দুঃখবিলাসী উমার দালান

কুমারটুলির অন্দরমহল থেকে ঠাকুর দালানের অন্তরমহল— বাজছে বিষাদের সুর। সেই মন খারাপের স্বরলিপি তুলে ধরলেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দাস

Must read

আসছে বছর আবার হবে
সাড়ে ছ’বছরের মানিকের পা আর চলছে না। দু’পা হাঁটে তো আবার পিছন ফিরে তাকায়। ফিরে ফিরে দেখছে ফাঁকা ঠাকুর দালান। শূন্য মণ্ডপ দেখছে কিন্তু শূন্যতার ভাবনা ওর নেই। ও মা দুর্গাকে খুঁজছে না। খুঁজছে ওর নতুন বন্ধু মেঘ, বুটু, প্রাঞ্জয়, সোনাই আর মুনাইকে। পুজোর ক’টা দিন দাদুর সঙ্গে কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়েছে ও। বাকি সময়টুকুতে দেদার আড্ডা আর গ্রামের গল্প নতুন বন্ধুদের সঙ্গে। মানিক বলে ওর গ্রামের ময়ূরাক্ষী নদীর গল্প। পদ্মের বিলের ভূতের গল্প। ও হয়ে ওঠে পুজো মণ্ডপের গল্পদাদু। আজ আর গল্প হবে না। তাই মানিকের চোখে জল। ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে পুজো মণ্ডপের ঠাকুর দালানে। দু’চোখের কোণ চিক চিক করছে। ওর দাদু ওকে বলছে— মনা, মন খারাপ করিস না। আসছে বছর আবার হবে।

আরও পড়ুন-ননসেন্স সাহিত্যের রাজপুত্র

খবরদার নীলকণ্ঠ কৈলাসের পথে
ঢাকের বোলে— আসছে বছর আবার হবে— পৌঁছে গেছে হাসপাতালের ইমারজেন্সিতেও। কী যে অসহ্য লাগছে শ্রীময়ীর। সারারাত জেগে বসে আছে হাসপাতালে। অপেক্ষা করছে ডাক্তারের জন্যে। ওটি থেকে বেরিয়ে সুখবর দেবেন। একমাত্র মেয়ে দীপার। হাসপাতালের বাইরে তখন বিসর্জনের ঢাক বাজছে। শ্রীময়ী তখনই বোধনের কথা ভাবছে। ভাবছে দীপাকে বাড়ি নিয়ে যাবে। হঠাৎ অপারেশন থিয়েটারের লাল আলোটা নিভে গেল। ডাক্তার জানিয়ে দিলেন দীপাও কৈলাসের পথে। তিনি ফেরাতে পারলেন না। বাইরে তখনও বেজে চলেছে— বলো দুগ্গা মাইকি। আসছে বছর আবার হবে। দীপা তো আর আসবে না নীলকণ্ঠ পাখি হয়ে!

আরও পড়ুন-দিনভর উত্তর ২৪ পরগনার প্রতিটি ব্লকে হল ধিক্কার মিছিল-পথসভা

আবার অপেক্ষা কুমারটুলিতে
মণ্ডপে মণ্ডপে তখনও নেভেনি আলোর বাতি। অথচ সেই বাতিওয়ালার ঘরের মতোই অন্ধকার নেমে এসেছে কুমারটুলির ঘরে ঘরে। এতদিন ঘরের মেয়ে উমা মৃন্ময়ী রূপ ধরে ছিলেন মণ্ডপে মণ্ডপে ষড়ৈশ্চর্যশালিনী মা হয়ে।
ঘরের মেয়ে উমা হয়ে। ঠাকুর দালান আর বারোয়ারি পুজো মণ্ডপে যেন সকাল থেকেই ছন্দ কাটছে ঢাকের তালের। বিষাদের সুর আর ঢাকের বোল মিশেছে বিজয়ার ছন্দে। নবমী নিশিও কেটেছে আলোতে-ভালোতে। মন খারাপের সঙ্গী হয়ে। তাই বনেদি বাড়ির ঠাকুর দালানে আর বারোয়ারি পুজো মণ্ডপে বিষণ্ণতার ছোঁয়া পৌঁছে গেছে কুমারটুলির অন্দরমহলে। ক’টা দিন আগেও ছিল ঘরে ঘরে ব্যস্ততা। শেষ মুহূর্তের সাজো সাজো রব। উমাকে পাঠাতে হবে ঠাকুর দালানে। মণ্ডপে মণ্ডপে। সুসজ্জিত মাকে দেখতে এসেছেন হাজার হাজার মানুষ। মাথা নত করেছেন ভক্তি ভরে। এই ভালবাসা আর প্রাপ্তিতে কুমারটুলির ঘরে ঘরে জ্বলছিল সন্ধ্যাদীপ। তৃপ্তি আর অতৃপ্তির আলো। দশমীতে দু’ঘরই শূন্য হল। বিষাদে আর অপেক্ষাতে শুরু হল দিন গোনা।

আরও পড়ুন-বাম-শাসিত কেরলে জনসভা হামাস নেতার!

