার নোট
বর্ধমানের রথযাত্রা
বর্ধমান শহরের রাজবাড়িতে রথে পুজো দিয়েই উৎসবের শুরু৷ জোড়া কাঠের রথ বের হত রাজবাড়ি থেকে৷ একটি রাজার রথ, অন্যটি রানির রথ৷ রথে মূর্তি তোলার পরই রাজবংশের লোকেরা রশিতে টানতেন৷ রাজবাড়ির রথ বলতে রাধাবল্লভের রথকেই বোঝে বর্ধমানের মানুষ৷ জামালপুর ব্লকের কুলীন গ্রামে শ্রীচৈতন্য একদা এসেছিলেন সপার্ষদ৷ পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে রথের রশির বেশ কিছুটা অংশ কেটে দিয়েছিল ইঁদুরে৷ সেসময় শ্রীচৈতন্যদেব-শিষ্য সত্যরাজকে কুলীন গ্রাম থেকে নতুন রশি আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ সেই প্রথা মেনেই আজও কুলীন গ্রামের রথের রশি পাঠানো হয় পুরীতে৷ বর্ধমানের কালনার রাজপরিবারের ঐতিহ্যবাহী লালজি মহারাজার রথ। এই রথে জগন্নাথ শুধু নন, শোভা পান লালজি মহারাজের বিগ্রহও৷
১৮৩৬ সালে জমিদার গোবিন্দপ্রসাদ পণ্ডিতের উদ্যোগে সিহারশোলে রথযাত্রা শুরু হয়। অতীতের পুরনো কাঠের রথটি পুড়ে যায়। ১৯২২ সালে ফের পিতলের আচ্ছাদনে ৩৫ ফুট উঁচু রথ তৈরি করা হয় মাহেশের আদলে। রথে রয়েছেন রাজবাড়ির কুলদেবতা দামোদর চন্দ্র। রথকে কেন্দ্র করে মেলা বসে। উল্টোরথ হয় নবম দিনে।
আরও পড়ুন-মুখোশ খুলে গেল আব্বাস-নওশাদদের
কুলটির বেলরুইয়ের রায়বাড়ির রথ ১৮০ বছরের। বেণীমাধব রায় এই রথ-উৎসবের সূচনা করেন। রথটি বর্তমানে লোহার তৈরি। উখড়ার জমিদার বাড়ির রথাযাত্রাও নজরকাড়া। জমিদার পরিবারের সদস্য শোভনলাল সিংহ হাণ্ডা বলেন, ‘‘১৭৮ বছর আগে পূর্বপুরুষ শম্ভুলাল সিংহ হাণ্ডা রথ উৎসবের শুরু করেন।’’ এখানকার রথে অধিষ্ঠিত গোপীনাথ আর শ্রীরাধা। কুলটির শিমুলগ্রামের রথযাত্রা ঘিরেও বাসিন্দাদের উৎসাহ কম নয়। ১৯৯৬ সালে শিমুলগ্রামে তৈরি হয় জগন্নাথ মন্দিরও। সেই সময় পুরীর শঙ্করাচার্য-সহ গোটা দেশের প্রায় ২০০ জন সন্ন্যাসী এই মন্দিরের মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে আসেন।
শিলিগুড়ির রথযাত্রা
শিলিগুড়ির রথ প্রাচীন ও জনপ্রিয়। পুজোর জন্য মন্দিরে কেবল সেবাইতরাই প্রবেশ করতে পারবেন। তবে বিকেলে দর্শনের জন্য খোলা হয় শিলিগুড়ি ইসকন কর্তৃপক্ষের এই মন্দির। আষাঢ় মাসে রথযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া আয়োজন করা হয় মন্দির-প্রাঙ্গণে।