‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।
শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যে দান।’
শিবঠাকুরের তিন বউ! পার্বতী, দুর্গা আর কালী। কিন্তু আবার গঙ্গাও তো শিবজায়া তাহলে উমা কে? তিনিই কি তবে পার্বতী? বলা হয় শরৎকালে যে মা দুর্গার অকালবোধন শ্রীরামচন্দ্র করেছিলেন তিনি তো ত্রিদেবের অংশ হতে সৃষ্টি। তাহলে সেই মহিষাসুরমর্দিনী শিবের পত্নী, আবার শিবের ছেলেমেয়েদের মা কী করে হয়ে গেলেন! আসলে পুজোর সময় উমা আসেন বাপের বাড়ি মেনকার গৃহে, দুর্গা নন। কী কনফিউশন ভাবুন! শিবকে নিয়ে ছড়া-প্রবাদ, গল্পগাথারও শেষ নেই। তবুও শিবঠাকুরের বিয়ের গুরুত্ব অনেক। কারণ লোককথা অনুযায়ী ফাল্গুনের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি শিব ও উমা বা পার্বতীর বিবাহের দিনটাই হল মহাশিবরাত্রি। এই দিন শিব ও শক্তির দ্বিতীয়বার মিলন ঘটেছিল। তাই এই রাতকে মহাদেবের পুণ্যরাত হিসেবে মনে করা হয়। মা পার্বতী পুরাণে প্রকৃতির প্রতীক। অন্যদিকে মহাদেব চেতনার প্রতীক। তাই শিব ও শক্তি দুইয়ে মিলে জগৎ সংসারের সৃষ্টিযজ্ঞের আয়োজন করেন। আবার পুরাণ মতে মহাশিবরাত্রির রাতে দেবাদিদেব মহাদেব ব্রহ্মার বরে রুদ্র রূপ ধারণ করেছিলেন। এই রাতেরই পুণ্য লগ্নে প্রলয়ঙ্কর তাণ্ডব নৃত্যে মেতে ওঠেন । এই ধ্বংসকারী নৃত্যেরও এক বিশেষ কারণ হল মা সতীর দেহত্যাগের ঘটনা শুনতেই প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েন মহাদেব। তাঁর এই প্রলয় নৃত্যের তিথিতেই উদযাপিত হয় মহাশিবরাত্রি। অন্ধকার আর অজ্ঞতা দূর করার জন্য এই ব্রত পালিত হয়। তাই এই দিনটার মাহাত্ম্য বিরাট।
আরও পড়ুন-জনগর্জনে দিল্লি কাঁপিয়ে দেওয়ার ডাক উঠল পুরুলিয়ার প্রস্তুতিসভায়
কেন চার প্রহরে পুজো
পৌরাণিক মতে শিব মহাপ্রলয়ের বা ধ্বংসের দেবতা। আবার কেউ কেউ মনে করেন শিব অনার্য সংস্কৃতির দেবতা। তিনি আদিনাথ, সিন্ধুসভ্যতায় পাওয়া গেছে পশুপতির মূর্তি যা শিবের আদি রূপ তাই তিনি ‘পশুপতিনাথ’ও। ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুর কলহের ফলে নাকি আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। তিনি অনাদি, অনন্ত।
সেই শিবপুজোর তিথি বা শিবরাত্রি পালনের ইতিবৃত্ত অনেক।
শিবরাত্রির রাতে প্রহরে প্রহরে শিবপুজো করলে তার নাকি মোক্ষ ফললাভ হয়। শিবের মতো বর পায় মেয়েরা। কেন চার প্রহরেই তাঁর পুজো করতে হয় তাই নিয়ে ‘শিব পুরাণ’-এ একটি গল্প আছে।
