আমি যখন বাবা

জীবনের এক গভীর অনুভূতির নাম বাবা। তিনি যেমন অভিভাবক, নিরাপদ আশ্রয়, পরম বন্ধু— তেমনই একটু ভয়, অনেকটা ভালবাসা। সব বাবাই কি একরকম হন? নাকি প্রজন্মের ফারাকে বদলে যায় পিতা-পুত্রের সম্পর্কের সমীকরণ? আজ ফাদার্স ডে উপলক্ষে সেই অনুভূতির ঝাঁপি খুললেন বিশিষ্টরা। শুনলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

আমি বাবা হিসেবে খুব স্নেহশীল
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

আমার বাবা খুব ব্যক্তিত্ববান মানুষ ছিলেন। অনেক গুণ ছিল তাঁর। আমরা চার ভাইবোন বাবাকে খুব ভয় পেতাম। রেলে চাকরি করতেন, খুব বড় অফিসার ছিলেন। কাজেকর্মে বাইরে যেতে হত তাঁকে। টেনিস খেলতেন, ফুটবল, ক্রিকেট খেলতেন, গানবাজনা ভালবাসতেন। কিন্তু ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একটা দূরত্ব ছিল। আমাদের ভয় আর ভালবাসা— দুইই ছিল। বাবার অবসর নেওয়ার পর বন্ধুত্ব একটু বেড়েছিল। তখন কথা বলতেন খুব। আর আমি বাবা হিসেবে খুব স্নেহশীল। ছেলেমেয়ে দু’জনের সঙ্গেই খুব ঘনিষ্ঠ। সারাক্ষণ ওদের নিয়েই ভাবতে থাকি। ওদের শাসন বিশেষ করিনি। আদর আর প্রশ্রয়ই দিতাম। ওরা আমাকে মোটেই ভয় পায় না তবে ভালবাসে।

আরও পড়ুন-বাংলার রথযাত্রা

বাবা হয়ে উঠিনি এখনও
রাজ চক্রবর্তী

আমার বাবা আর আমি যে বাবা— এই দুয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য। উনি একটু কম কথা বলতেন, অন্তর্মুখী ছিলেন, অনেক বেশি কাজের মধ্যেই থেকেছেন। আহ্লাদ দেননি, শাসনই করেছেন সবসময়। খুব ডিসিপ্লিনড ছিলেন। বাবার ভালবাসাটা বুঝিনি তেমন। তবে তাঁর স্ট্রাগলটা দেখেছি। খুব ভাল, সহজ-সরল মানুষ ছিলেন। মিশতে পারতেন। আমার সঙ্গে বাবার বন্ধুত্ব হয়েছে অনেক পরে। খুব ভয় পেতাম। সম্ভ্রম করে চলতাম। যখন আমি পুরোপুরি কলকাতায় আর বাবা আমার কাছে চলে এলেন থাকতে, তখন আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। সব বিষয়ে খুব উৎসাহ দিতেন। যখন চলে গেলেন বুঝতে পারলাম তিনি কী ছিলেন। আমি মনে হয় এখন ঠিক বাবা হইনি। ছেলেকে অনেক বেশি প্যাম্পার করতে ভালবাসি। ইউভান বড্ড ছোট। এখনও পর্যন্ত ও আমার কাছে একটা খেলনার মতো। ওর সঙ্গে খুব সহজ একটা বন্ধুত্ব আছে। ওই আমাকে বন্ধু করে নিয়েছে। শাসন করি না। ওর মধ্যে আমার বাবার অনেক কিছু দেখতে পাই। আমাদের মনে হয় বোধহয় বাবাই এসেছেন ফিরে। বড় হলে ওর আর আমার বন্ধুত্বই হবে। ওকে নিয়ে আমাদের অনেক কিছু প্ল্যান রয়েছে। চাই সেগুলো পূরণ হোক।

