হীরামান্ডি

চোখ ধাঁধানো সেট, নজরকাড়া লুক, রাজকীয় পোশাক, গয়না— যাকে বলে মহাকাব্যিক উপস্থাপন 'হীরামান্ডি' দ্য ডায়মন্ড বাজার। সদ্য নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে পরিচালক সঞ্জয় লীলা বনশালির এই পিরিয়ডিক ড্রামা। যার মাধ্যমে ওটিটিতে অভিষেক হল পরিচালকের। মূল চরিত্রে অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা, সোনাক্ষী সিনহা, শেখর সুমন প্রমুখ। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

স্বাধীনতা-উত্তর পাকিস্তানের শহর লাহোর, যার প্রাণকেন্দ্র হল শাহি মহল্লা। প্রাসাদোপম বাইজি মহল। সালটা ১৯২০। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধীরে ধীরে গ্রাস করছে ভারতকে। সেই সময় লাহোরে সামন্ততন্ত্রের প্রভাব। সেখানকার নবাবরা ছিলেন ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষক। একদিকে ইংরেজ আনুগত্য অন্যদিকে গণিকালয় বিলাসযাপন ছিল তাঁদের শখ। শুধু নবাবদের ক্ষেত্রেই নয় সদ্য যৌবনে পা রাখা নবাবজাদাদের সহবত, আদবকায়দা শেখাতে, তাঁদের পৌরুষকে উসকে দিতে এই শাহিমহল্লার ভূমিকা ছিল মারাত্মক। সদ্য যৌবনা গণিকা কন্যাদের নথউতরাইয়ের অভিষেক অর্থাৎ কৌমারিত্ব ভঙ্গ হত এইসব নবাবের হাতেই। সুন্দরী, অভিজাত, বাইজিরা নবাবদের মন ভোলাতে নৃত্যগীতের সঙ্গে রীতিমতো কাব্যচর্চা, শের শায়েরিচর্চাও করতেন। শাহিমহল্লা তখনও ‘হীরামান্ডি’ (Heeramandi) হয়নি। মহারানা রঞ্জিৎ সিংয়ের প্রধানমন্ত্রী হিরা সিং ডোগরা গড়ে তোলেন হীরামান্ডি যা শুধু গণিকালয় নয় হয়ে উঠেছিল ব্যবসার পীঠস্থান। দিনে ব্যবসা চলত এবং রাতে ছিল বিনোদনের ভরপুর আয়োজন।

হীরামান্ডিতে তখন একদিকে ষড়যন্ত্র, ক্ষমতাদখল এবং প্রতিহিংসার লড়াই অন্যদিকে গোপনে একজোট হতে থাকা ব্রিটিশ-বিরোধী শক্তি। স্বাধীনতা আন্দোলনে এই হীরামান্ডির বারবণিতারা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এমন এক অশান্ত পরিবেশে শুরু হয় প্রেমকাহিনির। এমনই এক প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে স্ট্রিমিং শুরু হয়েছে পরিচালক সঞ্জয়লীলা বনশালির পিরিয়ডিক ড্রামা ‘হীরামান্ডি’ দ্য ডায়মন্ড বাজার।
ঝলমলে শাহিমহলের রানি মালিকাজান। সে ক্ষমতালোভী, ক্রুরতা, চাতুর্য, লালসা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা তাঁর রগে রগে। সেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই শাহিমহলের প্রধান গণিকা দিদি রেহানাকে হত্যা করে সে দখল করে তার গদি। তখন গণিকালয়ও হয়ে ওঠে ব্যবসার কেন্দ্র। তাঁর নারী শুধুই বেচাকেনার সামগ্রী, যার দরদাম ওঠে, নিলাম হয়। সেই মালিকাজানের চোখের আড়ালেই তিলে তিলে বেড়ে উঠতে থাকে তারই ছোট মেয়ে আলমজেব আর নবাব তাজদারের গভীর প্রেম। অন্যদিকে বড় মেয়ে বিব্বোজানও স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত হয়। এমতাবস্থায় মালিকাজানের মৃত দিদির কন্যা ফারিদান মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এসে হাজির হয় শাহিমহলে। শুরু হয় শেয়ানে শেয়ানে টক্কর।

আরও পড়ুন- এবার থেকে রাত এগারোটাতেও মিলবে মেট্রো!