রুরুদ্রুহ নামে এক ভিল ছিল। সে পশু শিকার করে সংসার চালাত। তাঁর অভাবের সংসার। একবার শিবচতুর্দশীর দিন রুরুদ্রুহ শিকার করতে বেরল। তির-ধনুক আর ছোট্ট একখানা ভিস্তি নিয়ে। হরিণ শিকার করে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেবে।
কিন্তু সারাদিন সমস্ত অরণ্য হন্যে হয়ে খুঁজেও সে কোনও শিকার পেলনা।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বিরোধীদের বুকে কাঁপন ধরিয়েছে
বেলা শেষ হয়ে এসেছে। এমন সময় তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে বনের ভেতরের যে পুকুরটিতে পশুরা রাতে জল খেতে আসে, সেখানে গিয়ে সারারাত খাওয়ার মতো যথেষ্ট জল ভিস্তিতে ভরে ঘাটের কাছেই নিজের অজান্তে একটি বেল গাছে উঠে বসল। যাতে ঘাটে জল খেতে আসা পশু শিকার করতে পারে। ওই গাছের নিচে শুকনো পাতায় ঢাকা ছোট্ট একটি স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ ছিল। রুরুদ্রুহর সেটা জানত না। সেই সময় এক হরিণী জলাশয়ে জল খেতে এলে সে হরিণীকে মারতে গেলে গাছ নড়ে তার অজান্তে শিবলিঙ্গের মাথায় বেলপাতা ঝরে পড়ে আর ভিস্তি থেকে জল পড়ে যায়। প্রথম প্রহরে শিবের পুজো হয়ে গেল তার। হরিণী তার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইল। তার বাড়িতে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, স্বামী, আর-এক সতীন রয়েছে। ভিল তাকে যেতে দেয় এই শর্তে যে, সে তার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে আবার ফিরে আসবে।
ওদিকে দুই প্রহর হয়ে গেল হরিণী জল খেতে গিয়ে ফিরছে না দেখে তার সতীন সেই পুকুরের ঘাটে গিয়ে পৌঁছল তাকে খুঁজতে। তাকে দেখে রুরুদ্রুহ আবার তির-ধনুক দিয়ে মারতে উদ্যত হল তখন সেই নড়াচড়ায় কিছু বেলপাতা এবং ভিস্তি থেকে কিছু জলও চলকে পড়ল গাছের নিচের শিবের মাথায়। তাতেই দ্বিতীয় প্রহরের পুজো হয়ে গেল।
এদিকে সেই হরিণীও রুরুদ্রুহের কাছে ক্ষণিকের প্রাণভিক্ষা চেয়ে ছেলেমেয়েদের দায়ভার স্বামী আর সতীনের কাছে দিয়ে বিদায় নিয়ে ফিরে আসবে বলে কথা দিল।
আরও পড়ুন-উত্তর থেকে দক্ষিণে পাঁচটি মেগা জনসভা করবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
ওদিকে প্রায় তিন প্রহর হতে চলল, অথচ দুই স্ত্রী তখনও ফিরল না দেখে হরিণ চঞ্চল হল। সে বেরল এবং খুঁজতে খুঁজতে হাজির হল সেই পুকুরের ঘাটে। এবারেও ধনুক তুলে তির যোজনা করতে গিয়ে রুরুদ্রুহর নড়াচড়ায় কিছু বেলপাতা ও জল পড়ল শিবের মাথায়। ফলে, তৃতীয় প্রহরের পুজোও হয়ে গেল।