আরও পড়ুন-বনস্পতির ছায়া দিলেন

আমি বাবার পথেই হেঁটেছি
দেবশঙ্কর হালদার

আমার নিজের এই বয়সে এসে মনে হয়, কমবয়সে আমরা সব বাবাকে একই রকম ভাবতাম যে, তাকে কাজ করতে হবে, বাইরে যেতে হবে, তাকে শুধু বিশেষ বিশেষ সময়েই পাব। বাবাদের নিয়ে একটা রহস্য থাকে আর আমার বাবার ক্ষেত্রে রহস্যটা একটু বেশি ছিল। যেহেতু আমার বাবা যাত্রার খুব নামকরা অভিনেতা ছিলেন, ফলত তাঁকে বেরিয়ে পড়তে হত। বাড়ির, রোজকার জীবনের সঙ্গে উনি যুক্ত ছিলেন না। পালা চলত ছ’-সাত মাস টানা, তখন খুব কম দেখা হত। অভিনেতা হিসেবে তাঁর যাপনটাও ছিল আলাদা। সেই অন্যরকম বাবাকে নিয়ে আমার একটা অন্যরকম আগ্রহ কাজ করত। তা সত্ত্বেও বাবাকে চিরকালই মনে হত যেন পরম নির্ভরতার। এই যে আমরা চার ভাই, এক বোন, মা, ঠাকুমা— বাবার দিকেই তাকিয়ে থাকতাম। এখন বাবা হওয়ার পর বুঝতে পারি যে এটা বাবার জন্য কতটা চাপের বিষয় ছিল। কিন্তু সব বাবা বোধহয় এটা এনজয় করেন। এক অর্থে এটাকে তাঁরা লালনও করেন যে আমিই সবটা বুক দিয়ে সামলাব। আমার ক্ষেত্রেও এমনই ঘটেছে কারণ আমিও অভিনেতা। আমার ছেলে একটা সময় বেশ রহস্য নিয়ে আমার দিকে তাকাত। কম বয়সে আমার রাগ হয়েছে, অভিমান হয়েছে যে বাবা এত ছকভাঙা কাজ কেন করেন, একই সঙ্গে আনন্দও হয়েছে যখন তাঁর পালা দেখেছি, প্রাপ্তি দেখেছি। আমার ছেলেরও বোধহয় এই অনুভূতিটাই হয়। তবে আমি কেমন বাবা সেটা বলতে গেলে বলব এই বাবা শব্দটাকে নিয়ে তেমন ভাবিনি। বাবার পথেই হেঁটেছি। আমিও হয়তো ছেলের কাছে রহস্যময়। বাবার সঙ্গে যেমন একটা দূরত্ব ছিল আমার ছেলের সঙ্গেও সেই দূরত্ব আছে তবে আমি সেটা অনুভব করি না। আমার ছেলেকে বন্ধুই মনে হয়।

আরও পড়ুন-অভি-যাত্রায় নবজোয়ার শেষে ভাল ফলের প্রত্যয় উঠছে ভেসে

আমি বাবা কম, বন্ধু বেশি

সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়

বাবার সঙ্গে আমার পুরোটাই তফাত। বাবা পুলিশে চাকরি করতেন। ভীষণ মুডি মানুষ ছিলেন। বাবার ঘাড়ে বিরাট বড় একটা পরিবারের দায়িত্ব ছিল চার ভাই, তিন বোনের। বাবাকে সবাই ভয় পেত। বাবার মুডের উপর আমাদের বাড়ির পরিবেশ নির্ভর করত। বাবা যেদিন খুশি সেদিন সবাই খুশি আর যেদিন বাবার মুখ গম্ভীর বাড়ির সবাই গম্ভীর। বড় হওয়ার পর অনেক কিছু নিয়ে বাবার সঙ্গে দ্বিমত হত। গানকে পেশা করব সেটা বাবার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। গান নেশা হতে পারে, পেশা নয়। কিন্তু মজার বিষয় হল, আমার গান-বাজনার হাতেখড়ি বাবার কাছেই। বাবা আমাকে তবলা বাজানো শেখাতেন আর দিদিকে গান শেখাতেন। পরবর্তী কালে বাবা যখন রিটায়ার করছেন তখন আমি সদ্য কলেজ পাশ-আউট। তেমন আর্থিক সামর্থ্য নেই। নিজের শেষ পুঁজি দিয়ে নাকতলায় ফ্ল্যাট করেছিলেন। তিনি আমাকে হায়ার স্টাডি করাতে পারেননি। তাও সারাজীবন চাকরি করে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন যতটুকু সম্ভব। একটা অভিমান যে ছিল না তা নয়। পরে বুঝেছি যে বাবার উপায় ছিল না। শেষের দিকে বাবার সঙ্গে ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তখন তিনি চোখে হারাতেন। তবে আমি বাবা কম, বন্ধু বেশি। আমি বলেছি মেয়েকে, তোর জীবনে এমন কিছু নেই যা তুই আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারিস না। ওর খুশিতেই খুশি। ওর ইচ্ছেগুলোকে পূরণ করার চেষ্টা করি। অনেক কিছু শিখছে। কোনও কিছু চাপিয়ে দিইনি। খুব সুন্দর একটা বন্ডিং আমাদের মধ্যে।

Latest article