মণ্ডপে মণ্ডপে ঠাকুর দালানে বাজছে বিজয়ার গান। ঢাকে বিসর্জনের সুর। অতৃপ্তি আর অপেক্ষা নিয়ে আমরা চেয়ে থাকি কৈলাসের পথে। দিন গুনতে শুরু করি আবার আগমনির। মনে মনে বলি— আসছে বছর আবার হবে। সুখ, দুঃখ, গ্লানি, আলো-অন্ধকার উৎসবের লীন হয়ে যায়।
একবুক শূন্যতা নিয়ে উমা কৈলাসে
উমার বিদায় দুঃখের তো বটেই। অপরাজিতা পুজো মিটিয়ে নীলকণ্ঠ পাখির ডানায় ভর করে বিষণ্ণতাকে উড়িয়ে দেওয়া হয়। কোথাও আবার বন্দুক চালিয়ে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানানো হয়। অনেক বাড়িতেই এই মনখারাপের দিনে উমাকে পান্তা ভাত আর কচুর শাক দেওয়া হয়। গিরিরাজ যাতে দেবীর ভাল-মন্দ খাবার বিষয় টেরটি না পান। বিষণ্ণতা, অন্ধকার আর দুঃখকে ভুলে থাকতেই উমা বিদায়ের নানা রীতি রয়েছে।

আরও পড়ুন-ক্ষমতায় এলেই কৃষকদের ঋণ মকুব হবে, ছত্তিশগড়ে প্রতিশ্রুতি রাহুলের

ঋগ্বেদের সময় এই শরদেই বছর শুরু হত। তখন দীর্ঘায়ু কামনায় বলা হত ‘জীবেম শরদ শতম’। দশমী ছিল শরদের প্রথম দিন— নববর্ষের সূচনার দিন। বাঙালির নববর্ষ ছিল বিজয়া দশমী যা বিষাদের নয়, হরষের উৎসব। আর পৌরাণিক মতে উমার কৈলাসে ঘরে ফেরার দিন। তাই কুমোরটুলি থেকে ঠাকুর দালান— সব জায়গাতেই সুর সপ্তকের ঘেরাটোপে শুদ্ধ নিষাদ কোমল নিষাদে এসে মিশেছে। রয়েছে উৎসব শেষের মনপোড়া গন্ধ। দুঃখ, কষ্ট, ক্লান্তি ভুলে ক’টা দিন ছিল আলোয় ভরা কিন্তু সেই আলোও ম্রিয়মাণ হতে থাকে নবমীর রাত থেকেই। পরদিনই দর্পণে শরদশশীর বিসর্জনের পর মেয়েরা মেতে ওঠে সিঁদুরখেলায়। বিদায়ের মুহূর্তেও মনের কোণে বিষাদ রেখে তাঁরা বিসর্জনে মেতে ওঠেন। এঁরাও জানেন সব কিছুই আসছে বছর আবার ফিরে আসবে না। ফিরে আসবে না মালতীর স্বামী, ফিরে আসবে না চৈতালির ছেলে, ফিরে আসবে না কৈলাস-বিলাসী হরেনবাবুও। তবুও বুকে এক পৃথিবী শূন্যতা নিয়ে উমার হাত ধরে কিছুটা এগিয়ে দেন কৈলাসের পথে। এই শূন্যতা লোকবার জন্যে একটা আকাশও তাদের কাছে ছোট হয়ে যায়। মন খারাপগুলো তাই বারেবারে ছুঁয়ে যায়।

আরও পড়ুন-কাতারে ৮ ভারতীয়র মৃত্যুদণ্ড: দিল্লির সামনে এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ

দুঃখগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে
দুঃখের আর মন খারাপের চিত্রনাট্যে ইতিহাস আর পৌরাণিকতা বেঁধে রেখেছে বিসর্জনকে। পুরাণে যুদ্ধ হয়েছে মহিষাসুরের সঙ্গে নয় দিন নয় রাত্রি এবং দশম দিনে জিতেছেন মা দুর্গা। নারীশক্তির এই জয়কেই বিজয়ার মোড়কে মুড়ে ফেলা হয়েছে কিন্তু যাঁরা আজও দু’বেলা যুদ্ধ করছেন, লড়াই করছেন প্রতিদিনই তাঁরা কখনও হারেন কখনও জেতেন। তৈরি করেন বিষণ্ণতার চিত্রনাট্য, তাঁদের কাছে এই একটা দিনও বিজয়ার শুভ হয় না। শ্রীচণ্ডীতে অবশ্য মহিষাসুরবধের এই ঘটনা বিজয়া দশমীর তকমা পেয়েছে। বারো বছর বনবাস এবং একবছর অজ্ঞাত বাসের পর পাণ্ডবরা এই দশমীতেই শমী গাছের কোটরে তাদের লুকানো অস্ত্র পুনরুদ্ধার করেছেন, পরিচয় দিয়েছেন নিজেদের। অন্ধকারের এই পৃথিবীতে অনেকেই তাঁদের অস্ত্র পুনরুদ্ধার করতে পারে না। এই অস্ত্র জীবনযাপনের অস্ত্র। এই অস্ত্র দিন গুজরানের অস্ত্র। প্রতিদিনের বিজয়ার মতোই তাদের সুখ-শান্তি বিসর্জন হয় কিন্তু পুনরুদ্ধার হয় না। সেই দুঃখগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে বিজয়ার দিনে।

আরও পড়ুন-কাজাখস্তানে আগুন, মৃত্যু

পরাজয়ের অশোক দশমী
কলিঙ্গ যুদ্ধের পর দশদিন ধরে মৌর্য সাম্রাজ্যের সম্রাট অশোক বিজয় উৎসব পালন করেছিলেন। সেটাই বৌদ্ধ ধর্মের বিজয়া দশমী। কিন্তু যুদ্ধ জয়ের ওপারে পরাজয়ের মৃত্যু, গ্লানি আর অন্ধকার উৎসবের সব আলো নিভিয়ে দিয়েছিল। তাই অন্ধকার-বিলাসী এই দশমী হেরে যাওয়া মানুষের কাছে আলো জ্বালাতে পারে না। শুধু হাতড়ে বেড়ায় এক আলোর বিন্দু থেকে অন্য আলোর বিন্দুতে।
ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ ঠাকুর যাবে বিসর্জন
মাটির প্রতিমাকে মনের দেবী হিসেবে পুজো করার পর ঢাক যখন বোল তোলে ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ ঠাকুর যাবে বিসর্জন’ তখনি মৃন্ময়ী দেবী থেকে মুক্তি পান দুর্গা। আলো নিভে যায়। ঠাকুর দালানে টিম টিম করে জ্বলতে থাকে মোমবাতির আলো। সেই আলোতে বাসা বাঁধে মন খারাপের দল। হলুদ অভিমানের দিনগুলো অন্ধকারে ঢেকে যায়। এতদিন যারা আলো দিল তারা এবার লাইট পোস্টের আলোগুলো নামাতে থাকে। তাদের ঘরে জমে থাকা অন্ধকারও হয়তো আলো পাবে— হয়তো এই আশায়। তবু তো উৎসবের দিনে মন খারাপেরা এসে ছুঁয়ে যায়। বাড়ির ছোট্ট ছেলেটা অপেক্ষা করে বাবা আজই ঘরে ফিরবে। ভাঙা প্যান্ডেল অল্প আলো- অন্ধকারে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবে। হয়তো তখনও বাজবে মাইকে— আসছে বছর আবার হবে।

আরও পড়ুন-জ্যোতিপ্রিয়র গ্রেফতারে বিজেপির চক্রান্ত নিয়ে ফুঁসছে ক্ষুব্ধ মন্তেশ্বর

ঘরে ফেরার অপেক্ষা
যখন সমুদ্রমন্থন করা হয়, তখন দেবাদিদেব সেই বিষ পান করেন এবং তাঁর কণ্ঠ নীলবর্ণের হয়ে যায়। তাই তাঁকে নীলকণ্ঠ বলা হয়ে থাকে। আর এই নীলকণ্ঠ পাখিকে তাঁরই প্রতিনিধি মনে করা হয় বাংলায়। আর তাই হিন্দুমতে দশমীর দিন দেবীর নিরঞ্জনের আগে যদি নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো হয় তাহলে সেই পাখি কৈলাসে গিয়ে মহাদেবকে খবর দেবে যে তাঁর ঘরনি ফিরছেন। কিন্তু যে উমারা ঘর ছেড়েছে বহুদিন আগে তারা তো ঘরে ফেরেনি। ঘরে ফেরার গান তো তাদের জন্যে নয়। অন্ধকারের রূপকথায় অপেক্ষা হয়েই তারা থেকে যায়।

Latest article