সেই সময় শব্দে চমকে তাকিয়ে হরিণ গাছের ওপর রুরুদ্রুহকে দেখতে পেল। সেও একইরকমভাবে ক্ষণিকের প্রাণভিক্ষা চেয়ে দুই স্ত্রীর ওপর ছেলেমেয়েদের দায়ভার দিয়ে ও বিদায় নিয়ে ফিরে আসার কথা বলল। রুরুদ্রুহ তাকে যেতে দিল।
ওদিকে হরিণ আর তার দুই স্ত্রী তিনজনই পরস্পরের অভিজ্ঞতা বলল সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে ছানাদের সাবধানে থাকার উপদেশ দিয়ে পুকুরের দিকে রওনা দিল।
পুকুরের ধারে হরিণ-পরিবারটি যখন পৌঁছল, তখন রাত্রি চার প্রহর। তাদের দেখে রুরুদ্রুহ খুশি হয়ে তাঁদের মারতে গেলে খাছ নড়ে বেলপাতা এবং ভিস্তির জল পড়ল শিবের মাথায়। ফলে, চার প্রহরের পুজো সম্পূর্ণ হল।
তখন হরিণ বলে উঠল, হে ব্যাধ, সন্তানের জন্য দুই মাতার প্রাণভিক্ষা দিয়ে আমাকে হত্যা করো। হরিণের কথা শুনে তার দুই স্ত্রীও একে অপরকে বাঁচাতে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে এগিয়ে এল।
কিন্তু চার প্রহরে নিজের অজান্তে শিবের পুজো করে নিষ্ঠুর ব্যাধের মনের পাপ দূরীভূত হতে শুরু করেছে।
হরিণ পরিবারের এই ভালবাসা ও ত্যাগের আদর্শ দেখে ব্যাধ রুরুদ্রুহের মন বদলে গেল। তার অনুতাপ হল।
শিবরাত্রিতে চার প্রহরের পুজোয় শিব আগেই তুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি হরিণ জন্ম থেকে হরিণ পরিবারকে উদ্ধার করলেন।
তারপর শিব রুরুদ্রুহকে কৃপা করলেন। শিবের বরে তাঁর মোক্ষলাভ হল।
আরও পড়ুন-জামিন অযোগ্য মামলাই চিন্তার কারণ নির্বাচন কমিশনের
কেন শিবের মতোই বর চাই
কোথাও পুণ্য সঞ্চয়ের অভিলাষে, কোথাও দীর্ঘলালিত মনস্কামনার পূর্তির জন্য এই বিশ্বাস নিয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা শিবরাত্রি পালন করেন। শিব নিজে নাকি উমাকে বলেছিলেন, এই তিথি পালন করলে সমস্ত পাপের ফল থেকে নিষ্কৃতি মিলবে এবং মোক্ষলাভ হবে। প্রাক আর্যযুগে শিব ঊর্বরতা এবং প্রজননের দেবতা হিসেবে পূজিত হতেন। আবার তাঁকে রুদ্ররূপেও পুজো করা হয়েছে বৈদিক যুগে। একদিকে তিনি অঘোরি, শ্মশানবাসী অন্যদিকে তিনি ঘোরতর সংসারী। পার্বতী আর দুই পুত্র গণেশ আর কার্তিককে নিয়ে তাঁর ভরা সুখের সংসার। যুগ পেরিয়েছে কিন্তু শিবের রুদ্ররূপের চেয়েও কালে কালে তাঁর সংসারী রূপটাই বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
প্রাচীনপন্থী থেকে শহুরে অতি-আধুনিকা নারী আজও এমনটাই মনে করেন শিবরাত্রি করলে শিবের মতো বর জুটবে। কিন্তু পুরুষ শিবের প্রতি কেন এই বিশ্বাস?
