সুনীল আকাশ

মূলত কবি। গিয়েছিলেন গদ্যের সভায়। তুমুল রোম্যান্টিক। দারুণ সংবেদনশীল। প্রতিবাদী। সৃষ্টি করেছেন বিপুল সাহিত্যসম্ভার। তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ৭ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

মধ্যরাতের কলকাতা
অনুবাদের হাত ধরেই কবিতার সঙ্গে বন্ধুতা। কবিতাকে আঁকড়ে ধরেই জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তবু তাঁকে যেতে হয়েছিল গদ্যের সভায়। সেখানেও তিনি চূড়ান্ত সফল। সৃষ্টি করেছেন বিপুল সাহিত্যসম্ভার। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ, আত্মজীবনীর মধ্যে দিয়ে ঘটিয়েছেন নিজের প্রকাশ। সম্পাদনা করেছেন ‘কৃত্তিবাস’।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

‘কৃত্তিবাস’-এর আত্মপ্রকাশ
১৯৫১-এর ৩১ মার্চ। ‘দেশ’ পত্রিকার প্রকাশ পায় প্রথম কবিতা ‘একটি চিঠি’। তখন বয়স সতেরো বছর। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই ‘একা এবং কয়েকজন’। শুরু থেকেই পাঠকদের আকৃষ্ট করে সুনীলের নিজস্ব দৃষ্টি এবং উপস্থাপনার স্বাতন্ত্র্য। প্রথম থেকেই বিষয় রূপে গ্রহণ করেছেন নিজের জীবন-অভিজ্ঞতাকে।
নারী এবং নীরা
সুনীলের কবিমন আচ্ছন্ন ছিল রোম্যান্টিকতায়। তাঁর কাব্য যৌবনমূর্তির চঞ্চল প্রতিচ্ছবি। প্রেম এবং নারী-পুরুষের সম্পর্ককে তিনি নতুন আলোয় আলোকিত করেছেন। নারী তাঁর কাছে এক অন্তহীন প্রেরণা। সারাজীবন তৃষ্ণার্ত ছিলেন ভালবাসা এবং সুন্দরের অনুধ্যানে। নারী এবং প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তাঁর লেখায়। তাই তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছেন নীরাকে।

আরও পড়ুন-নির্বাচন এগিয়ে আনতেই বিশেষ অধিবেশন: নীতীশ

নীললোহিতের হাত ধরে
প্রেমের পাশাপাশি তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে প্রতিবাদ, শ্লেষ, বিদ্রুপ। ধরা পড়েছে তীব্র বেকার সমস্যা। আপাতদৃষ্টিতে রবীন্দ্র-বিরোধী মনে হলেও, ছিলেন তুমুল রবীন্দ্র-অনুরাগী। তাঁর বেশকিছু রচনা সেই সাক্ষ্য বহন করে। কিছু লেখায় আশ্রয় নিয়েছেন ইতিহাসের। সৃষ্টি করেছেন ‘প্রথম আলো’, ‘সেই সময়’। তিনি আমাদের নিয়ে গেছেন দিকশূন্যপুরে। নীললোহিতের হাত ধরে। সে-এক অন্য জগৎ। চোখের সামনে দেখেছেন দেশভাগ। ছিলেন সংবেদনশীল। ব্যথিত হৃদয়ে লিখেছেন ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাস এবং অসংখ্য কবিতা। এক যুগ হল তিনি নেই। তবু আছেন বাঙালির মননে। আজও পঠিত হন। চর্চিত হন। যতদিন থাকবে বাংলা ভাষা, ততদিন থাকবেন তিনি। সুনীল আকাশের মতো।
এই সময়ের কবিদের চোখে—

আরও পড়ুন-শংসাপত্রে আধার নয়, নির্দেশ ইউজিসির

শালীনতার সীমা অতিক্রম করে না
 সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের খুব কাছে থাকার কারণে কবি সুনীল এবং মানুষ সুনীলকে বুঝতে সুবিধা হয়েছে। আমি তাঁকে মূলত প্রেমিক-কবি বলেই মনে করি। তাঁর কবিতায় শরীরকথা থাকে। তবে শালীনতার সীমা অতিক্রম করে না। প্রকৃত জীবনবিলাসী হয়েও সুনীল যে সময়ের ভিতর দিয়ে চলেছেন তা কখনওই অস্বীকার করেননি। ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’ কবিতাটি তো একটা বিশেষ সময়ের দলিল। যুবকের আর্তনাদও বটে। সুনীলের তীব্র জীবনবোধ তাঁকে সারাটা জীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। তাঁর কবিতায় যে শ্লেষ ও প্রতিবাদ দেখেছি, তা ভোলার নয়।

আরও পড়ুন-এক দেশ, এক ভোট: রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণে সংবিধান বদলের চেষ্টা