‘হীরামান্ডি’ (Heeramandi) নিঃসন্দেহে সঞ্জয়লীলা বনশালির জীবনের সেরা অধ্যায়। কারণ এটা তাঁর প্রথম ওয়েব সিরিজ যার মাধ্যমে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে পা রাখলেন তিনি। উল্লেখযোগ্য যেটা তা হল ২৮ বছর পরে অভিনেত্রী মনীষা কৈরালার কামব্যাক হল এই ওয়েব সিরিজ দিয়েই। ওয়েব সিরিজটি মুক্তি পেয়েছিল ১ মে। মুক্তির প্রথম সপ্তাহের ভিউজের নিরিখে ‘হীরামান্ডি’ পেয়ে গেছিল সবচেয়ে বেশিবার দেখা ওয়েব সিরিজের খেতাব। ৪৩টি দেশের মধ্যে টপ দশটা সিরিজের মধ্যে রয়েছে এই ওয়েব সিরিজ। সিরিজটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও দর্শকেরা আপাতত ‘হীরামান্ডি’তেই (Heeramandi) মজে রয়েছেন। এর আগে সঞ্জয়লীলা বনশালির সর্বশেষ ছবি ছিল ‘গাঙ্গুবাঈ কাথিয়াওয়াড়ি’। এই ছবিও বেশ চর্চিত। সেই ছবির জন্য আলিয়া ভাট্টের ঝুলিতে এসেছে জাতীয় পুরস্কারও। এরপর প্রথম ওয়েব সিরিজেই কামাল করলেন তিনি। জমকালো শ্যুটিং সেট, আলো-ঝলমলে পরিবেশ, রাজকীয় বেশভূষা, গয়না, হল বনশালির ট্রেডমার্ক। এই সিরিজ তাঁর ব্যতিক্রম নয়। সেই সঙ্গে কাস্টিংও সিরিজ দেখার আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয়।

মূল গল্পটি মইন বেগের। কেন্দ্রীয় চরিত্রে মনীষা ছাড়াও রয়েছেন সোনাক্ষী সিনহা, অদিতি রাও হায়দরি, রিচা চাড্ডা, সঞ্জিদা শেখ, সারমিন সেহগল। এ-ছাড়া এই ওয়েব সিরিজের সেরা আবিষ্কার অভিনেতা ত্বহা শাহ বাদুশা। ফ্লপ ছবির নায়ক ত্বহা এই মুহূর্তে বলিউডের সবচেয়ে পপুলার ফেস। মনীষার অভিনয় নিয়ে আলাদা করে কিছু বলতে হয় না। সোনাক্ষী কতটা শক্তিশালী অভিনেত্রী আবার প্রমাণ করলেন। অদিতি, রিচা, সঞ্জিদার অভিনয় দেখলে বোঝা যায় একজন সেরা পরিচালক সেরা অভিনয়টা নিংড়ে বের করে নিতে পারেন। ৮ পর্বের সিরিজে ১০ হাজারেরও বেশি ডিজাইনের গয়না পরেছেন নায়িকারা। যার ওজন ৩০০ কেজি। তবে পুরো সিরিজ দেখলে মনে হবেই বনশালি তাঁর গল্পের শেষটা আর একটু অন্যরকম ভাবতেই পারতেন। অভিনেত্রী শরমিন সেহেগলকে নিয়ে উঠেছে বিতর্ক। ট্রোলিং-এর শিকার হচ্ছেন সঞ্জয়ের ভাগনি। কারণ এত নিখুঁত অভিনয়ের মাঝে শরমিন বেশ আড়ষ্ট। মহিলাদের পাশাপাশি এই ওয়েব সিরিজের পুরুষেরা জবরদস্ত। তিনজন অভিনেতা কামব্যাক করলেন শেখর সুমন, তার পুত্র অধ্যায়ন সুমন এবং অভিনেতা ফারদিন খান। প্রত্যেকেই মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি একজনের কথা না বললেই নয় তিনি অভিনেতা ইন্দ্রেশ মালিক। ওস্তাদজির চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। পুরো সিরিজটা এই ওস্তাদজির বিনিসুতোয় গাঁথা। কিছু চরিত্র থাকে যারা বরের ঘরের মাসি আর কনের ঘরের পিসি হয়ে গল্পে ট্যুইস্ট আনে। ওস্তাদজি তেমনই একটা চরিত্র।
এই ওয়েব সিরিজের আমির খুসরোর লেখা অনবদ্য জনপ্রিয় গান ‘সকল বান’ সুপারহট। গানটি গেয়েছেন রাজা হাসান। এছাড়া শ্রেয়া ঘোষালের ‘চৌধবী সাব’, শর্মিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়ের ‘তিলসমি আঁখে’ এবং বর্ণালি চট্টোপাধ্যায়ের ‘সাইয়া হটো যাও’ গান তিনটেও সুপারহিট হয়েছে। আজাদি গানটাও মন ছুঁয়ে গেছে দর্শকের।

Latest article