ভারতীয় পুরাণে দেবতার অনেক রূপ রয়েছে। নানান দায়িত্ব তাঁদের। যেমন কৃষ্ণ এবং রাম প্রেম ও কর্তব্যের নিদর্শন হয়ে মর্ত্যবাসীর মনে জায়গা করে নিয়েছেন। কিন্তু একমাত্র শিবই গৃহস্থের প্রতীক হয়ে বিরাজ করেছেন জনমানসে। তাই রামও নয়, কৃষ্ণও নয়— এখনও ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত, বুনো ফুলে সজ্জিত, ধ্যানে মগ্ন, শ্মশানচারী গাঁজা সেবনকরা শিবের মতো স্বামীই কামনা করেন মেয়েরা। আসলে তাঁর সংসারত্যাগী রূপটা তাঁর নিপাট ভালমানুষীর প্রতীক রূপে ব্যাখা দিয়েছেন বহু গবেষক। স্ত্রীয়ের হাতে সব ছেড়ে নিশ্চিন্তে বসে আছেন। সংসারে কোনও আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও তাঁর ভালবাসা একনিষ্ঠতা শুধুই পার্বতীর জন্য। আবার পার্বতীর আগে শিব যখন সতীকে হারান তখন সেই প্রেমে তিনি সমগ্র সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে শুরু করেন। অর্ধনারীশ্বর রূপে একমাত্র শিবই নারীকে শক্তিরূপে নিজে অঙ্গে স্থান দিয়েছেন। সাদামাঠা সর্বত্যাগী বেশভূষা, সরল নিষ্পাপ, ধ্যানমগ্ন স্বামীটি পার্বতীকে কালীরূপ ধারণে সাহায্য করেছিলেন। শিব ঘরনি নিজের অন্তর্নিহিত শক্তি, দেবীত্ব সম্পর্কে একেবারেই ওয়াকিবহাল ছিলেন না। শিবই সেই স্বামী যে স্ত্রীকে অসুরের বিরুদ্ধে লড়তে শেখালেন। তারপর যখন কালী ধংসলীলায় মেতে উঠেছেন উগ্রচণ্ডা রূপে সবকিছু তছনছ করে দিতে উদ্যত ঠিক তখন তাঁকে শান্ত করে শিব নিজের বুক পেতে দেন। সমাজ তো এমন পুরুষেরই বন্দনা করে। তিনি সেই পুরুষ যিনি নারীর অনুপ্রেরণা। পাগল, খ্যাপাটে শিবশম্ভু তাই দেবত্বে নয় স্বামীত্বেই জনপ্রিয় হয়েছেন।
আরও পড়ুন-স্পর্শকাতর এলাকা চিহ্নিত করবে সিআরপিএফ!
গবেষকদের কাছে শিব আজও অতি-আকর্ষণীয় এক দেবতা। বস্তুত আধুনিক ইংরেজি-জানা শহুরে তরুণরা যাঁরা ‘দেশি’ সংস্কৃতি এবং ধর্ম থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখেন, তাঁরাও এখন শিবের প্রবল অনুরাগী হয়েছেন। কিছু গবেষক মহিলামহলে শিবের জনপ্রিয়তার অন্য ব্যাখা দিয়েছেন তাঁদের মতে— মুঘল আমলের শেষের দিকে এবং ব্রিটিশ যুগের প্রথম পর্বে হিন্দু জমিদার ও ‘রাজা’দের প্রতিপত্তি যখন বাড়ল, তখন সমাজে পিতৃতন্ত্র নানা ভাবে, নানা রূপে নতুন করে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করল। এমনকী মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গাকেও বাগে আনতে শিবঘরনি করা হল তাঁকে। স্বাধীনচেতা শৌর্যময়ী দেবীকে ঘরের মেয়ে বানিয়ে ফেলা হল। যে মেয়েটি বৎসরান্তে বাপের বাড়ি আসে, চার দিন সেখানে কাটিয়ে আবার কেঁদে এবং কাঁদিয়ে পতিগৃহে যাত্রা করে। এই প্রক্রিয়াতেই শিবের ভাবমূর্তি এবং উপাসনারও একটা রূপান্তর ঘটে গেল। তাঁর শক্তিমতী স্ত্রীকে পাতিব্রত্যের লাগাম পরিয়ে বেঁধে ফেলা হল, আর অল্পবয়সি মেয়েদের তাঁর আরাধনায় উপবাস ও অন্যান্য কৃচ্ছ্রসাধনের ব্রত পালনে নিযুক্ত করা হল, যাতে তারা শিবের মতো প্রবল এবং রগচটা এক স্বামীকে মনে মনে কামনা করে। আর দিনে দিনে বাংলার সমাজে শিবের মহিমা বৃদ্ধি পেতে থাকল। লাখ লাখ ভক্ত দেবাদিদেবের আরাধনায় নিবেদিতপ্রাণ হলেন।