তাঁর রচনা অদ্ভুত জীবনমুখী
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একজন সপ্রতিভ অত্যন্ত সফল সাহিত্য ব্যক্তিত্বের নাম। কবিপ্রাণ তাঁর সত্তার গভীরে সঞ্চারিত ছিল। কবিতা সুখপাঠ্য, গদ্যও সুখপাঠ্য। আসলে কবি বলেই ওইরকম অসাধারণ গদ্য লিখতে পারতেন। যেমন অসাধারণ গদ্য লিখতেন রবীন্দ্রনাথ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মধ্যে জীবনের যে বার্তা থাকত, সেটাও গ্রহণযোগ্য ছিল। আজও আছে এবং থাকবে। গত শতকের পাঁচের দশকের শীর্ষস্থানীয় এক কবি তিনি। তাঁর রচনা অদ্ভুত জীবনমুখী। আজও তিনি প্রাসঙ্গিক। তাঁর সৃষ্টি জনপ্রিয়তার শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছিল। আমি ওঁর স্নেহ পেয়েছি। বহু অনুষ্ঠানে একসঙ্গে গেছি। বড় কবি ও সাহিত্যিক তো ছিলেনই, পাশাপাশি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বড় মনের মানুষ।

আরও পড়ুন-সৌরযান : টেলিস্কোপ নজরদারিতে দিব্যেন্দু

জীবনবোধের কবি
 সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মূলত রোম্যান্টিক কবি। সেইসঙ্গে জীবনবোধের কবি। তাঁর বেশকিছু কবিতায় দেখা যায় গাঢ় মৃত্যুচেতনা। বিশেষত শেষদিকের কবিতায়। মূলত কবি ছিলেন। পাশাপাশি ছিলেন গদ্যকার। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘‘সুনীল আদ্যন্ত কবি। গদ্যের দিকে কেন গেল? না গেলে ভাল করত।’’ কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় গদ্যের দিকে না গেলে আমরা তাঁর অসামান্য গদ্যগুলো পেতাম না। ওঁর গদ্য মূলত সাধু-গদ্য। সহজ সরল ভাষায় নিজের ভঙ্গিতে লিখেছেন। পড়ার সময় মাঝখানে হোঁচট খেতে হয় না। লেখার মধ্যে দেখা যায় সূক্ষ্মতা, গাঢ়তা। লিখেছেন নিজের সময়কে।

আরও পড়ুন-শংসাপত্রে আধার নয়, নির্দেশ ইউজিসির

বেঁচে থাকতে জানতেন
 সুনীলদাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করত আপনি আপনার লেখার মাধ্যমে পাঠকদের কী দিতে চান? উনি সবসময়ই উত্তর দিতেন, ‘‘আনন্দ’’। উনি ওঁর জীবনে, লেখায় খুব নিবিড়ভাবে বলতেন আনন্দ করো, জীবন সংক্ষিপ্ত, আনন্দ করে নাও যতটা পারো। রবীন্দ্রনাথ রক্তকরবী নাটকে লিখেছিলেন, বেঁচে থাকা আর টিকে থাকা আলাদা বিষয়। টিকে যে থাকে তাকে তার মুক্তি পেয়ে যাওয়াই মঙ্গল। জীবনটা বিধাতা আমাদের দিয়েছেন বাঁচার জন্যে, টিকে থাকার জন্যে নয়। কিন্তু আমরা বাঁচতে আর পারি কতটুকু? আমরা টিকে থাকি। টিকে থাকার ক্লান্তি আমাদের জীবনকে ছেয়ে ফ্যালে। সুনীলদাকে দেখেছিলাম বেঁচে থাকতে। বাঁচার মতো বাঁচা যাকে বলে৷ ওঁর জীবনে প্রতিটি দিন ছিল দোল, প্রতিটি রাত ছিল দীপাবলি। ওঁর মেজাজ ছিল বেপরোয়া পায়রা ওড়ানো, বাজি পোড়ানো জমিদারের মতো। এদিকে এই সুনীলই তাঁর কর্মক্ষেত্রে তুখড় কূটনীতিক, অতীব তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন৷ লেখার রাজনীতি ওঁর থেকে ভাল সেইসময় খুব কমজনই বুঝতেন। তাঁর রাজনীতিবোধ ছিল চোরাবালির ঘূর্ণি। মৃত্যুর পরের লেখার বা কোনও কীর্তির অমরত্বে উনি একেবারেই বিশ্বাস করতেন না। তিনি লিখেছেন ‘মরার পরে বইয়ের হলদে পাতায় নাম হয়ে থেকে কোনও লাভ নেই।’ তাঁর মতে মৃত্যুর পরের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবাটা একটা ভাবালুতা ভরা পাগলামি৷

Latest article